—ফাইল চিত্র।
সে দিন ৩ নভেম্বর, ২০২৩। পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্রনেতা, এবং বিশ্বের আরও নানা দেশের রাজধানীতে নেতারা রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করছেন একটি ভাষণ শোনার জন্য। ভাষণ দেবেন লেবানন-ভিত্তিক শিয়া গোষ্ঠী হিজ়বুল্লার প্রধান, সৈয়দ হাসান নাসরুল্লা। ৭ অক্টোবর ঘটে গিয়েছে ইজ়রায়েলের উপর হামাসের আক্রমণ, যা রূপ নিয়েছে প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে ইজ়রায়েলের যুদ্ধে। তার পর ৩ নভেম্বর প্রথম মুখ খুলবেন নাসরুল্লা। সকলে প্রতীক্ষা করছেন জানার জন্য, হিজ়বুল্লা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে কি না। যদি তেমন ঘটে, তা হলে হামাসের বিরুদ্ধে ইজ়রায়েলের যুদ্ধ রূপ নেবে ওই ভূখণ্ডের সংঘাতে, বিশ্বের কাছেও যা এক অন্য তাৎপর্য নিয়ে আসবে।
নাসরুল্লা অবশ্য ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে সর্বশক্তিতে যুদ্ধে নামার ঘোষণা করলেন না। তিনি সে দিন বলেন, হিজ়বুল্লা আগে থেকেই লেবাননের উত্তর সীমান্তে ইজ়রায়েলের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে। তবে ইজ়রায়েল যদি নির্দোষ প্যালেস্টাইনিদের উপরে হামলা চালিয়ে যায়, তা হলে তা পুরোদস্তুর যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।
‘হিজ়বুল্লা’ কথাটির অর্থ, ‘ঈশ্বরের দল’। রাষ্ট্রের অধীন নয়, এমন সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী হল হিজ়বুল্লা। তার রয়েছে এক লক্ষেরও বেশি প্রশিক্ষিত, দায়বদ্ধ সৈনিক, প্রচুর উঁচু মানের অস্ত্রশস্ত্র, দেড় লক্ষেরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র। ১৯৮২ সালে ইজ়রায়েল লেবাননকে আক্রমণ করার পরে ইরান তৈরি করে এই বাহিনীকে। ধর্মপ্রচারক নাসরুল্লা, তাঁর পরামর্শদাতা শেখ আব্বাস মুসাওয়ি, এবং তাঁদের আমল গোষ্ঠীর সদস্যরা সেই সময়ে বাধ্য হন জঙ্গি সংগঠন হিজ়বুল্লায় যোগ দিতে। আশির দশকে লেবাননের গৃহযুদ্ধে অচিরেই হিজ়বুল্লা সব থেকে শক্তিশালী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে। ১৯৯২ সালে মুসাওয়িকে ইজ়রায়েল হত্যা করার পরে নাসরুল্লার অধীনে হিজ়বুল্লার চরিত্র অনেকটাই বদলে যায়। ইজ়রায়েল এবং আমেরিকা, দু’টি দেশের বিরুদ্ধেই আক্রমণ আরও তীব্র করে হিজ়বুল্লা, আমেরিকার কয়েকশো সেনা নিহত হয় সেই সব হানায়। সেই সঙ্গে, আর্জেন্টিনা-সহ নানা দেশে ইহুদিদের সম্পত্তিতে বোমা বিস্ফোরণ করে হিজ়বুল্লা। উদ্দেশ্য, বিশ্বের নজর টানা। অচিরেই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির তালিকায় হিজ়বুল্লাকে যুক্ত করে আমেরিকা।
অনেকেই হিজ়বুল্লাকে লেবানীয় পরিচয়ের আড়ালে ইরানের সংগঠন বলে মনে করেন। নাসরুল্লা ইরানের ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলিতে বেশ কয়েক বছর ধর্মগ্রন্থের পাঠ নিয়েছেন। ইরাক, সিরিয়াতে ইরানের পক্ষে হিজ়বুল্লার কার্যকলাপ দেখে ‘গাল্ফ কোঅপারেশন কাউন্সিল’ (বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আমিরশাহির মধ্যে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমন্বয়ের সংগঠন) ২০১৬ সালে হিজ়বুল্লাকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে ঘোষণা করেছে। মরক্কোয় সরকার-বিরোধী কার্যকলাপে হিজ়বুল্লার মদতের প্রতিবাদ করে ২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে মরক্কো। পাশাপাশি, ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতার জন্য আরব দেশগুলির সাধারণ মানুষের মধ্যে হিজ়বুল্লার প্রতি সমর্থন যথেষ্ট। তার ফলে আরব দেশগুলিতে প্রশাসন প্রায়ই উভয় সঙ্কটে পড়ে। এখন তেমনই ঘটছে। হিজ়বুল্লা লেবাননের রাজনীতিতেও যোগ দিয়েছে, পার্লামেন্টে তাদের সদস্য রয়েছে। বেশ কিছু স্কুল এবং হাসপাতালও চালায় হিজ়বুল্লা।
হিজ়বুল্লাই একমাত্র আরব সামরিক বাহিনী যা ইজ়রায়েলকে পরাজিত করেছিল ২০০৬ সালে, এবং তাকে লেবানন ছাড়তে বাধ্য করেছিল। আল কায়দা-সহ বিশ্বের বেশ কিছু সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কাছে হিজ়বুল্লা একটি দৃষ্টান্ত, তার সুপরিকল্পিত ভাবে একাধিক সন্ত্রাসী হানা চালানোর কৌশলের জন্য। ইটালির রেড ব্রিগেডস, কুর্দিস্তানের ওয়ার্কার্স পার্টি, আয়ারল্যান্ডের রিপাবলিকান আর্মি, এমন বেশ কিছু জঙ্গি বাহিনী প্রশিক্ষণও নিয়েছে হিজ়বুল্লার কাছে।
অতএব, নাসরুল্লার সতর্কবার্তাকে হালকা ভাবে নেওয়া চলে না। বিশ্বের নেতারা, বিশেষ করে আমেরিকা যথেষ্ট উদ্বেগে রয়েছে যে, হিজ়বুল্লা যুদ্ধে যোগ দিলে ইরান, এবং ইরাক, ইয়েমেন এবং সিরিয়াতে অবস্থিত বিভিন্ন সামরিক গোষ্ঠী, যেগুলি ‘অ্যাক্সিস অব রেজ়িসট্যান্স’-এর অন্তর্ভুক্ত, সেগুলি যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হবে। অন্যান্য আরব দেশ, এবং আরব উপসাগরের তেল-উৎপাদক দেশগুলিকেও ঠেলে দেবে যুদ্ধে। ফলে তেল ও গ্যাসের দাম বাড়বে সারা বিশ্বে। অতিমারির পরে লকডাউন, এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের জেরে এখনই কাহিল বিশ্ব অর্থনীতি আরও বিপর্যস্ত হবে। তাতে আমেরিকার জন্য তৈরি হবে মস্ত চ্যালেঞ্জ। হামাসের আক্রমণের পরেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইজ়রায়েলে গিয়ে ঐক্য প্রদর্শন করে এসেছেন, অস্ত্রের জোগানও দিচ্ছেন। ভূমধ্যসাগরে দুটো বিমানবাহী আমেরিকান জাহাজ দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। আমেরিকার সামরিক বাহিনী এখনই পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে ইউক্রেনের যুদ্ধে। তাইওয়ান প্রণালীতে চিনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কও এখন সঙ্কটপূর্ণ। এই অবস্থায় যুদ্ধের তৃতীয় একটি সীমান্ত খুলে গেলে সঙ্কট বাড়বে। ইরান এবং অন্যান্য আরব দেশের অর্থনীতির উপরেও যুদ্ধের প্রভাব হবে নেতিবাচক। এই সব সম্ভাব্য ক্ষতির মুখে পড়ে সতর্ক ভাবে পা ফেলার চেষ্টা করছে সব দেশ। পশ্চিম এশিয়ার সংঘাতের ফল কত সুদূরপ্রসারী ও মারাত্মক হতে পারে, এখনও তা হয়তো বুঝতে পারছি না আমরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy