—প্রতীকী ছবি।
কাজী নজরুল ইসলামের উৎসাহব্যঞ্জক বীররসাত্মক ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির সুরের বিকৃতি ঘটানোর জন্য সঙ্গত কারণেই সমাজমাধ্যম উত্তাল। সমাজমাধ্যমের বাইরেও প্রতিবাদের নানা রূপ চোখে পড়ছে। এই সব প্রতিবাদের আবর্তে নজরুল ও নজরুলের গানটিই মুখ্য হয়ে উঠছে। খেয়াল থাকছে না এই গানটি পিপ্পা ছায়াছবির অংশ আর অন্যান্য যুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্রের মতোই জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে এক বিশেষ রাজনীতির এটি শিকার। সেই ‘রাজনীতি’র চরিত্র কী, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে সাধারণ বাঙালির তা খেয়াল করা উচিত।
ইদানীং যুদ্ধবিষয়ক ছবির খুবই ‘রমরমা’। সেগুলি আলাদা করে সিনেমা হলে যেমন মুক্তি পাচ্ছে, তেমনই বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও। এই যুদ্ধছবিগুলিতে কতকগুলি উপকরণ থাকেই থাকে। ভারতের বাইরে একটি শত্রুদেশ প্রয়োজন। শত্রুদেশটি সাধারণত পাকিস্তান ও সেই সূত্রে নানা ‘ইসলামি’ জঙ্গি সংগঠনের আন্তর্জাতিক রোমহর্ষক নেটওয়ার্ক তুলে ধরা হয়। সেই নেটওয়ার্কের সূত্রে চিন, মায়ানমার ও পশ্চিম এশিয়ার উল্লেখও দরকারমতো আসে। এ-সবের জন্য কখনও ব্যবহৃত হয় আসল যুদ্ধের অতীত, কখনও কাল্পনিক যুদ্ধের ‘গোপন প্রেক্ষাপট’। মূলত হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদকেই উস্কে তোলা উদ্দেশ্য, তবে ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকার জন্য ‘ভাল-ভারতীয়’ মুসলমান চরিত্রও একটা দুটো থাকে। তবে যুদ্ধ ও শত্রুতা জিইয়ে রাখা ‘মাস্ট’ ও ‘মস্ত’।
এই প্রকল্পের মধ্যে আরও কতকগুলি ভাগ চোখে পড়ছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় অতীতের যুদ্ধকে ছবির বিষয় করার সময় ‘কংগ্রেসি’ ও ‘অ-কংগ্রেসি’ ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ভূমিকাকে কী ভাবে দেখানো হবে— তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক বাস্তবে ‘অতীত কংগ্রেসি জমানা’র যাবতীয় দোষ প্রকাশ্যে আনার ও কংগ্রেসি কৃতিত্ব, নাম, প্রতিষ্ঠানকে মুছে ফেলার প্রবল প্রচেষ্টা। বিপরীতে স্বাভাবিক ভাবেই কংগ্রেসি অতীতের উপযোগিতা দেখানোর ও বলার প্রয়াস তুঙ্গে। এই যুদ্ধবাদী ছবিগুলিতে কখনও কখনও ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অস্ত্র নির্মাণের মহিমময় গল্প ও সেই নির্মাণকার্যে কেন্দ্রের অ-কংগ্রেসি নেতৃত্বের ভূমিকার কথাও উঠে আসে। আসে গোপন গোয়েন্দাবাহিনীর নানা আখ্যান। সবই দেশপ্রেম জাগানিয়া। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাধ্যমতো নানাপক্ষাবলম্বীরা বিনোদনের বাজারে এই দেশপ্রেমের রাজনীতিকে নানা ভাবে নানা মাত্রায় কাজে লাগাচ্ছেন।
নজরুলের বীররসাত্মক গানটি যে সিনেমায় ব্যবহৃত, সেই পিপ্পা সিনেমাটি ভারতীয় ফৌজের ক্যাপ্টেন বলরাম মেহতার আত্মকথা অবলম্বনে নির্মিত, এই সময়ের রাজনীতির কথা মাথায় রেখেই যে তার নির্মাণ, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম যখন এই ছবির বিষয়, তখন সেখানে বাঙালিদের ভূমিকা তো থাকবেই, অন্তত থাকার কথা। ছবিটি অবশ্য বাঙালির ভূমিকা নিয়ে মাথা ঘামানোয় নারাজ। ছবির মূল উদ্দেশ্য ‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার’ ও তাঁর অধীন দিল্লি কী ভাবে শত্রু পাকিস্তান আর তাদের সহায়ক ‘আমেরিকা’কে রুখে দিয়ে রুশ ট্যাঙ্কের সহায়তায় কৌশলে আন্তর্জাতিক মত নিজেদের পক্ষে রেখে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করল, সেটা তুলে ধরা। তা দেখাতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি শরণার্থীদের দৃশ্য এসেছে, তাঁদের উপর পাকিস্তানি সেনার আঘাতের ছবি এসেছে, পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির দৃশ্যও এসেছে। তবে সেগুলি নিতান্ত মূল উদ্দেশ্যের এলেবেলে উপকরণ।
আর এর বাইরে দিল্লিতে এক বাঙালি ডাক্তার-অধ্যাপক বাবা ও তাঁর ছেলের প্রসঙ্গ রয়েছে। পরে জানা যাচ্ছে এই সুপুত্র বাঙালিটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী। তার কাজ শত্রু পাকিস্তানের গোপন খবর ‘ডিকোড’ করা। সে কাজে বাবার ছাত্রীকে, বাবাকে নিয়ে রঙ্গ-করা সেনা-পরিবারের মেয়েটিকে সে শামিল করে নেয়। সেই মেয়েটিরই দুই ভাই এ-ছবির নায়ক— এক জন শত্রুর হাতে ধরা পড়েও অত্যাচারিত হয়ে শৌর্য প্রদর্শন করে; আর এক জন অদ্বিতীয়। এ নায়কত্ব দান পুরোটাই কেন্দ্রীয় শক্তি হিসাবে ‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার’ ও দিল্লির কর্তাদের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। এই নায়কদের পাশে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বহীন সহায়ক অনুচর, দেখলে মনে হবে অনুচরেরও অধম। তারা কেবল শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানের বেচারা শিকার। তাদের যত নিষ্ক্রিয় পরাভূত বেচারা হিসাবে দেখানো হবে, তত শত্রু পাকিস্তানের প্রতি ক্রোধ বৃদ্ধি পাবে। ততই দিল্লির সহায়তার ছবি প্রবল থেকে প্রবলতর ও অনিবার্য হবে। তাদের এই মর্মান্তিক দুঃখে দিল্লি-নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় সেনারা বিগলিত হবে করুণায়। আবার ঠিকমতো বন্দুক চালাতে পারছে না দেখে ‘কী এমন কঠিন কাজ’ বলে মুক্তিযোদ্ধাদের বকুনিও দেবে। এই করুণার উদ্দীপক, বকুনি-খাওয়া ছায়াসহচর বাঙালির গান হিসাবে এখানে নজরুলের গানটি ব্যবহার করা হয়েছেমাত্র— অন্য সুরে গাওয়া হয়েছে অর্থহীন ভাবে।
যে গান বীরত্বের উদ্দীপনার, সেই গান এখানে নিতান্ত কোমলতামাখা আমোদের বাউলগীতি যেন। গানের কথাগুলি অর্থহীন হয়ে উঠেছে, কারণ গায়ক ভুল জায়গায় থামছেন, ভুল জায়গায় শ্বাসাঘাত দিয়েছেন। এটাও বোঝার উপায় নেই যে, অত্যাচার ও যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে কেন এমন নাচ-গানে মেতে উঠছে অত্যাচারিত বাঙালি। এই ছবিতে নিতান্ত বেচারা-উপকরণ হিসাবে তাদের থাকতে হবে বলেই? আর এখানেই একটা প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পরিস্থিতি সহসা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের সময় যে বাঙালি সরব-সক্রিয় হয়েছিল, সেই পথেই মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। নিতান্ত বাইরের সাহায্যের কথা ভেবে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সরব হয়নি। অত্যাচারিত মানুষ জেগে উঠেছিলেন— শৌর্যে, বীরত্বে। ইংরেজ জমানায় ঔপনিবেশিক প্রভুরা মার্শাল আর নন-মার্শাল এই দুই ভাগে ভারতীয় জনগোষ্ঠীগুলিকে ভাগ করেছিল। তাতে বাঙালি নন-মার্শাল। দেশ স্বাধীন হল, ক্ষমতার মনে থেকে গেল ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার— দিল্লির কাছে বাঙালি নন-মার্শাল, পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পূর্ব পাকিস্তান নন-মার্শাল। বাঙালি যুদ্ধ করতে পারে না। তাদের কাউকে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে জায়গা দেওয়া যেতে পারে মাত্র, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে তারা নিতান্তই বীরত্ব দেখানোর উপকরণ। হয় তারা বেচারা, নইলে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সাদামাটা অনুচর।
যদিও এই স্টিরিয়োটাইপ ভেঙে দেওয়ার মতো উদাহরণ বাঙালির মধ্যে আছে, কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। নজরুল উদ্দীপিত মানুষ, যুদ্ধে যাওয়া কবি। তাঁর গানটি সশস্ত্র বাঙালি বিপ্লবীদের উদ্দীপিত করত। বাঙালির মধ্য থেকেই লড়াকু সুভাষের উত্থান, মাস্টারদার লড়াই। এ-সব তথ্য নিয়ে মাথা ঘামালে এখনকার যুদ্ধ-যুদ্ধ ছবিতে দিল্লির একবগ্গা একক লৌহদৃঢ় নেতৃত্বকে বড় করে তোলার রাজনীতিটি মার খাবে। তা তো হতে দেওয়া যায় না। এখানেই ভয় জেগে ওঠে। এ ভয় নজরুলের গানের সুরের বিকৃতির সাংস্কৃতিক অপচয়ের চেয়েও বিপজ্জনক ভয়। বিকৃত সুরে গাওয়া গানটিকে আপনি না-ও শুনতে পারেন, প্রতিবাদ করতে পারেন। কিন্তু আপনার অগোচরে আপনি যে কী ভাবে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থার সামান্য উপকরণ হয়ে উঠছেন, অথবা সেই এককেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে কায়েম করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠছেন, তা যদি বুঝতেও পারেন তবুও সেটাকে আটকানো কঠিন। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আদর্শগত ভাবে প্রতিটি প্রদেশের মানুষের স্বাতন্ত্র্যকে সশ্রদ্ধ ভাবে রক্ষা করতে চায়। সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটে তখনই, যখন একমাত্রিক কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি অনুরক্তি দাবি করা হয়। সেই একমাত্রিক লৌহদৃঢ় কেন্দ্রীয় শক্তিই যে আমাদের মুক্তির উপায়, তা যুদ্ধ-যুদ্ধ ছবিগুলি প্রচার করতে চাইছে। তারা বলতে চাইছে কেন্দ্রীয় শক্তি সর্বময়, বাকিরা নিতান্ত উপকরণ।
এই প্রবণতা থেকেই নজরুলের গান অকারণ দৃশ্যের উপকরণ হয়ে উঠছে। বাঙালি নজরুলের গান নিয়ে প্রতিবাদ করছে। আবার বাঙালিই কিন্তু এককেন্দ্রিকতার পথে অগ্রসর হয়ে বঙ্গদেশে প্রবল-রাম প্রবল-হনুমান মূর্তি ও সংস্কৃতি আনতে চাইছে। কখনও বা অন্য প্রদেশের মানুষের প্রতি ‘বুদ্ধিমান’ বাঙালি প্রয়োগ করছে কোনও স্টিরিয়োটাইপ। বাঙালি কোন পথে হাঁটবে তা হলে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy