Advertisement
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
আদানি গোষ্ঠীর পাখির চোখ ভারতের রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো ব্যবস্থা
Adani Group

অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগবে?

কলেজ-ছুট গৌতম আদানির ব্যবসায়ী জীবন হিরে বেচা-কেনা থেকে শুরু হলেও, তিনিও একই পরিবারতান্ত্রিক গোষ্ঠীর পথেরই পথিক।

ship.

দখল: ভারতে কয়লা নিয়ে যেতে অস্ট্রেলিয়ার উত্তরতম বন্দর অ্যাবট পোর্ট ভাড়া নিয়েছে আদানি গোষ্ঠী। ২০১৯। গেটি ইমেজেস।

সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৩ ০৪:৫৭
Share: Save:

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ-এর ধাক্কায় আদানি সাম্রাজ্য এখনও বেকায়দায়। কিন্তু, ভারতের ইতিহাসে যে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর দ্রুততম উত্থান হয়েছিল, তার উল্কাগতিতে পতন নিয়ে আমজনতার উত্তেজিত হওয়ার কোনও সঙ্গত কারণ আছে কি— অন্তত, বিশুদ্ধ ঈর্ষা ছাড়া? লক্ষ্মী যদি প্রসন্ন হন, তাতে লগ্নিকারীর লাভ যেমন নিজস্ব, তেমনই লোকসানের বোঝাও চাপে সেই ব্যক্তি বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের উপরে। কাজেই, আদানি গোষ্ঠীর বিপাকে পড়ার কোনও প্রভাব কি ভারতের সামগ্রিক অর্থনীতির উপরে পড়তে পারে? যদি পড়ে, তা হলে সমস্যার মূল উৎস কোথায়?

ব্যক্তি গৌতম আদানি এক গোষ্ঠীর কর্ণধার, যার ছাতার তলায় আছে নানাবিধ ব্যবসার মালিকানা। ব্যক্তিবিশেষের সাফল্য থেকে তাঁর পারবারিক উত্থান ও সেই চৌহদ্দি ঘিরে গোষ্ঠীতন্ত্রের এই আবর্তন শুধু রাজনীতি বা ফিল্ম জগতেই ঘটে না, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও ভারত-সহ বহু দেশে এমন নজির অনেক। গোষ্ঠীবর্গের সম্মিলিত ব্যবসার পরিধি ও বিস্তার আলপিন তৈরি থেকে হাতি জোগানো পর্যন্ত। ভারতে টাটা, বিড়লা ইত্যাদি পরিবার, কোরিয়াতে হুন্ডাই, বা জাপানে মিৎসুবিশি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

একই পরিবারভুক্ত এই সব সংস্থার অর্থনৈতিক চরিত্র ও মালিকানার ধরন, গঠন ও কাঠামো অনেক ক্ষেত্রেই পিরামিডসদৃশ, যেখানে চূড়ার শীর্ষে থাকেন মূল কর্ণধার এবং তাঁর মূল সংস্থা। সেই অভিভাবক সংস্থা থেকে সৃষ্ট হয় দ্বিতীয় সংস্থা, আবার সেখান থেকে জন্ম নেয় তৃতীয় সংস্থা ইত্যাদি। বহির্জগতের সঙ্গে ছাড়াও, এদের নিজেদের গোষ্ঠীগুলির মধ্যে চলে বৈধ এবং আপাত-বৈধ নানা প্রকারের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক লেনদেন, যা অনেক সময় অস্বচ্ছ ও অস্পষ্ট। ফলে অনেক সময়ে এদের সামগ্রিক লাভ-লোকসানের নির্ভুল হিসাব বা সম্পত্তির পরিমাপ ও মালিকানার আসল উৎস উদ্ধার করা অতীব দুরূহ কাজ।

কলেজ-ছুট গৌতম আদানির ব্যবসায়ী জীবন হিরে বেচা-কেনা থেকে শুরু হলেও, তিনিও একই পরিবারতান্ত্রিক গোষ্ঠীর পথেরই পথিক। তবে ভারতের অন্যান্য পারিবারিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর তুলনায় তাঁর পথ অনেকটাই আলাদা। প্রথমত, অন্য অনেকের মতো তাঁর অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের বিস্তার বিবিধ দিকে হলেও তাঁর একটি সুনির্দিষ্ট অভিমুখ রয়েছে— নৌবন্দর ও বিমানবন্দর, সিমেন্ট, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য শক্তির (কয়লা, তাপ বিদ্যুৎ ইত্যাদি) উৎপাদন, পরিবহণ ও পরিচালনা, এমনকি পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদন। এক কথায়, আদানি গোষ্ঠীর পাখির চোখ হল সমগ্র রাষ্ট্রের পরিকাঠামো ব্যবস্থা ও তার সঙ্গে সংযুক্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। যেমন, এই গোষ্ঠীর অন্যতম এক প্রকল্পের কাজ হল সুদূর অস্ট্রেলিয়ার খনি থেকে কয়লা জাহাজে চাপিয়ে সংস্থারই নিজস্ব বন্দরের মাধ্যমে ভারতে নিয়ে আসা। পরের ধাপে তাকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসে রূপান্তরিত করে, পাইপলাইনে ও গ্রিডের মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত জায়গায় বণ্টন করা। নানান পরিকাঠামো তৈরির অত্যাবশ্যক যে জোগান শৃঙ্খল, তার প্রতি অংশ থেকেই মুনাফা অর্জনের এই প্রয়াস আদানি গোষ্ঠীভুক্ত সংস্থাগুলির এক প্রধান বিশেষত্ব।

এদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য: বাজার এবং ব্যাঙ্ক থেকে তোলা আকাশছোঁয়া ঋণ, যা গোষ্ঠীভুক্ত পারিবারিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অতিশয় বিরল। হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, ২০২০-২১ সালে এই গোষ্ঠীর সামগ্রিক ঋণ ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন বা ৩০০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ধারের পরিমাণই ২২৮০ কোটি ডলার, বাকিটা দেশি ও বিদেশি বাজারে ঋণপত্র বিক্রি করে তোলা। আদানি পাওয়ার-এর ধারই প্রায় সমগ্র মূলধনের ৫২ শতাংশ, যা কোম্পানির হিসাবের খাতাকলমের শক্তির চেয়ে অনেক গুণ বেশি।

তৃতীয়ত, বিগত দশ বছরে এই ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর উত্থান, বিস্তার ও সামগ্রিক বৃদ্ধির হার লক্ষণীয়। ২০১৪ সালের পরের ছ’বছরে আদানি গোষ্ঠীর মোট সম্পদ বেড়েছে প্রায় ২৩০ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে শেয়ার বাজারে এই গোষ্ঠীভুক্ত সব সংস্থার মূল্যায়ন বৃদ্ধির হার ১৩০০ শতাংশ। একই সময় গৌতম আদানি পেয়েছেন ভারতের জল, স্থল এবং অন্তরিক্ষে একের পর এক সরকারি পরিকাঠামো নির্মাণের প্রকল্পের বরাত এবং নামী ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থাগুলির আর্থিক সহায়তা। যদিও সরকারি ভাবে ঘোষিত যে, এই সিদ্ধান্তগুলির পিছনে না আছে কোনও রকম অস্বাভাবিক বদান্যতা, না কোনও পক্ষপাতিত্ব।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে গৌতম আদানির মূল সংস্থা ও গোষ্ঠীভুক্ত অধীনস্থ সদস্য সংস্থাগুলির মধ্যে অনেক অস্বচ্ছ, ধোয়াঁশাপূর্ণ এবং সন্দেহজনক লেনদেনের কথা উল্লেখ আছে, রিপোর্ট অনুসারে যা নির্দেশ করে হিসাবের খাতায় কারচুপি, ও কৃত্রিম উপায়ে বাজারে শেয়ার দর বাড়ানোর দিকে। রিপোর্টের মতে বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্ট আরও অসংখ্য উপগোষ্ঠী ও তাদের শেল কোম্পানি তৈরি করা হয়েছে এই সব লেনদেন গোপন ভাবে সম্পন্ন করার জন্য। যেমন, আদানি গোষ্ঠীরই জমা দেওয়া এক দলিলে উল্লেখ আছে মরিশাসে রেজিস্টার্ড এক সংস্থার কথা, যারা আদানি গোষ্ঠীর হয়ে দুটো সিমেন্ট সংস্থার শেয়ার বাজারে কেনা-বেচা করবে। কিন্তু সেই শেল কোম্পানির কেউ আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত নন। এই লেনদেনের জন্য টাকার উৎস ও গন্তব্যের না আছে নাম, না কোনও ঠিকানা। দুই সিমেন্ট কোম্পানির মূল্য ১০০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। রিপোর্টে এমন তথ্য প্রচুর। আদানি গোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় অভিযোগ বিবৃতি প্রকাশ করে অস্বীকার করেছে। বল এখন তাই সুপ্রিম কোর্টে। এখানে বিচারের রায় বেরোনো অবধি সবাই নির্দোষ।

তবে এই মুহর্তের সমস্যাটা অন্যত্র। এখন সব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে মূলধনি বা শেয়ার মার্কেটে। এ বড় নিষ্করুণ, অস্থির ও খামখেয়ালি ক্ষমাহীন জায়গা। এখানে সম্ভাব্য অভিযুক্তকে প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণ করতে হয় যে, তিনি তিনশো ভাগ নিরপরাধ। প্রতিনিয়তই এই বাজার চলে অন্ধকারে পথ হাতড়ে, কিছুটা বিশ্বাস, অল্প স্বল্প আস্থা আর বাদবাকিটা গণ হুজুগ আর নির্ভরযোগ্য তথ্যের বিশ্লেষণে। গত দুই দশকের তথ্যভিত্তিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, দেশ-কাল-নির্বিশেষে শিল্পপতি পরিবারের এক উল্লেখযোগ্য অংশ কম-বেশি সর্বত্রই পিরামিডসদৃশ কাঠামোকে অবলম্বন করে নানাবিধ আপাত বৈধ ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এক অংশের টাকা, সম্পত্তি ও মূলধন বেহাত করে পাঠিয়ে দেয় উপরের দিকে। অনেক সময় তাই মারা যায় শ্রমিক ও কর্মচারীর পাওনা প্রভিডেন্ট ফান্ড। ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন ছোট জোগানদার ও লগ্নিকারীরা। অন্য দিকে, ফুলেফেঁপে ওঠেন কর্ণধার আর তাঁর পরিবার। নানান দেশের গোষ্ঠীবদ্ধ পরিবারভিত্তিক সংস্থার উপর নির্ভরযোগ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর, স্টক মার্কেটের নানা সময়ে তাঁদের সম্পর্কে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি, এবং পারিবারিক বার্ষিক হিসাবের খাতায় লিখিত লেনদেনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে যাচাই করার পর উদ্ভূত তথ্যপুঞ্জকে কম্পিউটারে ফেলে প্রভূত নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক পর্যালোচনা করেই বহু গবেষক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এঁদেরই এক প্রামাণ্য অংশ (সবাই অবশ্য নন, অনেক ব্যতিক্রমও নিশ্চয় আছেন) প্রায় “দিন দুপুরেই চুরি করেন, আর রাত্তিরে তো কথা নেই।” সেই কলঙ্ক গায়ে লাগলে, সংস্থা নির্দোষ হলেও শেয়ার মার্কেটের তাদের রক্তক্ষরণ সহজে থামে না।

ঠিক এই সময়েই ভারী ঋণের বোঝা গোদের উপর বিষফোড়ার সমান। কারণ, শেয়ার বাজারকে খুশি রাখতে তড়িঘড়ি শোধ করতে হচ্ছে অনেক বেশি ধার, যেটা তোলা হয়েছে গোষ্ঠীর শেয়ার ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখে। শেয়ার মূল্যের অবনমন ঘটলে ব্যাঙ্ক ঋণগ্রহীতার থেকে দাবি করে আরও বেশি কাঁচা টাকা বা সমমূল্যের কিছু জমা রাখার জন্য। তাই শিরে এই সংক্রান্তি নিয়ে আদানি গোষ্ঠী নিজেদেরই শেয়ার বিক্রি (রাজীব জৈনের জিকিউজি সংস্থা এই বিক্রীত শেয়ারের অন্যতম খরিদ্দার) করে প্রায় ৭৫০০ কোটি টাকা পাওনাদারদের ফেরত দিয়েছে তাদের কোম্পানির কাগজ চাঙ্গা রাখার জন্য।

এই মুহূর্তে আদানি গোষ্ঠীর হাতে ন্যস্ত মুম্বই সমেত দেশের সাতটি এয়ারপোর্ট, দখলে রয়েছে ভারতের শতকরা ২৪ ভাগ সামুদ্রিক কার্গো আর গোটা দশেক নৌবন্দর। আছে সিমেন্ট, সৌরশক্তি, ও পরিবেশবান্ধব শক্তিসমেত ভারত জুড়ে ছোট, বড়, মাঝারি মাপের প্রায় গোটা পঞ্চাশেক প্রকল্প। শেয়ার মার্কেটকে তোয়াজ করার জন্য অতিরিক্ত পুরনো ধার শোধ দেওয়ার প্রয়াসের বলি হতে চলেছে এই শিল্পের সামগ্রিক লগ্নি। ধুঁকবে তাই পরিকাঠামো ক্ষেত্ৰ, আর তার সঙ্গে ব্যাহত হবে সামগ্রিক অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। শেয়ার মার্কেটের এই ওঠা-নামার খেলায় গোষ্ঠীর মুখ হয়তো রক্ষা হবে কোনও ক্রমে, কপাল পুড়বে আম আদমির।

অন্য বিষয়গুলি:

Adani Group Business Gautam Adani
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy