—প্রতীকী ছবি।
মেয়েরা চুল আঁচড়ে চিরুনিতে আটকে থাকা চুলগুলো গোল্লা পাকিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন বা জানলা দিয়ে ছুড়ে দিচ্ছেন বাইরে— দৃশ্যটি খুবই পরিচিত। মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা গ্রামের মেয়েরাও তা-ই করতেন। কেউ কেউ তুকতাকে মাথার চুল ব্যবহার করা হয়— কুসংস্কারবশত এই ভয় ও ভাবনা থেকে ফেলার আগে চুলে থু-থু করে থুতু ছিটিয়ে দিয়ে ফেলতেন। কিন্তু এখন বেলডাঙা এবং আশেপাশের এলাকার মেয়েরা আঁচড়ানোর পর চুল ফেলে না দিয়ে যত্ন করে জমিয়ে রাখেন। আগে মাথা থেকে বেশি বেশি চুল ঝরলে চিন্তায় ঘুম আসত না তাঁদের। নারকেল তেলে মেথি, জবাপাতা, কেশুত পাতা দিয়ে সেই তেল চুলের গোড়ায় থুপে থুপে লাগাতেন। সর্ষের তেলের খোল, ভাগীরথীর কাদামাটি দিয়ে মাথা ঘষতেন। উদ্দেশ্য একটাই: চুল পড়া যেন বন্ধ হয়! একমাথা চুল নিয়ে কত গর্ব! কত রকমের বিনুনি! কত ধরনের খোঁপা! কিন্তু ২০০৫ সালের পর থেকে যত চুল ঝরল, নারীরা তা পলিথিনে ভরতে ভরতে হিসাব শুরু করলেন, আর কতটা চুল ঝরলে এক কিলোগ্রাম হবে! চুল নিয়ে তাঁদের আবেগটা হঠাৎ অন্য দিকে ঘুরে গেল কেন? কারণ, সুস্থ সবল এক কেজি চুলের দাম পাঁচ হাজার টাকা। দু’-তিন হাজার নয়! পাঁচ হাজার!
সেই সময় গ্রামের মহিলাদের নিজস্ব উপার্জন বলতে কিছু ছিল না। মুসলিম মেয়েদের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা এবং চাকরি ছিল আকাশের চাঁদের মতোই অধরা। পারিবারিক এবং ধর্মীয় বাধানিষেধের বেড়াজালে পিতা, স্বামী এবং পুত্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকাটাই যেন তাঁদের ভবিতব্য! অঙ্গনওয়াড়ি কথাটার তেমন প্রচলনও ছিল না। মেয়েরা আলাদা ভাবে সরকার থেকে সরাসরি সাহায্য পেতেন না। গৃহপালিত হাঁস-মুরগির ডিম বা মুড়ি ভেজে বড়লোক বাড়িতে গোপনে বিক্রি করে যে টাকা পেতেন, সেটুকুই ছিল তাঁদের নিজের অর্জিত অর্থ। ঘরের বৌরা বাজারে বসে ডিম বা মুড়ি বিক্রি করছেন— তখন এই ছবি বিরল। ঝরে পড়া চুল তখনও বিক্রি হত। কিন্তু বিনিময়ে তখন টাকাপয়সা পাওয়া যেত না। স্টিলের বাটি, চামচ, প্লাস্টিকের টিফিনবক্স মিলত।
গ্রামের কেউ এক জন মেদিনীপুর থেকে চুলের ব্যবসার আটঘাট জেনে এসে শুরু করেন চুলের ব্যবসা। ইস! শুনলেই গা-টা কেমন করে ওঠে! কিন্তু যখন শোনা যায় মুর্শিদাবাদ জেলার এক চুল ব্যবসায়ী চুল রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আমদানিতে তাক লাগিয়েছেন, পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার— তখন ব্যাপারটা আর ‘ইস’-এর পর্যায়ে থাকে না।
কলকাতা, বারাসত, বজবজ ইত্যাদি জায়গা থেকে ওই গুটলি পাকানো চুল মুর্শিদাবাদের নির্দিষ্ট গ্রামগুলোতে জড়ো করা হয়। গুনসুচ, কাঠি এবং আঙুলের সাহায্যে মেয়েরা চুলের জটিল জট ছাড়াতে বসেন। কাজটা ভীষণ কঠিন। কিন্তু যুগে যুগে কঠিন কাজগুলো মেয়েরাই বুদ্ধি আর দক্ষতা দিয়ে সরল করে নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রেও তাঁদের পারদর্শিতা উল্লেখযোগ্য। ঘরসংসার সামলে, এক কেজি চুলের জট ছাড়িয়ে তাঁরা দিনে দু’-তিনশো টাকা রোজগার করেন। জট ছাড়ানো চুলগুলো বাছাই হয়। আট ইঞ্চি চুল, বারো বা বাইশ ইঞ্চি... সব আলাদা আলাদা করে সাজায় কিশোর-কিশোরী বা আর একটু ছোটরা। স্কুল যাওয়ার আগে অথবা স্কুল ফেরতা কাজে লেগে পড়ে। কেজি প্রতি সত্তর বা আশি টাকা করে মজুরি পায় তারা। এর পরে অন্য শ্রমিকদের সাহায্যে চুলগুলো বিশেষ চিরুনির সাহায্যে সোজা করা হয়। তাঁদের পারিশ্রমিক আলাদা। তার পর শ্যাম্পু বা ডিটারজেন্ট দিয়ে চুল ধোয়া হয়। শুকানো হয়। পালিশ হয়। অবশেষে লাছি বাঁধা সেই চুল চিন অথবা মায়ানমার পাড়ি দেয়।
চুল এমন একটা জিনিস, যা ঝরতেই থাকবে। বিশেষত কেশবতীরা যত দিন পৃথিবীতে থাকবেন এই ব্যবসা চলতেই থাকবে। চুলের দৈর্ঘ্য আট ইঞ্চি হলেই পয়সা। চিনে পরচুলা হিসাবে ব্যবহৃত চুলগুচ্ছের অনেকটাই মুর্শিদাবাদ থেকে যায়।
কাজিসাহা, কাপাসডাঙা গ্রামে চুল ব্যবসায়ীদের ঘরবাড়ি, জীবনযাপন দেখলে অবাক হতে হয়। ওই ব্যবসা করেই ছেলেমেয়েদের ভাল স্কুল-কলেজে পড়াচ্ছেন। এক কালের চুল ব্যবসার শ্রমিকদের অনেকেই পরিশ্রম করে এখন মহাজন। ঝাঁ-চকচকে চুলের অফিস কিংবা চুল ব্যবসার কেন্দ্রগুলো এখন রীতিমতো চর্চার বিষয়। এলাকায় চুরিচামারি, অসামাজিক কাজকর্ম অনেক কমেছে। সাধারণ ঘরোয়া মুসলিম মেয়েদের হাতে অর্থ এসেছে। মনোবল বেড়েছে। মেয়েদের ফেলে দেওয়া বর্জ্য গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে।
এক কেজি সুস্থ সবল চুল ৫০০০ টাকা! ওই অঞ্চলের মুসলিম মেয়েদের মনের ঘরে এখন রোজ ইদ। প্রতি দিনই দীপাবলি। তাঁরা কুড়িয়ে আনা চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে মোবাইলে গান শোনেন— বড়লোকের বেটি লো লম্বা লম্বা চুল, এমন মাথায় বেঁধে দেব লাল গেন্দা ফুল।
তাঁরা এখন বড়লোকের বেটি নয়, বড়লোক বেটি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy