আমন ধান কাটা হয়ে গিয়েছে, কোথাও কোথাও অল্পস্বল্প সাদা শিমের চাষ হয়েছে। সূর্যপুর স্টেশনে নেমে ধানের জমির মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হয় গাজির মেলায়। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, “স্বপন সর্দার বাবার মন্দিরের উন্নয়নের জন্য একুশ টাকা দান করল, আনোয়ারা বিবি পঁচিশ টাকা, দশটি টাকা দান করল পুতুল শিকারি।” দিগন্তবিস্তৃত চাষের জমির ফাঁকা মাঠে গাজির থান, সেখানেই মেলা। পৌষ সংক্রান্তির পরে মাঘ মাসের প্রথম ক’দিন ধরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে গাজির পুজো দিতে মেলায় আসেন হিন্দু ও মুসলিমরা।
গাজির থানের দু’দিকের দেওয়ালে লেখা ‘আমিন’। এক দিকের দেওয়ালে আঁকা এক ব্যক্তি, যিনি নমাজ পড়ছেন। মূল পুজোর জায়গায় গাজি বাবার দু’টি মাটির মূর্তি। একটিতে ঘোড়ার উপরে বসে আছেন, জয় লাভের পরে ডান হাতটি উপরে তোলা, তবে হাতে অস্ত্র নেই। অন্যটি মূর্তির হাতে সরু গাছের ডাল। ভঙ্গি দেখে রাখালও মনে হতে পারে। লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি, পায়ে জুতো আর রঙিন মোজা।
স্থানীয়রা জানালেন, এই পুজো বহু প্রাচীন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাজির অনেক রূপ, অনেক কাহিনি নির্মাণ হয়েছে। ‘গাজি’ শব্দের অর্থ বিজয়ী। বহুগুণসম্পন্ন বীর মুসলমান গাজিবাবা কোথাও রক্ত আমাশা নিরাময়ের জন্য ‘রক্তান গাজি’ বা ‘রক্ত গাজি’ নামে প্রচলিত। কোথাও বীর যোদ্ধা বলে ‘মোরশাদ’ বা ‘মুরশিদ’ গাজি বলে খ্যাত। পুজোয় অনেকে গাজির ছোট মূর্তি নিবেদন করছেন। কোনওটায় বীর যোদ্ধার বেশ জমকালো পোশাক। কারও পরনে সাদা-কালো চেক লুঙ্গি, কারও আলখাল্লা। কারও মাথায় পাগড়ি, কারও মুকুট। বাহন বৃষ, বাঘ, কিংবা ঘোড়া। মূর্তিগুলি এখনও ‘সিক্স প্যাক’-এর কবলমুক্ত।
গাজিবাবার পুজোয় ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না। এক জন ‘গাজি’ পদবিযুক্ত মুসলমান খাদেম শুরু করেন। তার পরে সারা দিন ধরে তীর্থযাত্রীরা এসে পুজো করেন। হিন্দু ও মুসলমান মানুষ মূর্তি প্রদান করছেন, কেউ ফুল-বাতাসা দিচ্ছেন, কেউ কেউ ভেজা গায়ে গণ্ডি কাটছেন। হঠাৎ আশেপাশের লোকজন নিচু হয়ে পায়ের কাছে হুড়োহুড়ি শুরু করলেন। বুঝতে পারলাম হরির লুট চলছে, সবাই বাতাসা কুড়োচ্ছেন। মাইকে বলা হচ্ছে, “যাঁরা মুরগি নিতে চান অথচ আনেননি, তাঁরা মুরগি কিনতে পারেন।” আর একটু বেলার দিকে মুরগি নিলাম হবে। সন্তানলাভ, চাষবাস বা ব্যবসায়ে উন্নতি, রোগব্যাধি উপশমের প্রার্থনা করা হয় গাজির কাছে।
হিন্দু-মুসলিম, সকলেই মানত করেন। তবে বর্ণহিন্দুদের আনাগোনা খুবই কম। হিন্দু পাড়ায় বিষাদসিন্ধুর করুণকাহিনি, বনবিবির পালা এখনও জনপ্রিয়। মা বনবিবি, বিবিমা, বড়খাঁ গাজি, পির গোরচাঁদ সমমর্যাদায় পূজিত হন। সুন্দরবন অঞ্চলের তফসিলি পোদ বা পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, নমশূদ্র, বাগদি, জেলে-কৈবর্ত, নাপিত, করণ আর তন্তুবায়দের সঙ্গে আদিবাসী জনজাতির একটা বড় অংশের উৎসব গাজির মেলা। কৃষিজীবী, জলজীবী, বনজীবীদের ধর্মাচরণ বহুস্তরীয়। মৌখিক ইতিহাস তার ভিত্তি। আধিপত্যবাদী বা রক্ষণশীল নয়।
পটচিত্র দেখিয়ে গাজির গান গেয়ে বেড়াত বেদে সম্প্রদায়ের একটি অংশ। সেখানে গাজির বন্দনা করা হত— দৈত্য-রাক্ষসকে তিনি পরাজিত করেন, রোগ-মহামারি, দরিয়ায় ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করেন। আবার প্রজার অভাব-অভিযোগও বর্ণনা করা হত গানে— গাজিবাবা অত্যাচারী জমিদারের হাত থেকে বাঁচান। আজ ধর্ম ও জাতপাতের রাজনীতির তীব্রতার আবহে এমন লোকাচার নতুন চোখে দেখতে হয়। হিন্দুত্ববাদ, বর্ণবাদ, নারীহিংসার যখন বাড়বাড়ন্ত, তখন প্রতিরোধের এই সাংস্কৃতিক চর্চাগুলি বিভাজনের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকাতে বাধ্য করে লোকধর্মে। মেলা পরিচালন কমিটির সদস্যরা জানালেন, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ মেলায় করা হয় না। ভবিষ্যতেও তাঁরা বিভাজনের প্রভাব পড়তে দেবেন না।
মানুষের বিশ্বাস ওই অঞ্চল দিয়ে গাজিবাবা ঘোড়া চালিয়ে ঘুরে বেড়ান, শনশন শব্দ করে দমকা হাওয়া বয়ে চলে সেই সব জায়গা দিয়ে। প্রৌঢ়া ছবিরুল তাঁর পরিবারের এক শিশুকে দেখিয়ে বললেন, বাচ্চাটা দেখতে পেত না, এখানে নিয়ে এসে এসে চোখ ফুটে গেল। সন্ধ্যা তাঁতির পেটের রোগ এখানকার জল খেয়ে সেরে গিয়েছে, তাঁর দিদি ‘পাগল’ ছেলেকে নিয়ে বছর বছর আসছেন। এই শিশুদের বা মহিলাদের চিকিৎসার দায়িত্ব পরিবারও নেয় না, নিলেও তা অগ্রাধিকার পায় না। উদাসীন স্বাস্থ্যব্যবস্থাও। পরিবারের প্রান্তে থাকা সদস্য, আর একলা নারীরা এই বিশ্বাসগুলিকেই সম্বল করে বেঁচে থাকেন। এক দিন মাত্র মেলা ঘুরতে এসে বিজ্ঞান-যুক্তি-তর্ক খাড়া করাটা বড় শক্ত।
বেলা গড়িয়ে আসে, উপোস করে এসে পুজো সেরে খেতের মাঝে গোল হয়ে বসে কেউ মুড়ি-বাতাসা, কেউ মুড়ি-ঘুগনি খাচ্ছেন। খরচ বাঁচানোর জন্য বোঁচকায় খাবার এনেছেন সবাই। হিন্দু-মুসলমান মহিলারা বাড়ি থেকে আলুর দম, ঘুগনি, আচার বানিয়ে বসে বিক্রি করছেন। বিক্রিবাটা খুব একটা ভাল হচ্ছে না।
ছোট পরিবার নিয়ে এসেছিলেন বাবু নস্কর। স্ত্রী আর বাচ্চাকে বসিয়েছেন সাইকেলে। এ বারে ফিরে যাওয়ার পালা, অনেকটা রাস্তা যেতে হবে ওঁদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy