Advertisement
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
Politics Without Parties

অদলীয় রাজনীতির পথ

খুঁটিনাটি নিয়ে মানুষ যত বেশি কথা বলবে, প্রশ্ন করতে শুরু করবে, অদলীয় রাজনীতির কার্যসূচি ও কর্মী-দল ততই তৈরি হবে, এবং সেই সঙ্গে তাদের সমর্থনের একটা বলয় তৈরি হবে।

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:৪৭
Share: Save:

দলীয় রাজনীতির বাইরে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি তৈরি হচ্ছে, অন্তত তৈরির চিন্তাভাবনা চলছে, এমন একটা আভাস মিলছে। নির্বাচন-কেন্দ্রিক বা ক্ষমতাসর্বস্ব নয় বলে এই রাজনীতির ব্যাকরণ যে আলাদা হবে, তেমনই প্রত্যাশিত। আপাতত এই রাজনীতি গড়ে ওঠার দু’টি মূল আধার তৈরি হয়েছে— একটি মেয়েদের কাজের মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সুরক্ষা, এবং অন্যটি চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি। কিন্তু মেয়েদের কাজের মর্যাদা, স্বাধীনতা, সুরক্ষা বলতে ঠিক কী বোঝায়? চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কী করণীয়? এগুলির খুঁটিনাটি নিয়ে মানুষ যত বেশি কথা বলবে, প্রশ্ন করতে শুরু করবে, অদলীয় রাজনীতির কার্যসূচি ও কর্মী-দল ততই তৈরি হবে, এবং সেই সঙ্গে তাদের সমর্থনের একটা বলয় তৈরি হবে।

যেমন, কলকাতা ও বড় শহরগুলোর বাইরে যে বিস্তৃত চিকিৎসা ব্যবস্থার কাঠামো আছে, সেখানে ডাক্তার, নার্স, পারামেডিক্যাল কর্মী, ল্যাবরেটরি, এবং অন্যান্য পরিকাঠামোর ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তেমনই, মেয়েদের কাজের মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সুরক্ষার কথা বলতে গেলে বলতে হয় ন্যায্য মজুরি, পর্যাপ্ত যানবাহন, যথেষ্ট শৌচাগার, ক্রেশ, ইত্যাদি। মেয়েদের মুখে পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সাবেক ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে সংঘাতের কথাও ধ্বনিত হতে শুনেছি। এই বিষয়গুলি নিয়ে সংলাপ যত গড়ে উঠবে, তত মানুষ বুঝতে শিখবে, দলীয় রাজনীতির সঙ্গে অদলীয় রাজনীতির তফাত কী।

অন্য রাজ্যে বেশ কিছু অদলীয় রাজনৈতিক শক্তি আত্মপ্রকাশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে একতা পরিষদ, সেবা ট্রেড ইউনিয়ন, মজদুর কিসান শক্তি সংগঠন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, মহারাষ্ট্র-তামিলনাড়ুর দলিত সংগঠনগুলি, ঝাড়খণ্ডের জনজাতি গোষ্ঠীর নানা আন্দোলন। এদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, গ্রাম-মফস্‌সলের অনেকখানি এলাকায় ওই সংগঠনগুলির উপস্থিতিই তাদের রাজনীতির বড় শক্তি। মূল কয়েকটি লক্ষ্য বা অ্যাজেন্ডা-র ভিত্তিতে তারা এক-একটা রাজ্যের অনেকটা অঞ্চল জুড়ে ব্যাপক আকারে সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পেরেছে। এদের লক্ষ্যও নানা রকম— কোথাও দলিত-জনজাতিদের জমির অধিকার, কোথাও সরকারি টাকা খরচের হিসাব-নিকাশ আদায় করা, জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ, আবার কোথাও তা মহিলা-শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি ও মর্যাদা আদায়।

এই সংগঠনগুলির বিশেষত্ব এই যে, এরা হাই কমান্ড বা পলিটব্যুরো-চালিত সংস্কৃতিতে কাজ করে না, বরং পারস্পরিক স্বতন্ত্রতা ও সংহতির ভিত্তিতে কাজ করে। কোনও রাজ্যেই এরা সব জেলায়, ব্লকে পঞ্চায়েতে উপস্থিত নেই, কিন্তু যতটুকু সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকলে প্রশাসন ও নেতারা কথা শুনতে বাধ্য হন, তা এদের আছে।

এই সাংগঠনিক ক্ষমতার অন্যতম বিশেষত্ব হল মূল কয়েকটি লক্ষ্যে অনড় থাকা। যে আন্দোলন জমির অধিকার নিয়ে গড়ে উঠেছে, তা ভূমিহীন দলিত জনজাতি ও মহিলাদের জমির অধিকার থেকে শুরু করে ক্রমে ক্রমে অরণ্যের অধিকার, সামুদায়িক সম্পদের অধিকার, জমি থেকে উচ্ছেদ হলে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের অধিকার, বুলডোজ়ারের বিরুদ্ধে লড়াই, ক্ষুদ্র চাষির স্বার্থরক্ষা, এমন নানা লড়াইয়ে অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, এবং শক্তি বর্ধন করেছে। কিন্তু দলীয় রাজনীতির মতো সব বিষয়েই নিজেদের নাক গলায়নি। এ বিষয়ে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব পিপলস মুভমেন্টস-এর (এনএপিএম) কথা স্মরণীয়। প্রায় এক বছর আলোচনার পর তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে দলীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করবে না, নতুবা তাদের রাজনীতির মূল চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে।

তবে অন্য রাজ্যগুলি থেকে এ-ও শিক্ষণীয় যে, এলা ভট্টের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন ‘সেবা’ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলির প্রধান উপস্থিতি গ্রামে-মফস্‌সলে, বড় শহরে নয়। তবে বড় শহরগুলিতে এই শক্তির সপক্ষে সক্রিয় সমর্থন বলয় কাজ করে। এনএপিএম-এর দিল্লির সংগঠক হিমাংশু উপাধ্যায়ের কাছ থেকে জেনেছি তিনি ও তাঁর সহযোগীরা কী ভাবে ছাত্র-গবেষক সমাজ, সংবাদমাধ্যম, আমলা, শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে এক বৃহত্তর, সক্রিয় সমর্থন-বলয় তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাঁরা তহবিল সংগ্রহ করতেন, স্বেচ্ছাসেবী জোগাড় করতেন, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। অন্য সংগঠনগুলির কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন, মিটিং-মিছিল, সেমিনার-সমাবেশেও হাজির থাকতেন, এমনকি অল্প কিছু সাংসদের সঙ্গেও তাঁদের সম্পর্ক ছিল। ঝাড়খণ্ডের জনজাতিদের আন্দোলনেও দেখেছি আন্দোলনের মূল শক্তি গ্রামে, কিন্তু রাঁচীতে তাঁদের সপক্ষে একটা সক্রিয় সমর্থন বলয় কাজ করে।

১৯৯৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত যতগুলি জনমুখী আইন হয়েছে, তার প্রায় সবই কোনও না কোনও অদলীয় রাজনৈতিক শক্তির হাত ধরে জাতীয় স্তরে উঠে এসেছে। বিশিষ্ট মানুষদের ভূমিকাও থেকেছে তাতে। খাদ্যের অধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এন সি সাক্সেনা, এস আর শঙ্করন, নর্মদা বাঁচাও-এরক্ষেত্রে শরদচন্দ্র বেহার, তথ্যের অধিকার তথা ১০০ দিনের কাজের ক্ষেত্রে অরুণা রায়, জঁ দ্রেজ়, পেসা-অরণ্যের অধিকার আইনের ক্ষেত্রে কে বি সাক্সেনা, এলা ভট্ট, রাজাগোপাল, বি ডি শর্মা, যোগেন্দ্র যাদব প্রমুখ এই রাজনীতির সঙ্গে সরকারের কথোপকথনের সেতু হয়েছেন, গণশুনানিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন।

দলীয় রাজনীতির মতোই, নাগরিক রাজনীতিও ফেক নিউজ় আর স্টুডিয়ো-খেউড়ের মায়াজাল অতিক্রম করে নতুন ভাষা তৈরি করেছে। স্পষ্ট ও বিনীত ভাবে মূল বিষয়গুলিতে স্থির থেকে কথা বলতে পেরেছে, দলীয় নেতাদের ‘হোয়াটঅ্যাবাউটারি’-র মোকাবিলা করতে পেরেছে। কয়েকটি আন্দোলন তো স্পষ্টতই দেখায় যে তথ্যভিত্তিক, অনুকূল সাংবাদিকতা আন্দোলনের বাণীকে চার দিকে ছড়িয়ে দিতে কতটা সহায়তা করতে পারে। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন তার অন্যতম নিদর্শন।

স্বতন্ত্রতার সম্মান, নানা আন্দোলনের মধ্যে সংহতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অহিংস, শান্তিপূর্ণ, বিকেন্দ্রীকৃত এবং মূল অ্যাজেন্ডায় স্থিত— এই ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সাধারণ মানুষের নানা সংগঠন দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। তার পথ তৈরি করাই এখন প্রধান কাজ।

আজ়িম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Women Empowerment treatment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy