সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের অবস্থা অন্যান্য ব্যাঙ্কের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফাইল চিত্র।
সত্যজিৎ রায়ের মহানগর ছবিটিতে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সুব্রতর (অনিল চট্টোপাধ্যায় অভিনীত) সেই ব্যাঙ্ক ফেলের কথা মনে আছে? গত শতকের পঞ্চাশের দশক অবধি ভারতে অনেক ব্যাঙ্কে লাল বাতি জ্বলত। ইদানীং দেশে ব্যাঙ্ক ফেলের ঘটনা খুব একটা শোনা যায় না। কিন্তু পশ্চিমি দুনিয়ায় ব্যাঙ্ক বিপর্যয়ের ঘটনা মাঝেমধ্যেই শুনি। আমেরিকার বৃহত্তম ব্যাঙ্কের তালিকায় ১৬তম স্থানে থাকা সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক সম্প্রতি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। তার পরেই ক্রেডিট সুইস বলেছে যে, তাদের স্বাস্থ্যও খুব ভাল যাচ্ছে না।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের অসুস্থতা কি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এ বিষয়ে দু’টি মত বাজারে চলছে। প্রথমটি হল, সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের অবস্থা অন্যান্য ব্যাঙ্কের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এদের আমানতকারীরা আমজনতা নন। তাঁদের অনেকেই ব্যবসায়ী শ্রেণির লোক। কোনও ব্যাঙ্ক সুদ কম দিলে আমি হয়তো সেই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে যেখানে বেশি সুদ পাওয়া যায় সেখানে বিনিয়োগ করব না, কিন্তু ব্যবসায়ীরা করবেন মুনাফার জন্য। আমেরিকার শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারাল রিজ়ার্ভ সুদের হার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবসায়ী আমানতকারীরা অধৈর্য হয়ে সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক থেকে তাঁদের টাকা তুলে অন্য কোথাও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হলেন। প্রশ্ন হল, সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এই প্রবণতা রোধ করতে সুদের হার বাড়াল না কেন? কারণ, এই ব্যাঙ্কটি তাদের টাকার সিংহভাগ দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছিল, যাতে সুদের হার খুবই কম। বিনিয়োগকারীদের বেশি সুদ দেওয়া এই ব্যাঙ্কের পক্ষে তাই সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ, এদের সম্পদ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় কিছু মূলগত ত্রুটি ছিল। এই ব্যাঙ্কের আমানতগুলি যদি এত ব্যবসায়ী-কেন্দ্রিক না হত, আর ব্যাঙ্ক যদি সরকারি বন্ড ছাড়াও বেশি রিটার্নের বেসরকারি বন্ড আর মর্টগেজে টাকা লগ্নি করত, তবে হয়তো এত তাড়াতাড়ি পাততাড়ি গোটাতে হত না। পরিস্থিতিটি ২০০৮-এর লেম্যান ব্রাদার্স-এর সঙ্কটের সম্পূর্ণ উল্টো। তারা বিপুল ঝুঁকি নিয়ে প্রচুর মন্দ ঋণ দিয়েছিল। সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক বিপাকে পড়ল অতিসাবধানি হতে গিয়ে।
দ্বিতীয় মতটি হল, সিলিকন ভ্যালির ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়— এটি সম্ভবত ২০০৮-এর মতো একটি ভয়ানক ব্যাঙ্কিং বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। অর্থনীতিবিদ কেনেথ রোগফ একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধে লেখেন যে, ২০০৮ এবং ২০২৩-এর পরিস্থিতিতে বিপুল ফারাক থাকলেও দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তখন মূল্যবৃদ্ধি ছিল না, এখন সে সমস্যা বিপুল। বহু দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়াচ্ছে, ফলে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির উপর সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের মতোই চাপ তৈরি হচ্ছে। কোভিড-উত্তর দুনিয়ায় সরকারি অনুদানের পরিমাণ বাড়ায় বাজেটে ঘাটতিও বাড়ছে— সরকার সেই ঘাটতি পূরণ করতে ঋণ করছে, ফলে সুদের হার আরও বাড়ছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিঘ্নিত হয়েছে জোগান-শৃঙ্খল— তাতে বিপর্যস্ত অনেক ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায়ী ব্যাঙ্কের ধার শোধ করতে পারছেন না। সব মিলিয়ে ব্যাঙ্কগুলি কাঠামোগত সমস্যায় পড়েছে।
আমেরিকার ফেডারাল রিজ়ার্ভ এখন উভয়সঙ্কটে পড়েছে। মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে সুদের হার আরও ০.২৫ শতাংশ বাড়ল। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা যায় কি না, তা নিয়ে তর্ক আছে। তবে এই মুহূর্তে সুদের হার বাড়ানোতে ব্যাঙ্কগুলির ক্ষতির সম্ভাবনাটিকেও অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। আমেরিকাতে আমানতকারীদের টাকা ২৫০০০০ ডলার পর্যন্ত সরকারি বিমাতে সুরক্ষিত। বড় ব্যাঙ্কগুলি সরকারি অনেক নিয়মকানুন মেনে চলে। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যাঙ্কগুলির উপর সরকারের ততটা নিয়ন্ত্রণ নেই। তার ফলে মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যাঙ্কগুলির সম্পদ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অনেক সময় সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের মতো ত্রুটি থাকতেই পারে। সর্বোপরি, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে যদি বহু আমানতকারী এক সঙ্গে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নেন, সত্যিই ব্যাঙ্ক ফেল করতে পারে। অতএব, এই মুহূর্তে শীর্ষ ব্যাঙ্কের কর্তব্য আমানতকারীদের আশ্বস্ত করা আর অসুস্থ ব্যাঙ্কগুলিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
ভারতের ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির উপর কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আছে। ব্যাঙ্কগুলি তাদের সম্পত্তির প্রায় ১৮ শতাংশ নগদ হিসাবে তহবিলে জমা রাখে— যাকে বলে স্ট্যাটুটারি লিকুইডিটি রেশিয়ো— যাতে তাদের আমানতকারীরা চাইলেই টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে পারেন। ব্যাঙ্কগুলিকে বিনিয়োগে বেশি ঝুঁকি নিতে নিষেধ করা হয়। এ ছাড়াও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রচুর বিধিনিষেধ সব ব্যাঙ্ককেই মানতে হয়। তবুও ভারতীয় ব্যাঙ্কে অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আমানতকারীদের পাঁচ লক্ষ টাকা আমানত সরকারি বিমায় সুরক্ষিত, তবে সেই টাকা জোগাড় করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি তুলনায় স্থিতিশীল। তবুও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তব্য সুদের হার না বাড়িয়ে ব্যাঙ্কগুলির গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy