এমনও হয়? গাছের ডালে ঝুলছে পার্টি, ঘরের চালে ঝুলছে পার্টি, এই-ওই-সেই পার্টির পতাকা। দেওয়াল থেকে গোয়াল— সর্বত্র নানা পার্টির নাম-ডাক। দল আছে, হয়তো দলের বলও আছে, তবু দলাদলির চেয়ে লোকে গলাগলিকেই ধর্ম মানে। বুড়ো মাধব পুরনো পার্টির সমর্থক, যুবক পুত্র যাদব আবার ভোটের আগে নতুন পার্টির কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। গাঁ-তুতো ভাই সাদাব আবার আর এক পার্টির নাম গায়। কিন্তু, কেউ কাউকে ভয় দেখায় না, মারে না, পুলিশ কেসে ফাঁসায় না।
হ্যাঁ হয়। বিশ্বাস না হলে, ঘুরে আসুন পার্টিময় বাংলা ছাড়িয়ে সামান্য দূরের দুটো গ্রামে, দক্ষিণ চণ্ডীপুর ও মিনাপুর। কলকাতা, ডানকুনি পেরিয়ে, ধনিয়াখালির পর গুড়াপ-কালনা রোড ধরে, ধাত্রীগ্রাম, সমুদ্রগড় থেকে একটু এগিয়ে ধরে নিন নবদ্বীপের পথ। সারা পথের দক্ষিণে বামে বাংলার একান্ত অদম্য হরিৎ। সে সবুজের আবার কত বাহার, গাঢ় সবুজে ঢাকা আলুর মাঠ, সদ্য পোঁতা সবুজ হারিয়ে হলুদ ধানচারা আবার প্রাণভরে সবুজ হয়ে উঠছে। মধ্যে মধ্যে পটলের মাচা, কুমড়ো-শশার ভুঁই। ক্রমে ফসল বদলায়, আলু, ধানের জায়গা নেয় ঘন পাতায় ছাওয়া পেয়ারার বাগিচা, কলার বাগান, ইতস্তত আখের জমি— এ রাজ্যে বিরল হতে চলা ফসলটির মরতে না চাওয়ার জিদ। দূরে তরুশ্রেণি ও আকাশ মিলে গিয়েছে একটি রেখায়, সেখানে বসত। ধান রুইছেন সাঁওতাল, বাগদি, এবং অন্য শ্রমজীবী বাড়ির মেয়ে-মজুররা। কোনও কোনও মাঠে মাটি থেকে আলু তুলে বস্তায় ভরছেন মেয়েরা। পুরুষরা কেউ সার ছড়াচ্ছেন, কারও কাঁধে কোদাল, কারও ঘাড়ে কীটনাশকের ড্রাম (স্প্রে করছেন মুখোশ-দস্তানার মতো জরুরি সুরক্ষা উপকরণ ছাড়াই, তার ব্যবহারে কোনও দফতর বা দল উদ্যোগ করেছে বলে মনে হয় না)।
পথেই পড়বে নিমতলা বাজার, সেখান থেকে বাঁ দিকে বিছানো সরু পাকা রাস্তা। গ্রাম ছাড়িয়ে গ্রাম। সবুজ ছাড়িয়ে সবুজ। তার পর পাবেন দক্ষিণ চণ্ডীপুর, তারও পরে মিনাপুর। কতক ইটের দেওয়াল, টিনের ছাদ দেওয়া সরকারি প্রকল্পে পাওয়া বাড়ি। কারও কারও পুরাতন মাটির বাড়ি। দক্ষিণ চণ্ডীপুর ছোট গ্রাম, শতখানেক ঘর। তার শতকরা আশি ভাগ বাগদি জাতির, বাকি অংশ সাঁওতাল। পাঠক জানেন, এ রাজ্যে, এই দুই সম্প্রদায়ই পরম্পরাগত বঞ্চনার শিকার, রাজ্যের গড় হিসেব অনুযায়ী, এঁদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার যেমন সঙ্কুচিত, তেমনই জীবিকার জন্য দিনমজুরির উপর নির্ভরশীলতাও অনেক বেশি। এখানেও বাগদি ও সাঁওতালদের সংসার চলে দিনমজুরি করে। “জমি-জায়গা নেই, খেটে খাই। আজকাল আবার খাটবার কাজও কম। তাই ছেলেপুলেরা বাইরে কাজ করতে চলে যাচ্ছে,” বললেন বর্ষীয়ান আশালতা চেয়ার। কিন্তু এই গ্রামে সাক্ষরতার হার তুলনামূলক ভাবে ভাল। প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে চার জনই সাক্ষর। স্কুলে ভর্তি-না-হওয়া শিশু নেই, স্কুলছুট নেই। অবশ্য, উচ্চতর শিক্ষার টান বেড়েছে কিছু দিন মাত্র, আগে অধিকাংশ ছেলে মেয়েকেই প্রাথমিক বা তার আগেই পাঠ সাঙ্গ করতে হত। শিক্ষার টানের একটা কারণ বোধ হয় জমি-জায়গা না থাকলেও গ্রামে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে একটা প্রাইমারি স্কুল আছে। আর গত কয়েক বছর ধরে সেই স্কুলকে ঘিরেই গ্রামের বদল। সেই বদলে সব ঘরে শৌচালয়। আর তার চেয়ে বড় কথা, বিয়ে পরে, লেখাপড়া আগে। পার্টি পরে, গ্রাম আগে।
“রাস্তাটা দেখিয়েছিল মিনাপুরের শিক্ষক প্রসেনজিৎ-দা। ওর দেখাদেখি আমরাও এখানে স্কুলটাকে গড়ে তুলছি। দাদা, আমরা কেউ নই, কিছু নই, আসল কাজটা হল স্কুলের সঙ্গে গ্রামবাসীর আস্থার সম্পর্ক। সেইটা দানা বাঁধলে কোনও বাধাই বাধা নয়,” এখানকার শিক্ষক বিশ্বজিৎ আইচের গলায় অখণ্ড প্রত্যয়। সেই আত্মবিশ্বাসে, দরিদ্র বঞ্চিত মানুষের দুঃস্বপ্ন লকডাউনের কালেও এ গ্রামে, এবং মিনাপুরে, লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়নি। “স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে, কিন্তু পাড়া তো আছে; স্মার্ট ফোন নেই, কিন্তু মায়েরা আছেন, হাই স্কুলে পড়া ছাত্র-ছাত্রীরা আছে, গ্রামের বাল্যবিবাহ রোধের কমিটি আছে। তা ছাড়া অঞ্চলের প্রাইভেট টিউটররা আমাদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলেছেন,” বললেন, মিনাপুরের শিক্ষক প্রসেনজিৎ সরকার। (স্কুলে লেখাপড়া যত ভালই হোক, রাজ্যের সর্বত্র প্রাইভেট টিউশনি মানুষের রক্তে বাসা বেঁধে ফেলেছে, তাকে দূর করার লড়াই দীর্ঘ, সুকঠিন।)
দুই গ্রামেই স্কুলগুলোকে দেখে মনে হল না, লকডাউনে বন্ধ ছিল। “বাচ্চাদের আসা বারণ, তাই তাদের পাড়ায় এখানে সেখানে বসাই। কিন্তু মাস্টারমশাইরা প্রতি দিন কেউ না কেউ আসবেনই। তাঁরা নিজেরা পড়ান, আবার আমাদের বলে দেন, কী ভাবে পড়াতে হবে। আর আমরা সবাই মিলে স্কুল পরিষ্কার রাখি, আমাদেরই তো জিনিস,” বললেন মিনাপুরের খাদিজা শেখ।
মিনাপুরে শিক্ষার প্রসার তুলনায় কম, একটা কারণ দেরিতে স্কুল হওয়া। যদিও বড় গ্রাম, এখানে স্কুলের প্রতিষ্ঠা ১৯৬০ সালে। তার সঙ্গে ছিল অবহেলা। ওয়াকিবহাল মানুষ মাত্রেই জানেন, মুসলমান-বাগদি-সাঁওতালের লেখাপড়া হতে পারে, এখনও অন্যে কা কথা, বহু শিক্ষকই বিশ্বাস করতে পারেন না। অথচ, সেটাতে বদল আনতে পারেন শিক্ষকরাই। যেমন এনেছেন প্রসেনজিৎ ও তাঁর সহকর্মীরা। “সতেরো বছরে এই মাস্টার শুধু স্কুলের না, গাঁয়ের চেহারাই বদলে দিয়েছে,” হাসতে হাসতে বললেন তনুজা বিবি।
কাজটা তো সহজ ছিল না। মিনাপুর তুলনায় বড় গ্রাম, প্রায় চারশো সংসার। তার বেশির ভাগ মুসলমান, কিছু সাঁওতাল। দুই সম্প্রদায়ই খেটে খাওয়া, সাঁওতালরা প্রধানত খেতমজুর, মুসলমানরা জরির কাজ, জিনিস ফেরি, লোহালক্কড়-টিন-কাগজ কিনে বাজারে বিক্রি করার মতো নানান উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। উভয় সম্প্রদায়েরই কারও কারও আবার পেট ভরাবার আহারটুকুও সব সময় জোটে না। দক্ষিণ চণ্ডীপুরের মতোই এখান থেকেও ইদানীং ছেলেপুলেরা বাইরে কাজ করতে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার পুরো সংসার নিয়ে বাইরে যাচ্ছে, তাতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে বাচ্চাদের পড়াশুনোর। স্কুলকে স্কুলের মতো করতে গেলে বাচ্চাদের স্কুলে রাখতে হবে। তাই চেষ্টাচরিত্র করে সরকারের কাছ থেকে অর্থবরাদ্দের ব্যবস্থা হয়েছে, এ রাজ্যে এই প্রথম প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য হস্টেল খোলার ব্যবস্থা। মায়েদের ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে স্কুলের ছাদে গড়ে উঠছে সব্জি বাগান, সেই সঙ্গে হাঁস-মুরগি-মাছের কম্পোজ়িট ফার্মিং। “স্কুলেরও উন্নতি, আমাদেরও লাভ,” বললেন সোনালি খাতুন। সোনালি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সচিব, বাবলি খাতুন সভানেত্রী। বড়সড় তাঁদের দল। “লেখাপড়া যেমন বাড়াতে হবে, তেমনই মেয়েদের কাজের ব্যবস্থাও করতে হবে, তবেই কমবয়সে বিয়ে বন্ধ হবে,” এমনটাই মনে করেন তাঁরা। আর সেই উদ্দেশ্য নিয়ে চলছে মেয়েদের মশলা, স্যানিটারি ন্যাপকিন, পুতুল তৈরির মতো নানা প্রশিক্ষণ। যে রাজ্যে বিয়াল্লিশ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় বাল্যাবস্থায়, সেখানে, মিনাপুর বা দক্ষিণ চণ্ডীপুরের মেয়েদের এই উদ্যোগই রাজ্যবাসীর ভরসা। শুধু তা-ই নয়, স্কুলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই গ্রামসমাজ দায়িত্ব নিয়েছে হাবিবুলের মতো অনাথ বা মা-বাবা থেকেও নেই, এমন মেয়ে সুহানার।
মিনাপুর বা দক্ষিণ চণ্ডীপুর কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। রাজ্য জুড়ে দলাদলির হিংস্র, বীভৎস হুঙ্কার বেড়ে চলেছে, সে কথা কারও জানতে বাকি নেই, কারণ সেগুলোই রোজকার ‘তাজা খবর’। কিন্তু পাঠক কান পাতলেই সেই হুঙ্কার ভেদ করে শুনতে পাবেন এ রাজ্যেরই নানা প্রান্তে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্ভাষণ। ‘শিক্ষা আলোচনা’ নামক শিক্ষকদের একটি মঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগের সুবাদে খবর পাই, কী ভাবে লকডাউন, আমপান ও পার্টিতান্ত্রিকতার মতো দুর্বিপাক সামলে, এক দল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, শিশুদের জীবনে কিছুটা সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। খবর পাই, কী ভাবে, এক একটি স্কুল হয়ে উঠছে এক একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে ভিন্নতর আশা-আকাঙ্ক্ষা-উদ্যম নিয়ে তৈরি হচ্ছে সোনালি, বাবলিদের মতো মেয়েরা।
কবীরের অনেক সার কথার একটা: “মৃগ পাস, কস্তুরী বাস/ আপ না খোজৈ খোজৈ ঘাস।” বাংলার সৌভাগ্য, ঘাসের খোঁজে নয়, অঙ্গের কস্তুরীতে বিভোর মানুষও এই মাটিতে আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy