Advertisement
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
‘ঐতিহাসিক দায়’-এর তত্ত্ব থেকে দূরে সরতে চাইছে উন্নত বিশ্ব
Conference of the Parties

প্রাপ্তি যৎসামান্য

রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ফাঁক থাকে। জলবায়ু-রাজনীতিতেও তার অন্যথা হয়নি। দশ হাজার কোটির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হল ২০২২ সালে এসে, তবে সেই সাহায্যের অধিকাংশটাই দেওয়া হল ঋণের মোড়কে।

হতাশ: উন্নত দেশগুলির আশাতীত কম জলবায়ু-অনুদান বৃদ্ধির প্রতিবাদে নাগরিকদের মৌন মিছিল, ২৩ নভেম্বর, বাকু, আজ়ারবাইজান।

হতাশ: উন্নত দেশগুলির আশাতীত কম জলবায়ু-অনুদান বৃদ্ধির প্রতিবাদে নাগরিকদের মৌন মিছিল, ২৩ নভেম্বর, বাকু, আজ়ারবাইজান। ছবি: পিটিআই।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:২৬
Share: Save:

সেই সময় ব্রিটেনের গ্লাসগোয় চলছে ২৬তম আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন। অন্তত ১২০ জন রাষ্ট্রনেতা, শিক্ষাবিদ, পরিবেশকর্মী বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত সামলানোর সম্ভাব্য উপায়গুলি নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। ঠিক সেই সময় সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ এক মোক্ষম কথা বলেছিলেন— “এই সিওপি-র সঙ্গে আগের সিওপিগুলির কোনও তফাত নেই। বৈঠকে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা রাজনীতিবিদ। ক্ষমতার শীর্ষে থেকে এমন ভান করছেন যেন তাঁরা আমাদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। আসলে ওই ঘরের ভিতর থেকে কোনও পরিবর্তন বেরিয়ে আসবে না।” দাপুটে কণ্ঠে কিশোরী বলে উঠেছে “নেট জ়িরো ব্লা ব্লা ব্লা। ক্লাইমেট নিউট্রাল ব্লা ব্লা ব্লা... তথাকথিত নেতাদের কাছ থেকে এই সবই আমরা এত দিন ধরে শুনে আসছি। শব্দগুলো শুনতে দারুণ, কিন্তু এত দিন অবধি কোনও কাজে আসেনি। আমাদের আশা-ভরসা সবই তাঁদের শূন্যগর্ভ শব্দ আর প্রতিশ্রুতিতে ডুবে গিয়েছে।”

অতঃপর পেরিয়েছে আরও তিনটি জলবায়ু সম্মেলন। শেষেরটি সম্প্রতি শেষ হল আজ়ারবাইজানের বাকু-তে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা সম্মেলন-শেষে যা পাওয়া গেল, তা নাড়াচাড়া করতে গেলে মনে হতে বাধ্য, বছর তিনেক আগে গ্রেটার কথাগুলো কী ভয়ঙ্কর সত্যি। অথচ, এই বছরটির মধ্যে জলবায়ু সম্মেলনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। কেন, তা বুঝতে গেলে খানিক পিছনে তাকাতে হয়। প্রথম বিশ্বের দেশগুলি ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে স্থির করেছিল, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুঝবার উপযোগী পদক্ষেপ করতে পারে, তার জন্য বাৎসরিক দশ হাজার কোটি ডলার অর্থসাহায্য করা হবে ২০২০ সাল থেকে। রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ফাঁক থাকে। জলবায়ু-রাজনীতিতেও তার অন্যথা হয়নি। দশ হাজার কোটির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হল ২০২২ সালে এসে, তবে সেই সাহায্যের অধিকাংশটাই দেওয়া হল ঋণের মোড়কে। যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি অর্থ এবং পরিকাঠামোর অভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাবগুলির সঙ্গে লড়াইয়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে, সাহায্যের নামে তাদের ফের ঋণের জালে বাঁধতে চাওয়ার চেষ্টা কেন, উত্তর মিলল না।

তার পরেও কিঞ্চিৎ আশা ছিল, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে হয়তো ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপ করা হবে। কারণ, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির ৯ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল ২০২৫ সালের মধ্যেই বাৎসরিক দশ হাজার কোটি ডলারকে ভিত্তি হিসাবে ধরে এক নতুন আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা, যাকে বলা হচ্ছে ‘নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফায়েড গোল’, স্থির করা হবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ‘প্রয়োজন এবং অগ্রাধিকার’কে মাথায় রেখে। এই ক’বছরে সেই ‘প্রয়োজন’ যে কতটা তীব্র ভাবে অনুভূত হয়েছে, নিয়মিত পরিবেশ বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়তে থাকা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি তা হাড়ে হাড়ে জানে। সমুদ্রের মাঝে ভেসে থাকা ছোট দ্বীপগুলির জীবন-জীবিকা বিপদের মুখে পড়ছে বাড়তে থাকা সমুদ্র জলতলের কারণে। সুতরাং, সিওপি-২৯’এর নতুন আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ বিষয়ে প্রত্যাশার পারদ চড়ছিল। বস্তুত এই তহবিল বৃদ্ধির বিষয়টিকে মাথায় রেখেই সম্মেলনের আগে থেকেই একে ‘ফাইনান্স কপ’ বলে অভিহিত করা হচ্ছিল।

তহবিল বৃদ্ধি জরুরিও ছিল। আগামী বছরের গোড়াতেই ‘ন্যাশনালি ডিটারমিন্ড কন্ট্রিবিউশন্স’-এর পুনর্মূল্যায়ন হওয়ার কথা। এনডিসি ছিল প্যারিস চুক্তির একেবারে মধ্যমণি। চুক্তি অনুযায়ী যোগদানকারী পক্ষগুলির কাছে আবেদন করা হয়েছিল ২০২০-উত্তর পর্বে তারা যেন জলবায়ু সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলির খসড়া প্রস্তুত করে এবং সেগুলি নিয়ে আলোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণকে কমিয়ে আনার পথ নির্ণয় করে। কিন্তু তার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রয়োজন অর্থের, যাকে কাজে লাগিয়ে তারা এনডিসি স্থির করার ক্ষেত্রে সাহসী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তার আনুমানিক পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল বার্ষিক ১.৩ লক্ষ কোটি ডলার।

কিন্তু বাকু-তে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে তীব্র দর কষাকষি-অন্তে উন্নত দেশগুলি ২০৩৫ সাল নাগাদ বছরে মাত্র ত্রিশ হাজার কোটি ডলার প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে পারল। এবং করে বেশ সন্তুষ্টও হল— ২০০৯ সালে যে দশ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল তার চেয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা তিন গুণ বেশি। কম কথা তো নয়। সমস্যা হল, এই পরিমাণটি আসলে উন্নয়নশীল দেশগুলির ‘প্রয়োজন’-এর তুলনায় ঢের কম। স্বাভাবিক ভাবেই তারা বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। নতুন লক্ষ্যমাত্রাকে ব্যাখ্যা করেছে ‘অত্যন্ত দেরিতে আসা অত্যল্প’ বলে। ‘হতাশ’ ভারতও কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, “পরিমাণটি যৎসামান্য, জলবায়ু সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত নয়।”

সর্বোপরি, এই লক্ষ্যমাত্রার ভিতরে আরও বেশ কিছু সচেতন অস্পষ্টতাও রয়েছে, যা আগামী দিনে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে স্বস্তিতে রাখবে না। যেমন, এই ত্রিশ হাজার কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার কতটা অংশ সরকারি ক্ষেত্রগুলি থেকে আসবে, আর কতটাই বা বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে, তা নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়নি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এর অধিকাংশটাই উন্নত দেশগুলি চাপাতে চাইবে বেসরকারি ক্ষেত্রের ঘাড়ে। এ ক্ষেত্রে বিপদ দ্বিবিধ। প্রথমত, জলবায়ু জাতীয় বিষয়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি বিশেষ আগ্রহী থাকে না, কারণ এতে লাভের মাত্রা প্রায় নেই। অন্য দিকে, তারা যদি অর্থ ঢালেও, তবে ধরেই নেওয়া যায় তা আসবে ঋণ হিসাবে, অনুদান হিসাবে নয়। এবং তাতে ছাড়হীন উচ্চ সুদের হার, কড়া শর্তাবলি, এবং অস্বচ্ছতার সম্ভাবনাটি প্রবল। ফলে আরও বেশি ঋণের জালে বন্দি হবে দরিদ্র দেশগুলি।

সবচেয়ে বড় কথা, কিয়োটো প্রোটোকলের সেই ‘ঐতিহাসিক দায়’-এর তত্ত্ব থেকে যে খুব কৌশলে সরে আসতে চাইছে উন্নত বিশ্ব, সেই মনোভাবও অনেকটাই স্পষ্ট হল এই সম্মেলনে। ২০৩৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলির বার্ষিক ১.৩ লক্ষ কোটি ডলারের দাবিকে উন্নত বিশ্ব মোটেই উড়িয়ে দেয়নি। বরং সে ক্ষেত্রে তারা বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলিকেও আহ্বান জানিয়েছে স্বেচ্ছায় সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে। মোক্ষম প্যাঁচটা এইখানেই। এত দিন যা ছিল তাদের একক ‘দায়িত্ব’, অর্থের সম্ভাব্য উৎসমুখগুলিকে সম্প্রসারিত করে সেই দায়িত্বের ধার এবং ভার অনেকটাই লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা। এখন যা আহ্বান, আগামী দিনে যে সেটাই নির্দেশে পরিণত হবে না, তার গ্যারান্টি কে দিতে পারে?

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ঘোষিত উষ্ণায়ন তত্ত্ব-বিরোধী সাড়ম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। প্রায় কাছাকাছি সময়েই সিওপি-২৯’এ উন্নত দেশগুলি জলবায়ু যুদ্ধে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য দিতে কার্যত অস্বীকার করল।

আশ্চর্য সমাপতনই বটে!

অন্য বিষয়গুলি:

COP CMP COP29
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy