সে দিন জ়েলেনস্কিকে প্রায় ধমকে বলে ওঠেন ট্রাম্প: “আপনি অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছেন। এই যুদ্ধে জিততে পারবেন না।” বিপুল শক্তির দেশের প্রেসিডেন্ট যে ক্ষীণকায় দুর্বল একটা দেশের প্রেসিডেন্টের উপর এ ভাবে দাপট দেখাবেন, এটাই তো এখন স্বাভাবিক দস্তুর। ধমকেই থেমে যাননি ট্রাম্প, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পুরো দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছেন জ়েলেনস্কির উপর: “লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন।”
এমন ভাবে বলছিলেন ট্রাম্প, যাতে রাশিয়ার আক্রমণে আক্রান্ত ইউক্রেনবাসীর বিপর্যয়ের সত্যকে আমরা ক্রমশই ভুলে যেতে পারি। গত শতকের ত্রিশের দশকে যেমনটা করতেন গোয়েবলস, প্রচারমাধ্যমের অনবরত ব্যবহারে লাগাতার ‘মিথ্যে’কে ‘সত্য’ বানিয়ে তুলতেন, জার্মানির সর্বত্র ফুয়েরারের একই কথা জার্মান জনসাধারণের কাছে যাতে দৈববাণী হয়ে ওঠে। সেই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আরও মজবুত হয়ে উঠেছিল নাৎসিতন্ত্র।
‘টেক্সট বুক ফ্যাসিজ়ম অব গোয়েবলস’ বলছিলেন একে উইম ওয়েন্ডার্স (ছবি)। বিখ্যাত এই চলচ্চিত্রকার গত মাসের মাঝামাঝি নাগাদ কলকাতায় এসেছিলেন। না, তাঁর সঙ্গে আমেরিকার কূটনীতি কিংবা বিদেশনীতি নিয়ে কোনও কথা হয়নি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জাতীয়তাবাদতাঁর কাছে কেন বিপজ্জনক মনে হয়, কারণ, বছর দুয়েক হতে চলল প্রায়, কান ফেস্টিভ্যালে বলেছিলেন ‘ন্যাশনালিজ়ম ইজ় দ্য মোস্ট ডেনজারাস থিং অন দ্য প্ল্যানেট’।
তাঁর ওই মন্তব্যের হাতে-নগদ প্রমাণ অবশ্য আমরা পেয়েই চলেছি ক্রমাগত, দেশে, অন্য দেশে। এখন জাতীয়তাবাদ মানে কেবল স্বাজাত্যের ঔদ্ধত্য আর অহঙ্কার। তা এমনই স্বার্থান্ধ যে, স্বজাতি-সহ বিশ্বের বিভিন্ন জাতিকে শেখায় প্রতিবেশী বা অপর জাতিকে কী ভাবে দমন কিংবা ধ্বংস করা যায়।
এই জার্মান পরিচালকের সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন কলকাতার গোয়টে ইনস্টিটিউট, ম্যাক্সমুলার ভবনের কর্তৃপক্ষ। আমার প্রশ্নে প্রথমে বললেন, ন্যাশনালিজ়ম এখন নানা ধরনের আকার নিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে চলে গেলেন আমেরিকার প্রসঙ্গে, রীতিমতো বিস্ময়কর লাগছে রাষ্ট্র হিসেবে তাদের সাম্প্রতিক কিছু কার্যকলাপ, তার মধ্যে একটি হল ইতিহাসকেও তারা নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাইছে, যা ‘স্ট্রিক্টলি ফ্যাসিস্ট’। আর এ সব করছেন ‘পপুলিস্ট রাইট-উইং পলিটিশিয়ানস’। এঁদের পিছনে ছুটছে যারা তারা যে প্রধানত পুরুষ, সে-কথাও খেয়াল করিয়ে দিতে ভুললেন না। এ এমন এক ‘রেসিপি’, যা আগেও এক বার প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছিল গোটা পৃথিবীকে... দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিলেন।
কিন্তু আমেরিকাকে জড়িয়ে তো আপনার আবেগে এক প্রফুল্ল উদ্দীপন, যাকে ‘র্যাপসডিক সেন্স অব আমেরিকা’ বললে অত্যুক্তি হয় না... প্রশ্নটা না করে পারলাম না। উইম ওয়েন্ডার্স আসলে আজন্ম লালিতপালিত আমেরিকান সংস্কৃতিতে। “আমেরিকানরাই আমাদের মুক্ত করেছিলেন জার্মানির নাৎসি শাসন থেকে।” “আমি সব সময়ে ভেবেছিলাম”, বলেন তিনি, “ইট ওয়াজ় আ লিবারেশন।” বেড়ে উঠতে উঠতে আমেরিকার শিল্প-সাহিত্যের ভিতর নিজেকে আবিষ্কার করছিলেন তিনি। প্রথমে সে দেশের সঙ্গীতে আসক্ত হলেন, আজও সে টান অক্ষুণ্ণ, ‘ফ্যান্টাস্টিক’ শব্দটা শুধু উচ্চারণ করলেন। আরও পরে আসক্ত হয়েছিলেন বইপত্র চলচ্চিত্রে। পনেরো বছর কাটিয়েছেন আমেরিকায়, ছবিও করেছেন সেখানে।
ফিরে আসেন এক সময়, ফেরত দিয়ে দেন গ্রিনকার্ড। আদতে তিনি জার্মান পরিচালকই, কখনও আমেরিকান চলচ্চিত্রকার হতে চাননি। এখনও ‘জার্মান রোমান্টিক’ই ভাবতে ভালবাসেন নিজেকে। তবে এই যে জার্মানির সংস্কৃতিতে প্রত্যাবর্তন, নিজের কাছে নিজেকে জার্মান হিসেবে গ্রহণ করা, এ-উপলব্ধির পিছনেও কিন্তু সেই আমেরিকান র্যাপসডি। কত পথ তাঁকে হাঁটতে হল, কত পথ ঘুরে তাঁকে জার্মানির সুসংস্কৃতির কাছে পৌঁছতে হল, সম্ভবই হত না, যদি না কম বয়সেই তাঁর অনুভূতিতে মুক্তির বোধ চারিয়ে দিতেন আমেরিকানরা।
ওই মুক্তির বোধই বিশ্ববোধ তৈরি করেছে তাঁর ভিতরে, প্রাণিত করেছে ‘টু বিকাম আ সিটিজ়েন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত জাতীয়তাবাদের প্রচলিত প্রথা ভেঙে বিশ্ববাদে উপনীত হতে পেরেছেন, নতুন নতুন ছবি করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া জাপান লাতিন আমেরিকার দেশগুলিকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে শিখেছেন। আজ তিনি বিশ্বপথিক, বলছিলেন ‘আমি শুধু নিজের দেশে বসে ছবি বানাইনি’। সেই গত শতকের সত্তর দশকের প্রথম পর্যায়ে তাঁর ছবি অ্যালিস ইন দ্য সিটিতে প্রকাশ পেয়েছিল ‘রোড মুভিজ়’-এর যে শিল্পরীতি, তাও ওই স্বদেশে-ভিন দেশে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার জন্যে পথ-চলার অভিপ্রায় থেকেই। টের পাচ্ছিলাম, সরাসরি কোনও রাজনৈতিক মন্তব্যে শামিল হচ্ছেন না, কিন্তু আমেরিকার রাষ্ট্রনীতির দ্বিচারিতা তাঁকে আহত করেছে গভীরে, ফলে আমেরিকা দেশটার প্রতি তাঁর মুগ্ধতাতেই আঘাত লেগেছে।
প্রথম প্রশ্নই ছিল উইম ওয়েন্ডার্স-এর কাছে: আপনি তো ১৯৪৫-এ জন্মেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম বছরটিতে, কোনও প্রভাব টের পান আপনার শিল্পকর্মে? বললেন, শুধু তো ১৯৪৫ নয়, অগস্ট মাসেই জন্মেছিলাম, আমার জন্মের ক’দিন আগেই হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়। নাৎসি শাসনে জর্জরিত যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটায় জন্মেছিলাম, যে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বড় হয়েছিলাম, আজও সেই একই ছবি দেখতে পাচ্ছি ইউক্রেনের শহরগুলোয় এবং গাজ়ায়।
আরও বলছিলেন, ছবি করি শুধু ইতিহাসকে জানতে, অন্যকে জানাতে। ঠিক এখানেই অন্য শিল্পমাধ্যমের থেকে এগিয়ে সিনেমা। সিনেমাই পারে আজকের ভয়ঙ্কর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভুলে যাওয়া ভয়াবহ স্মৃতিকে ফের মনে পড়িয়ে দিতে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)