Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সমাজ থেকে লজ্জা উধাও হয়ে গিয়েছে বলেই দুর্নীতি বেপরোয়া
Corruption

আসুন, সেলফি তুলি

প্রশ্নটা শুনলেই ভয় করে, কারণ বিগত বেশ কিছু দিন বাংলা ছায়াছবির জগতে ছায়া ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে আর ভীতিপ্রদ হয়ে উঠছে সামগ্রিক ছবিটা।

picture of money.

এই পৃথিবীতে বিচার তথ্যের ভিত্তিতে হয়, সত্যের ভিত্তিতে নয়। প্রতীকী ছবি।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৩ ০৫:৫২
Share: Save:

রানি মুখোপাধ্যায়ের নতুন ছবি, মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’র ট্রেলার দেখেই কান্না ধরে রাখা সম্ভব নয়। কী ভাবে, দুই শিশু-সন্তানকে রাষ্ট্রের হাতে জমা করতে বাধ্য হওয়া এক নারী তার ভাষা কিংবা জাতিগত পরিচয়ের উপরে উঠে এক জন মায়ের লড়াই লড়েন, তা ওই ট্রেলারের তিন মিনিটেই পরিষ্কার। বাস্তবের সাগরিকার জীবনালেখ্য মূর্ত হয়ে উঠেছে রানির অভিনয়ে। ওই ট্রেলারের তলায় অজস্র মন্তব্য; তার মধ্যে বেশ কয়েকটি, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে মায়ের কোল খালি করে বাচ্চা কেড়ে নেওয়ার পিছনের মূল কারণ হিসেবে দর্শিয়েছে ফস্টার-হোমগুলোর রমরমা ব্যবসাকে। যে বিপুল অনুদান ওই হোমগুলি পায় তা বজায় রাখতেই কি প্রায় চল্লিশ হাজার অভিবাসী পরিবারের শিশুদের ভিন্ন সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে বাবা-মা’র কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেওয়ার এই নৃশংসতা? মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে সেই প্রশ্ন তুলে দিল।

গত দু’বছরের বেশি, তরুণ-তরুণী থেকে যন্ত্রণায় ভেটারান হয়ে ওঠা যে মুখগুলো নিজেদের মা, বাবা, পরিবারের থেকে দূরে কলকাতার রাস্তায় পড়ে আছে, কিংবা যে ছোট-ছোট বাচ্চারা, গান্ধীমূর্তির পাদদেশে পড়ে থাকা বাবা-মা’কে মিস করছে অহরহ, তাদের যন্ত্রণা নিয়েও কোনও সিনেমা হতে পারে কি? মেধার থেকে জীবিকাকে আলাদা রাখার পিছনেও তো কারও কারও রমরমা ব্যবসা চলছে। সেই সব ব্যবসা, যত দিন গেছে, দুই থেকে আট হয়েছে আর তার ভুক্তভোগী মানুষেরা নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্ব হয়েছে যত ক্ষণ না খরচ করার মতো নিঃশ্বাস কমে গিয়ে দীর্ঘশ্বাসেও টান পড়ে। হতে পারে না, ছায়াছবি, তাই নিয়ে?

প্রশ্নটা শুনলেই ভয় করে, কারণ বিগত বেশ কিছু দিন বাংলা ছায়াছবির জগতে ছায়া ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে আর ভীতিপ্রদ হয়ে উঠছে সামগ্রিক ছবিটা। এমন নয় যে, কুড়ি বছর আগের টালিগঞ্জ এলডোরাডো’র কথা মনে পড়িয়ে দিত। একটাই সেটে, একটাই ডেটে তিনটে সিনেমার শুটিং করতেন তখন স্বপন সাহার মতো কেউ কেউ এবং স্বগর্বে সেই ফর্মুলাকেই বাংলা ছবির বেঁচে থাকার একমাত্র বটিকা হিসেবে নিদান দিতেন খবরের কাগজের ইন্টারভিউতে। আউটডোর শুটিং হত দিঘা কিংবা মুকুটমণিপুর; প্রযোজকের পকেটের জোর থাকলে দার্জিলিং অথবা পুরী। নায়ক-নায়িকারা, হাতে গোনা ব্যতিক্রম বাদ দিলে, টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে বসেই মৃগেল কিংবা চারাপোনা দিয়ে সোনা মুখ করে লাঞ্চ সারতেন; বিকেলের জলখাবার ছিল মুড়ি আর বেগুনি; স্বাস্থ্যসচেতনরা তেলেভাজার বদলে, তখনও সুপারহিট না-হওয়া, কাঁচা বাদাম খেতেন। চিত্রনাট্যকার তথা সংলাপ-লেখক হিসেবে সেই সময় নিয়মিত স্টুডিয়োয় চক্কর কাটা কারও আজও মনে পড়ে, শুটিং শেষ হওয়ার দিন ফিস্টে ‘কচুবাটা’ চালু করেছিলেন এক কাঠবাঙাল পরিচালক; ইউনিটের ভিতরে থাকা ঘটিরা ‘পোস্তবাটা’ দাবি করেও হেরে যায়, কারণ কচুবাটা নাকি খাটাখাটনির পর গায়ের ব্যথা মারতে মোক্ষম দাওয়াই। আসল কারণ ছিল, বলা বাহুল্য, পোস্তর অতিরিক্ত দাম।

ইন্দ্রপুরী কিংবা টেকনিশিয়ান্স, স্টুডিয়োর ভিতরে অসংখ্য সারমেয় ঘুরে বেড়াত তখন। বাঙুর হাসপাতালে তিন দিন আগে জন্মানো শিশু চলে আসত, ষাট টাকার বিনিময়ে সদ্যোজাতর ভূমিকায় অভিনয় করবে বলে। অলক্ষ্মী তাঁর সব রকম চেহারায় দেখা দিতেন টালিগঞ্জের এ দিক কিংবা ও দিক, কিন্তু তাঁর আন্তরিকতাকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না।

তার পর, টাকা এল টালিগঞ্জে। কোত্থেকে এল, কেউ জানে না, কিন্তু এল। আর সেই টাকার তোড়ে ভেসে গেল পুরনো ধ্যানধারণা। তিন লাইন সংলাপ বলতে গিয়ে ছ’বার তোতলানো অভিনেতাও এসি ভ্যানে বসে প্রোটিন-শেক খাওয়ার রোয়াব দেখাতে শুরু করলেন; উইক-এন্ডের প্যাক-আপ’এর পরও কোনও দিন তাইল্যান্ডীয় কখনও বা লেবানিজ় অর্ডার হওয়া আরম্ভ হল; ফিল্মপাড়ার বহু পুরনো এক কর্মী জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “যেখানকার খাবার আসছে, সেই দেশগুলো কোথায়?”

উত্তরে, আজ কেউ বলতেই পারেন, সেই দেশগুলো ছড়িয়ে আছে, বলাগড়ের গঙ্গার ধারে কিংবা সায়েন্সসিটির পার্শ্ববর্তী চল্লিশ তলা অট্টালিকায়। কিন্তু সেই উত্তর অর্ধসত্য হবে। আসল উত্তরটা হল, সেই ‘দেশ’ একটা সিনড্রোম যা আমাদের শিরা-উপশিরায় কর্কট রোগের মতো ছড়িয়ে গেছে। আর সেই যাওয়া কেবল সিনেমার জগতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্বনামধন্য অধ্যাপক দুঃখ করছিলেন, কারণ পর দিন যাঁর সঙ্গে বসে তিনি ইন্টারভিউ নেবেন সেই ব্যক্তি বোর্ডে থাকলে পরে খোলাখুলি অর্থ দাবি করেন চাকরিপ্রার্থীদের কাছে।ভাবা যায় এটা? কিন্তু এ রকমও যে ঘটছে তা প্রতি মুহূর্তে শোনা যাচ্ছে, যেমন দেখা যাচ্ছে, সুবিধার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস করা লোকজন বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে। কুন্তল ঘোষ কিংবা শেখ শহিদ ইমাম অথবাশান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়দের সীমাহীন দুর্নীতি দেখে যারা আঁতকে উঠছি, তাদের আরও বেশি আঁতকে ওঠা উচিত সুবীরেশ ভট্টাচার্য কিংবা কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়দের জেলে থাকা নিয়ে।

অবসরপ্রাপ্ত এক অধ্যাপিকা বলছিলেন, গঙ্গাতীরবর্তী একটি কলেজের অধ্যক্ষের কথা, যিনি ইলিশের ব্যবসা করা দুই ছাত্রের থেকে পয়সা না দিয়েই মাছ নিয়ে নিতেন পদাধিকারবলে। সেই লোক যে উপাচার্য হয়ে পুকুরচুরি করবেন, তা তো জানা কথা। টিভির একটি অনুষ্ঠানে দেখা গেল শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত বলাগড়ের এক যুবনেত্রী সারা ক্ষণ চেঁচিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে গেলেন যে কুন্তল ঘোষের বাবা আগের জমানায় পঞ্চায়েত সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কয়েক লাখ টাকা তছরুপ করেছেন। অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়, তা বলাগড়ে গেলেই জানা যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কয়েক লাখ টাকা, অনেক কোটি টাকায় রূপান্তরিত হল কী করে? যে এ দিক-ও দিক দেখে দশ টাকা সরাত, সে অবলীলায় হাজার টাকা সরাতে শুরু করে দিল কার প্রশ্রয়ে? শাসক তথা প্রশাসকের দিকে আঙুল অবশ্যই উঠবে, কিন্তু একই সঙ্গে আঙুল আমাদের দিকেও থাকবে।

শুনতে খারাপ লাগলেও, সত্যিটা হল, বলাগড়ে অনেক দুর্গাপূজা ‘স্পনসর’ করত কুন্তল। সেই রকমই একটি পুজোর উদ্যোক্তার মুখে শোনা গেল যে, কুন্তলের থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে তিনি নরনারায়ণ সেবা করিয়েছেন নিজের পুজোয়। এলাকার সবাই জানত যে কুন্তল অন্যায় ভাবে টাকা তোলে, তবু এলাকার লোকই ভেঙে পড়ল কুন্তলের টাকায় ভোজ খেতে? ওই এক দিনের ভোজের বিনিময়ে ও যে ওর অনেক পাপ সাদা করে নিচ্ছে, সেই চেতাবনি উচ্চারণ করার মতো গাঁওবুড়া কিংবা শিশু উধাও হয়ে গেল সমাজ থেকে?

‘ফ্রি’তে শুধু খাওয়া নয়, বিনোদনের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল শান্তনু-কুন্তলরা। তাই ওদের প্রশ্রয়ে জলসার আয়োজন হত ঘনঘন। সেখানে আসত যারা, তাদেরই এক জন চল্লিশ লাখের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন যখন কিনা সাধারণ একটা বাংলা সিনেমার বাজেট অত হয় না।

ছোটবেলায় কে যেন এক বার বাড়ি এসে অভিযোগ করে গিয়েছিল যে, আমি তাদের গাছ থেকে কামরাঙা নিয়েছি কয়েকটা। সত্যাসত্য বিচার না করেই পিটিয়ে দুরমুশ করে দিয়েছিল মা। অবাক বিস্ময়ে দেখি, জেলে থাকা কুন্তলের থেকে কাঁড়ি টাকা পাওয়া ছেলেকে বাঁচাতে আসরে নেমে পড়েছেন প্রভাবশালী মা। টিভির আলোচনায় জনৈক পুলিশ অফিসার সেই ব্যাপারটা তুলে ধরে বলছেন, “মায়ের যুক্তিটাও শুনতে হবে”।

প্রশ্ন জাগে, পকেটে চল্লিশ হাজার টাকা ছিল বলে গত বছর যে তরতাজা যুবক অভীক মুখোপাধ্যায়কে পিটিয়ে মেরে দিল গুণ্ডারা বারুইপুরে সেই অভীকের মা কেন এফআইআর অবধি করাতে বাধা পেলেন? ছেলেকে লক-আপে পিটিয়ে মেরা ফেলা হয়েছে বলে যে দীপঙ্কর সাহার মা কেঁদে চলেছেন, তাঁর যুক্তিটাও শোনা হয়েছে কি?

উত্তর মিলবে না, বিচার মেলাও কঠিন, যে-হেতু এই পৃথিবীতে বিচার তথ্যের ভিত্তিতে হয়, সত্যের ভিত্তিতে নয়। আর সত্য হল এই যে, রসগোল্লাকে দুধে ফেলে রসমালাই করে দেওয়ার মতো করেই দুর্নীতিকে সামাজিক করে তোলা হয়েছে। নইলে এক জন মোবাইল মেকানিক কিংবা মাছবিক্রেতা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেলেও কোটিপতি হতে পারত না, সমাজের ছাঁকনিতে আটকে যেত।

এখন যে যায় না, তার কারণ, আরও অনেক কিছুর মতো লজ্জাও আপডেটেড হয়ে গেছে। এখন গাড়ি না থাকলে লজ্জা, সিঙ্গাপুর বা ব্যাঙ্কক-এ বেড়াতে না যেতে পারলে লজ্জা। বাবা-ছেলে-মা-বৌ-বর-জামাইবাবু কিংবা নিজেই, চাকরি বিক্রির দায়ে জেলে আছি, এটা লজ্জার কেন হতে যাবে?

আসুন, সেলফি তুলে উদ্‌যাপন করি।

অন্য বিষয়গুলি:

Corruption Tollywood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy