—প্রতীকী ছবি।
নিজের ছোট হয়ে যাওয়া জামা পরিয়ে, মালা গলায় দিয়ে, পাউডার মাখিয়ে বছর দুই-তিনেকের ভাইকে নিয়ে তখন জ্যান্ত পুতুলখেলার শখ। পুতুল তো ফ্রক দুলিয়ে পোজ় দিয়ে বেজায় খুশি, মায়েরও অফুরান উৎসাহ। এক দিন এমন সাজে ভাইকে নিয়ে বিকেলে বেড়াতে বেরোতেই পাড়ার এক কাকুর মুখোমুখি। অপরিসীম বিরক্তির সঙ্গে তিনি রায় দিলেন, ভাইকে ‘ছেলেদের মতো’ মানুষ করা হচ্ছে না, এর ফল ভুগতে হবে। আমার কোথায় লেগেছিল, জানি না। তার পরে ভাইকে আর কোনও দিন সাজাতে বসিনি।
আমানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এই স্মৃতিটা লাফিয়ে উঠল। আমান পল বছর তেইশের পুরুষ, ফ্যাশন মডেল। বছর দুই আগে কালো লেসের ‘স্টকিং’, হালকা বেগুনি রঙের বডিসুটের উপরে আঁটসাঁট, খাটো জ্যাকেটে তাঁর ছবি সবার নজর কেড়েছিল। নারী-পুরুষ বিভাজন ঘেঁটে দেওয়া পোশাকেই এখন সে পরিচিত। সে অবলীলায় বোঝায়, একটা মানুষের সামাজিক লিঙ্গ, এমনকি যৌনতা কোনও ভাবেই তার পোশাক বা আচরণকে নির্ধারণ করতে পারে না। ফ্যাশন এমন এক শিল্প-মাধ্যম, যা সেই ব্যক্তিগত অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করে। নিজেকে স্বতঃস্ফূর্ত ও সৎ ভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে এলজিবিটিকিউ/নন-বাইনারি মানুষের চেয়েও পুরুষদের বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বলে মনে হয়। রূপান্তরকামীরা নিজেদের সত্তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরে সমাজের হেনস্থাকে মোকাবিলা করার জোর এক রকম ভাবে খুঁজে নেন। কিন্তু যে পুরুষ নিজের লিঙ্গপরিচয়ে স্বচ্ছন্দ, তাতে পরিবর্তন কামনা করেন না, তাঁদের ‘পুরুষালি’ ভাবমূর্তিতে একটুও নড়চড় হলে এমন কিছু সংজ্ঞায় দেগে দেওয়া হতে পারে, যেগুলো মেনে নেওয়ার মতো মনের জোর সবার থাকে না। আমানের সে জোর ছিল বলেই দেশের প্রথম সারির ফ্যাশন পত্রিকার প্রচ্ছদ-মুখ থেকে জাতীয় স্তরের এক বিখ্যাত মেক-আপ ব্র্যান্ডের আয়োজিত ফ্যাশন শো-তে হাঁটার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তবে যাত্রাটা সহজ হয়নি। অজস্র মশকরার শিকার হয়েও সে পাফ-হাতা, পিচ-রঙা অর্গ্যানজ়া কুর্তি, বা হাই হিল জুতো পরা ছাড়েনি।
সম্প্রতি বাংলা ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে অভিনেতা সৌরভ দাস কাজল-লেপা চোখে, ডিজ়াইনার নীল সাহার তৈরি লম্বা স্কার্ট পরে রেড কার্পেটে হাঁটেন। ছড়াতে থাকে তাঁকে নিয়ে ট্রোল। সৌরভ ছেলেবেলায় বাবাকে দেখেছেন, নানা রকম নিরীক্ষা করে মায়ের শাড়ি গায়ে জড়াতে। তাঁর দেখাদেখি সৌরভও কোনও রকম প্রশ্ন ছাড়াই লিঙ্গভেদ বর্জিত সাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। এমন ‘অ্যান্ড্রোজিনাস’ পোশাকে বলিউডে এক সময়ে রণবীর সিংহের আধিপত্য ছিল। এখন প্রয়াত ইরফান খানের পুত্র বাবিল খান, অভিনেতা জিম সার্ভ, বিজয় বর্মাকে নিয়মিত দেখা যায় চুলের রং, নেল-পেন্ট, গয়নার সঙ্গে কাপড়ের গতিপ্রবাহকে মূর্ততা দিয়ে একঘেয়ে পুরুষালি পোশাকের ছক ভাঙতে। বিরাট কেপ, অফ শোল্ডার ব্লাউজ়, হাই হিল বুট, গোলাপ মোটিফের জ্যাকেট, লো-কাট করসেটে এ বছর গ্র্যামি, অস্কার, মেট গালা— রেড কার্পেট কাঁপিয়েছেন পুরুষ গায়ক, অভিনেতা, মডেলরা।
লাতিন শব্দ ‘অ্যান্ড্রোজিনি’ পুরুষ ও নারী উভয়ের বৈশিষ্ট্যকেই বহন করার কথা বলে। রং, মেক-আপ, গয়নার ক্ষেত্রে লিঙ্গ-চিহ্ন না থাকলেও সমস্যা হয় পোশাকের ক্ষেত্রে। সম উচ্চতার পুরুষ আর নারী শরীরের কাঁধের মাপ, কোমরের মাপ ও অবস্থান ভিন্ন হয়। ফলে একে অপরের পোশাক পরতে চাইলে মাপে গোলমাল হয়ে যায়। বাজারে প্রচলিত ‘ইউনিসেক্স’ পোশাকেরও বৈচিত্র টিশার্ট, শার্ট, জগার্স, বা ট্রাউজ়ারেই সীমাবদ্ধ। এখানেই প্রয়োজন পড়ে ‘জেন্ডার ফ্লুইড’ বা ‘অ্যান্ড্রোজিনাস’ পোশাকের। যেখানে পুরুষ দেহের জন্য তৈরি পোশাকে তথাকথিত নারীসুলভ পোশাকের অনেক উপাদান মিশে থাকে। এমনকি, বেশির ভাগ পোশাকে কাঁধ, বুক, কোমর নির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করার উপায়ও মুছে দেওয়া হয়। ফলে অনেক আরামদায়ক এবং ব্যবহারোপযোগী হয় তা সব লিঙ্গের মানুষের ক্ষেত্রেই।
কলকাতার ‘এনআইএফটি’-র টেক্সটাইল ডিজ়াইন বিভাগের শিক্ষিকা অহনা মজুমদার বলেন, কোভিড পর্বের পর লুজ় ফিট, আরামদায়ক, খোলামেলা পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। এখন প্রথম বর্ষ থেকেই পড়ুয়ারা নিজেদের স্টাইল, আচরণ, পছন্দ, প্রবণতা নিয়ে অনেক বেশি স্পষ্টবাদী। ছ’-সাত বছর আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। এর পিছনে রূপান্তরকামী আন্দোলনের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। সমাজের বাঁধা গতের বাইরে বেরোনোর ভাষা জোগাচ্ছেন রূপান্তরকামীরা।
ফ্যাশনের এই নতুন ঢেউ আপন করে নিচ্ছে নতুন প্রজন্ম বা জেন-জ়ি। নতুন, সাহসী, ‘অস্বাভাবিক’ কিছু পরীক্ষা করতে তারা অকুতোভয়। ‘স্ট্রিটওয়্যার’, ‘ওয়াই টু-কে’, ‘গথ’ নানা স্টাইলে ‘অ্যান্ড্রোজিনি’ প্রাধান্য পাচ্ছে। প্রচুর ফ্যাশন ব্র্যান্ড উঠে আসছে, যারা একাধারে শক্তিশালী, সাহসী, আবার নমনীয় এ ধরনের স্টাইলকে প্রাধান্য দিচ্ছে। গলায় নানা ধরনের চেন, পুঁতির মালা, কানে দুল, বোতাম খোলা প্রিন্টেড ঢোলা শার্ট, ব্যাগি প্যান্ট, পরিষ্কার করে কামানো দাড়ির চকচকে মুখ, গোলাপি ঠোঁট, লম্বা চুলের ছেলে দেখলেই তার লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ করার দিন গতপ্রায়। এই দৃশ্য যত বেশি দেখা যাবে, সমাজের বিচারধারা তত বদলাবে আশা করা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy