সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে খ্যাতনামা লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পল দাবি করেছেন যে, ভারতের ইতিহাসবিদরা সাধারণ জনগণের জন্য ইতিহাস রচনা করেননি, নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরেই আবদ্ধ থেকেছেন। আর এই সুযোগে রমরমা বেড়েছে ‘ওয়টস্যাপ ইউনিভার্সিটি’র। ডালরিম্পল মনে করেন যে, যদি ভারতের ইতিহাসবিদরা সাধারণের কথা ভেবে নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে সহজবোধ্য ভাষায় বই লিখতেন, তা হলে সমাজমাধ্যমে ‘ইতিহাসচর্চা’র এই বাড়বাড়ন্ত হত না।
ডালরিম্পল নিজে বেশ কিছু জনপ্রিয় ও সাধারণপাঠ্য ইতিহাস বই লিখেছেন ইংরেজিতে, গত দু’দশকে। তবে ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসবিদদের নিয়ে তাঁর বক্তব্যে স্বাভাবিক ভাবেই সমাজমাধ্যমে প্রতিক্রিয়ার ঝড় উঠেছে। বেশ কিছু তরুণ ইতিহাসবিদ ডালরিম্পলের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, ভারতীয় ইতিহাসবিদরা যথাসাধ্য লিখেছেন আমজনতার কথা ভেবে। রোমিলা থাপরের নাম এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। তিনি এত বেশি সাধারণ জনতার জন্য লিখেছেন বা বলেছেন যে, তা দক্ষিণপন্থীদের বার বার ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। বাংলার খ্যাতনামা ইতিহাসবিদরাও বাংলা ভাষায় লিখেছেন বিপুল পরিমাণে, যা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার জগতে আবদ্ধ ছিল না। গত শতকের আশির দশক থেকে বৈশ্বিক ইতিহাসচর্চায় বিপুল প্রভাবশালী সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ় কালেক্টিভ-এর নতুন চিন্তাভাবনার কথা বাংলা ভাষায় গোড়া থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার ‘লিটল ম্যাগাজ়িন’-গুলি। নিয়মিত ইতিহাসের বই প্রকাশিত হয়ে এসেছে বাংলায়। ‘ইতিহাস গ্রন্থমালা’ সিরিজ়টি উল্লেখ্য।
উচ্চশিক্ষার আঙিনা ছাড়াও রয়েছে পাঠ্যপুস্তকের জগৎ। স্বাধীনতার পর রোমিলা থাপর, বিপান চন্দ্র, সতীশ চন্দ্ররা মিলে জাতীয় পঠনপাঠনের জন্য যে ইতিহাস বই লেখেন, তা বজায় ছিল প্রায় পাঁচ দশক ধরে। একুশ শতকের গোড়ায় ইতিহাস ছাড়াও অন্যান্য সমাজবিদ্যার নতুন বই বার করার চিন্তা শুরু হয় এনসিইআরটি-র তরফ থেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হরি বাসুদেবনের নেতৃত্বে আর জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নীলাদ্রি ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে দেশের অগ্রগণ্য ইতিহাসবিদরা ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির নতুন পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেন। এই বইগুলিতে ‘ইতিহাস’ বলতে স্কুলের যে ঘুমপাড়ানিয়া বিষয়ের কথা বেশির ভাগ মানুষের মাথায় আসে তার থেকে অনেকখানি সরে এসে নতুন ভাবে ইতিহাস পাঠের কথা তুলে ধরা হয়। ইতিহাসে কেন কালানুক্রমিক ধারণা জরুরি, সূত্রের গুরুত্ব কী, বিভিন্ন সময়ের নিরিখে অতীত পাঠের প্রয়োজনীয়তা কতটা, এবং সর্বোপরি, সমাজের বহুত্ববাদ এবং ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অতীতচর্চার মূল্যের কথা সহজ ভাষায় স্কুল-পড়ুয়াদের সামনে হাজির করা হয়। পনেরো-ষোলো বছর পর বইগুলির সীমাবদ্ধতাও আজ চোখে পড়ে। নানা জায়গায় পরিমার্জন প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে এক আঁচড়ে মোগল ইতিহাস কেটে ফেলে দেওয়া কোনও সমাধান হতে পারে না। তা ছাড়া এই দেড় দশকের অভিজ্ঞতা এক অন্য পরিস্থিতির কথাও জানায়। অনেক খেটেখুটে বই লিখলেই কি হবে? সেই বই যে উদ্দেশ্য এবং চিন্তাভাবনা থেকে লেখা হল, সেটা পড়ুয়া অবধি পৌঁছবে তো?
এবং, সাধারণ পাঠকের জন্য কলম ধরলেই যে তা জনতা পড়বেন, এই গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারেন না। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব সামলে স্কুল পড়ুয়াদের জন্য পাঠ্যপুস্তক লেখা আর ইংরেজি ভাষায় বাণিজ্যিক ছাপাখানা থেকে বিপুলায়তন বই প্রকাশ করায় ফারাক আছে, কিন্তু হয়তো দু’ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য হল উচ্চশিক্ষার নির্দিষ্ট, সীমায়িত গবেষণার পরিসর থেকে বেরিয়ে এসে এমন পাঠকের সঙ্গে আলাপচারিতা যার নিজের বিষয় ‘ইতিহাস’ নয়। আর এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অতীতের কোন বিষয় নিয়ে, কোন পদ্ধতিতে, সেই বই লেখা হচ্ছে। আজকের ভারতে তথাকথিত ‘পপুলার হিস্ট্রি’তে অতীত ভারতের (হিন্দু) গৌরব, মুসলমান শাসনের ভয়াবহতার কথা পাওয়া যায়। এই বিষয় নির্বাচন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফসল। তবে শুধু বিষয় নির্বাচন দিয়েই এই বইগুলির জনপ্রিয়তা বোঝা যাবে না। জনগণের জন্য কোন ‘ইতিহাস’ কী ভাবে লেখা হচ্ছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসের তুলনায় ভারতের অতীত-গৌরবের গাথা বেশি আকর্ষণীয়; মুসলমান সম্রাটের অন্যায়-অবিচার, মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের ঘটনার বিক্রি রমরমা। এ আজকের ব্যাপার নয়। ১৯৮০-র দশকে হিন্দিতে নানা পুস্তিকা বেরোত রামজন্মভূমির ‘সত্য’ সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এখন ছাপা বইয়ের পরিসর থেকে বেরিয়ে এর আবেদন মোবাইল ফোনের মেসেজ-এ ছড়িয়ে পড়েছে।
ইংরেজিতে লেখা নতুন ‘পপুলার হিস্ট্রি’র বই আর বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় রচিত বাজার-পুস্তিকার মধ্যে ফারাক আছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এই নতুন বইগুলিতে তথ্যের ভ্রান্তি থাকে না, ইতিহাসবিদ্যার রীতিনীতি মেনে তথ্যের সূত্র উল্লেখ করা হয়। সাধারণ উচ্চশিক্ষিত পাঠকের কাছে তাই এই ইতিহাসের আবেদনও যথেষ্ট। কিন্তু একটু মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় যে, তথ্যের যুক্তিসম্মত ব্যবহার বা আখ্যান নির্মাণের পিছনে কত রকম হীন কৌশল। অতীতের তথ্যকে কী ভাবে সাজানো হচ্ছে, কোন যুক্তি-পরম্পরার অংশ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, এবং তার থেকে কী ব্যাখ্যা করা হচ্ছে— এর মধ্যেই নিহিত থাকে ইতিহাস রচয়িতার হাতযশ। ঐতিহাসিক উপাদান ব্যবহার করারও নানা পদ্ধতি থাকে। কোনও সূত্র, তা সে সাহিত্যকর্ম বা সরকারি নথি, যা-ই হোক না কেন, ইতিহাসের আখ্যানে ব্যবহার করার আগে সেই সূত্রটি কবে, কী ভাবে, কার দ্বারা, কোন পরিস্থিতিতে নির্মিত হয়েছিল তা বুঝতে হবে। আখ্যানের সপক্ষে যুক্তি সাজানোর সময়ে তথ্যের রাজনীতির কথাও সমান ভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
এই তর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকে না, ফলে আধুনিক রাষ্ট্রের অতীত গৌরবের কাহিনি সহজেই জনপ্রিয় হয়। তবে বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বাধ্য করেছে প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসবিদদের নিজেদের গোষ্ঠীর বাইরে বেরিয়ে সাধারণ জনগণের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করতে। ‘পাবলিক হিস্ট্রি’ এখন এক নির্দিষ্ট বিষয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়ে পড়াশোনা শুরু হয়েছে। অনেকেই সমাজমাধ্যম ব্যবহার করে নতুন ভাবে ইতিহাসের বয়ান রচনার কথা ভাবছেন। ইতিহাস রচনার যুক্তি-কাঠামোকে মান্যতা দিয়ে ইতিহাসকে চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে পরিবেশন করতে নানা প্রকল্প নিয়েছেন গবেষকরা। সিগাল ফাউন্ডেশন-এর ‘হিস্ট্রি ফর পিস’ বা ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতার ‘ইতিহাসে হাতেখড়ি’ স্কুল-পড়ুয়াদের কাছে ইতিহাসের প্রকল্প হাজির হয়েছে। জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, বা কলকাতা শহরে ‘হেরিটেজ ওয়াক’-এর মতো পরিকল্পনা।
ডালরিম্পলের প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে জনগণের জন্য বই লেখা শুধু ইতিহাসবিদের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে না। এর সঙ্গে জড়িত আরও অনেক কিছু— বিষয় নির্বাচন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বইয়ের বাজার, প্রচার, বিপণন, আর্থিক নিরাপত্তা। প্রশ্নটির সরলীকরণে বিরাট ভুল থেকে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy