অম্লান দত্ত। —ফাইল চিত্র।
অম্লানকুসুম দত্তগুপ্ত। নামের থেকে ‘কুসুম’টি সরিয়ে আর পদবির ‘গুপ্ত’ গোপনে রেখে তিনি ছিলেন অম্লান দত্ত (ছবি)। ছোট থেকে বড় সকলের ‘অম্লানদা’। প্রথম যৌবনে তাঁকে এক জন প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি কী করেন?” উত্তরে অম্লান বলেছিলেন, “আমি চিন্তা করি।” ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দের মধ্যে যে বৃহৎ লক্ষ্যের উচ্চারণ অস্পষ্ট থাকে, ‘মনন’ বা ‘চিন্তন’ তাকে সামান্য জীবিকার সীমা অতিক্রম করায়।
অম্লান দত্তের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করার প্রধান তিন স্তম্ভ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ও বার্ট্রান্ড রাসেল। আরও দু’জনের কথা না বললেই নয়, যাঁরা তাঁর মনে সদাই সক্রিয় ছিলেন: কার্ল মার্ক্স ও মানবেন্দ্রনাথ রায়। তবে সাধারণ্যে তাঁকে সবাই ‘গান্ধীবাদী’ বলতে অভ্যস্ত। অবশ্য তাঁর লেখায় সবচেয়ে বেশি বার যে নাম উচ্চারিত হয়েছে তা হল রবীন্দ্রনাথ। তাই শেষ জীবনে তিনি একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, গান্ধীর কিছু মতবাদ তাঁকে গভীর ভাবে আলোড়িত করলেও কেন তিনি সর্বাংশে গান্ধীবাদী নন। গান্ধীর শিক্ষা চিন্তা, পল্লি-সংগঠন এবং সর্বোপরি জীবনধারণে অত্যাবশ্যক বস্তুর অতিরিক্ত বিলাস-বাহুল্য ত্যাগের মহান আদর্শ তিনি নিজের জীবনে আমৃত্যু অনুশীলন করেছেন, যার তুলনা সহজে মেলে না। মাকড়সার জালের ডিজ়াইনের একটা পাঞ্জাবি পরতেন— ছেঁড়া সেলাই করতে করতে ডিজ়াইনটির সৃষ্টি হয়েছিল।
চিন্তার জগতে তিনি ছিলেন একলা পথিক। ব্যক্তিগত জীবনেও দীর্ঘ সময় একা কাটিয়েছেন। মৃত্যুকালেও। বাড়িতে ঢোকার দরজার ছিটকিনি খুলে রেখে মৃত্যুশয্যায় গিয়ে শুয়েছেন, যাতে অন্যদের দরজা ভাঙার পরিশ্রমটুকু করতে না হয়। তবে এই একাকিত্ব কিন্তু হতাশায় দীর্ণ-জীর্ণ নয়। তিনি নিজেই বলেছেন, “আমি স্বভাবের দিক থেকেই অনেকটা একক মানুষ।” এখানে তিনি রাসেলের কাছাকাছি, যে রাসেল সাধকের মতো সংশয় থেকে শুরু করে আনন্দে পৌঁছতে চেয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত করুণাকে তাঁর পথ ও পাথেয় বলে গ্রহণ করলেন। অম্লানের ভাষায় যার প্রতিশব্দ ‘ভালবাসা’।
অম্লান প্রথম থেকেই যুক্তিবাদী। তবে যুক্তি-ঊর্ধ্ব মানুষদের কিছু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি ও উপলব্ধি ছিল তাঁর চিন্তার আর একটি বিশেষ ক্ষেত্র। প্রধানত অর্থনীতির অধ্যাপক এবং পরবর্তী কালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও অন্যান্য প্রশাসনিক দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি যে সব প্রবন্ধ লিখেছেন তা শুধু অর্থনীতি বা শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, সংস্কৃতি, বিপ্লব, নারীমুক্তি, এই সবের পর্যালোচনা করে যে বিকল্প সমাজের স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন তার গুরুত্ব বোধ হয় এই পণ্যসর্বস্ব, সাম্প্রদায়িক হিংসায় আচ্ছন্ন সময়ে নিতান্তই জরুরি।
সমাজ-দার্শনিক অম্লান দত্ত সাম্যবাদ ও গণতন্ত্রকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিকতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিপদকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ ফর ডেমোক্র্যাসি— যা পড়ে আইনস্টাইন ও রাসেল তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন, সেই বইতে যে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছিলেন, বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে নিজেই তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাঁর জন্মশতবর্ষে, এই একুশ শতকের গোড়ায় সেই প্রচেষ্টা আরও বেশি কৌতূহলী ও তীক্ষ্ণধী হয়েছে।
সারা জীবন ধরে তাঁর প্রধান জিজ্ঞাসাটি ছিল: মুক্ত সমাজে পৌঁছনোর পথ কী? এমনকি শেষ জীবনে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থের নামকরণও করেছিলেন মুক্তি তোরে পেতেই হবে। তিনি বলছেন, “ভারতের একটা ঐক্য আছে, সেটা কিন্তু মূলত সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় নয়।” তার পরেই বলছেন, “বিকেন্দ্রীকরণ ও মৌল বা ‘তৃণমূল’ স্বায়ত্তশাসনের ভিতর দিয়েই এই বৈচিত্র্যবিধৃত ঐক্য রক্ষা করা সম্ভব।” ক্ষমতার উন্মাদনায় এবং যূথবদ্ধ স্বার্থের আকর্ষণে জাতীয়তাবাদ যখন নিম্নস্তরে নেমে আসে, তখন দেশপ্রেমের নামে জন্মলাভ করে অসহিষ্ণুতা— এই সতর্কবাণী করেছিলেন নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে। চার দিকে এখন তার ভয়াল চিত্র।
তাঁর নির্ধারিত বিকল্প সমাজে “সারা ভারতীয় উপমহাদেশ নিয়ে একটি পরিসংঘ বা সম্মিলিত রাষ্ট্র গড়ে উঠবে, সমগ্র উপমহাদেশের জন্য সৈন্যবাহিনী থাকবে শুধু একটি, অধিকাংশ গঠনমূলক কাজের দায়িত্ব থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলির হাতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিকেন্দ্রিত হবে যথাসম্ভব।” এ চিত্র আপাত-অবাস্তব মনে হলেও তিনি বিশ্ব-ইতিহাসের দলিল থেকে দেখিয়ে দিয়েছেন অনেক ‘অবাস্তব’ সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণতি লাভ করেছে। আসলে মনের মধ্যে লালন করতে হবে একটি দূরের লক্ষ্য। সব সময় খেয়াল রাখতে হবে যে পথে হাঁটছি তাতে আমরা শান্তি আর ঐক্যের লক্ষ্যের দিকেই চলেছি তো?
বর্তমান সমাজকে ভেঙেচুরে নয়, এই ব্যবস্থার ভিতর থেকেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিকল্প সমাজ গঠনের কাজ করতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই সে পথ যাবে অহিংসার হাত ধরে ও ভালবাসাকেই মুক্তির মন্ত্র জেনে। সেই ভালবাসায় মিশে থাকবে একটুখানি অনাসক্তি— যেমন ভাবে আমরা সূর্যাস্তের রঙের উদ্ভাসে উজ্জীবিত হয়ে উঠি, কিন্তু তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই না।
একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে ‘সোনার তরী’ কবিতার বিশ্লেষণে অম্লান লিখেছিলেন, “দেবার জন্য বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখি কতই না ধন। ...দিতে পারলে তবেই আমাদের মুক্তি। ...নিতে জানা কি সহজ? যে নিতে জানে তাকে দিতে পারা তো অপার আনন্দের কথা। সোনার তরী না এলে কবির সব সঞ্চয় পড়ে থাকতো, যেন স্তূপীকৃত অসার্থকতা।” আজকের দ্রুত প্রসারিত ভোগবাদের জীবনে কেউ কি আছেন, এই মনস্বীর মননের ফসল দু’হাতে গ্রহণ করতে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy