Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Hardik Pandya & IPL Final

হারেও মহীয়ান, এ হৃদয় দফতর না বদলে ফেলে!

গভীরতর রাতের গভীরতম মুহূর্ত। ব্যক্তিগত ব্যর্থতায় মরমে মরে থাকার সময়ে ওই আশ্বাসটা যিনি দেন, ‘অধিনায়ক’ থেকে তাঁর উত্তরণ হয় ‘মন অধিনায়ক’-এ।

 Hardik Pandya

সোমবার রাতে হার্দিককে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, একেবারে ঠিক হাতেই গিয়ে পড়বে ভারতীয় ক্রিকেট। মূল ছবি: গেটি ইমেজেস।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৩ ০৮:০৮
Share: Save:

রাত দেড়টা। তাঁর ক্রিকেট লোকগাথায় জুড়ে যাচ্ছে আরও এক গরিমাময় পরিচ্ছেদ। আমদাবাদের দৈত্যাকৃতি স্টেডিয়াম জুড়ে শব্দব্রহ্মের বিস্ফোরণ। গোটা মাঠ জুড়ে হলুদ প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে কিছু চেহারা। সচরাচর নির্লিপ্ত ক্রিকেটসাধক, তিনিও বিহ্বল। জয়ে-পরাজয়ে সমান নিরাসক্ত তাঁকেও অভিভূত, বিস্মিত, আবেগতাড়িত দেখাচ্ছে। স্বভাবজ অভ্যাসে প্রথমে নিজেকে খানিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষে দেখলাম, মুহূর্তের মাহাত্ম্যের কাছে তিনিও পরাভূত। অবিশ্বাস্য ম্যাচ জিতিয়ে-ফেরা রবীন্দ্র জাডেজাকে কোলেই তুলে নিলেন তাঁর অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। এত, এত ট্রফি জিতেছেন। কিন্তু আবেগের এমন বিস্ফোরণ তাঁর মধ্যে আগে কখনও দেখিনি।

তার অনতিদূরে আরও একটা পরিচ্ছেদ লেখা হচ্ছিল। লোকগাথার নয়। রূপকথার।

মেরুন রঙের তোয়ালে-রুমালটা দিয়ে কোনও মতে এক বার ঘাড়-মাথা মুছল ধ্বস্ত চেহারাটা। তার পর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। লজ্জায়। হতাশায়। বেদনায়। বুঝি বা খানিক অবসাদেও। এই আইপিএলে তিনি সোনার অক্ষরে লিখেছেন নিজের ক্রিকেটনাট্য। চোট সারিয়ে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন। হারিয়ে যেতে যেতে ফিরে এসেছেন এবং গোটা টুর্নামেন্টে দুর্ধর্ষ পারফর্ম করেছেন। গত বছর আইপিএলের সময় যিনি ছিলেন নিছক এক নেট বোলার, তিনিই এ বার সমস্ত দলের সমস্ত বোলারের মধ্যে উইকেটশিকারির তালিকায় যুগ্ম ভাবে দু’নম্বর! মহাপরাক্রমশালী মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে মাত্র ১০ রানে ৫ উইকেট (তার মধ্যে একটি সিংহবিক্রমের অধিকারী সূর্যকুমার যাদবের। যিনি প্রায় একাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে বসেছিলেন) নিয়ে দু’দিন আগের এলিমিনেটর তিনিই জিতিয়েছেন। গোটা দেশের হৃৎপিণ্ড খুলে হাতে চলে এসেছে, এমন এক ফাইনালের উত্তুঙ্গ টেনশনে আক্রান্ত শেষ ওভার (বিপক্ষের দরকার ৬ বলে ১৩ রান) তিনি ছাড়া আর কাকে দেওয়া যায়?

শেষরক্ষা হল না। প্রথম চারটে ডেলিভারি নিখুঁত পড়ল। কিন্তু শেষ দু’বলে পর পর ছয় আর চার খেয়ে গেলেন তিনি। তাঁর ফলো থ্রু শেষের আগে যখন ডিপ ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে আছড়ে পড়ছে জাডেজার ম্যাচ-জেতানো বাউন্ডারি, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। অসহায়। স্থাণু। দৃষ্টিতে অসীম শূন্যতা। শরীর জুড়ে স্বেদবিন্দুর সঙ্গে চুঁইয়ে নামছে অবসাদ। খুব ধীরে, প্রায় স্লো মোশনে ঘুরলেন পরাভূত ক্রিকেটার। পরিশ্রান্ত, পরাজিত, বিধ্বস্ত শরীর টেনে নিয়ে যেতে হবে সাজঘরে।

ধীর পদক্ষেপে তিনি যখন ডাগ আউটের দিকে ফিরছেন, মিড অফ থেকে দৌড়ে এল একটা ছিপছিপে চেহারা। দু’হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করল ভেঙে-পড়া সতীর্থকে। কী লিখলাম? আলিঙ্গন? ভুল। আলিঙ্গন-টালিঙ্গনের মধ্যে ঔপচারিকতা থাকে। আসলে জড়িয়ে ধরল। বুকে টেনে নিল। বাঁ হাত জড়িয়ে নিল সহ-খেলোয়াড়ের পরিশ্রমী দেহের ঘর্মাক্ত পিঠ। ছোট ছোট চাপড়ে যে হাত বুঝিয়ে দিচ্ছিল, আমি তোমায় নিয়ে গর্বিত। ডান হাত রইল মাথায়। বরহস্তের মতো? তা-ও নয়। আশ্রয়ের মতো। পক্ষীমাতা যে ভাবে জড়িয়ে রাখে তার শাবককে। যে ভঙ্গি কোলের কাছে গুটিসুটি চেহারাকে অস্ফুটে বলে— ঠিক আছে। ঠিক আছে।

দৃশ্যটা মনের বায়োস্কোপে বার বার রিওয়াইন্ড করে দেখব। দেখতেই থাকব। সম্ভবত ২০২৩ সালের আইপিএল ফাইনালের গভীরতম মুহূর্ত।

বিধ্বস্ত মোহিত শর্মাকে বুকে টেনে-নেওয়া হার্দিক পাণ্ড্যকে দেখে একটাই শব্দ মনে হচ্ছিল— গ্রেস। লাবণ্য। যে লাবণ্য তাঁকে হারেও মহীয়ান রেখে দিল। রূপকথার পরিচ্ছেদ লেখা হয়ে গেল চিরতরে।

ক্রিকেট ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির নির্মম, মানবতাহীন, রুক্ষ এবং গলাকাটা পেশাদারিত্বের দুনিয়ায় এই দৃশ্য কী আশ্চর্য এবং কঠোর ব্যতিক্রম! যেমন ব্যতিক্রম হার্দিক স্বয়ং। হাত-টাত ছেড়ে দিন। ঘাড়ের কাছেও বাঘের পায়ের ছাপের ট্যাটু। চোখে রংবাহারি কাচের চশমা, গলায় মোটা চেন, দু’কানে ঝলমল করছে হিরের মস্ত স্টাড— ভারতীয় ক্রিকেটের (সম্ভবত ইদানীংকার মেট্রোসেক্সুয়াল সমাজেরও) বখাটে, উচ্চকিত এবং দুর্বিনীত চরিত্র হওয়ার সমস্ত উপাদান তাঁর মধ্যে আছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি যেটা আছে, সেটা খালিচোখে দেখা যায় না। সেটা খালিচোখে দেখারও নয়। বোঝার। অনুভব করার। আত্মবিশ্বাস আর আত্মনিয়ন্ত্রণ। যে আত্মবিশ্বাস তাঁকে প্রথম কোয়ালিফায়ারে হেরে গিয়েও বলিয়ে নিয়েছিল, ‘‘ঠিক আছে। চেন্নাইয়ের সঙ্গে আবার দেখা হতে পারে।’’ যে আত্মনিয়ন্ত্রণ তাঁকে আগাগোড়া দুর্ধর্ষ ক্রিকেট খেলেও পাকেচক্রে শেষ ওভারে হেরে যাওয়ার পর শান্ত রাখে। রাখে উন্নতশির। হেরে যাওয়ার পর যখন তিনি টুইট করেন, ‘‘উই স্ট্যান্ড টল উইথ আওয়ার হেড্স হেল্ড হাই। প্রাউড অফ দিস্‌ টিম। উই গেভ ইট আওয়ার অল’’, তখন তা নিছক বলবর্ধক বাক্য মনে হয় না।

 Hardik Pandya

ভারতীয় ক্রিকেটের বখাটে, উচ্চকিত এবং দুর্বিনীত চরিত্র হওয়ার সমস্ত উপাদান তাঁর মধ্যে আছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি যেটা আছে, সেটা খালিচোখে দেখা যায় না। ছবি: পিটিআই।

সাদা বলের ক্রিকেটে এখন ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়ক তিনি। বড় চোট-আঘাত পাওয়া বা ওই ধরনের কোনও অঘটন না-ঘটলে অধিনায়ক হওয়া কেউ আটকাতে পারবে বলে মনে হয় না। সোমবার রাতে হার্দিককে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, একেবারে ঠিক হাতেই গিয়ে পড়বে ভারতীয় ক্রিকেট। মাঝখানে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মারা রয়েছেন। কিন্তু মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মশাল বহনের যোগ্যতম ব্যক্তি তিনিই।

আশ্চর্য নয় যে, ধোনিকে ‘মেন্টর’ মানেন হার্দিক। টান টান ম্যাচে হেরে (ধোনির আকণ্ঠ গুণগ্রাহী হয়েও বলে রাখি, বোলিং এবং ফিল্ডিংয়ে যে সমস্ত গুবলু তাঁর টিম করেছে, তাতে তাঁর এই ফাইনাল জেতাটা ‘পোয়েটিক ইনজাস্টিস’-এর সমান। একই নিশ্বাসে এটাও বলে রাখি যে, ফাইনাল হারলেও হার্দিকের গুজরাতই এই টুর্নামেন্টের সেরা দল। ক্রিকেটের সমস্ত বিভাগে সমান শক্তিশালী) যাওয়ার পরেও ‘গুরু’ সম্পর্কে আশ্চর্য আপ্লুতি তাঁর কণ্ঠে, ‘‘ধোনির এটা প্রাপ্য ছিল। আয়াম সো সো হ্যাপি ফর হিম! ম্যাচ হারলেও আমার কোনও খারাপ লাগা নেই। জীবনে এখনও পর্যন্ত যত জনের সঙ্গে দেখা হয়েছে, ও তাদের মধ্যে সর্বোত্তম। হারতে হলে ওর কাছেই হারা উচিত। ওর যা প্রাপ্য ছিল, ঈশ্বর ওকে সেটা দিয়েছেন। এই জয়টা নিয়তি ওর জন্যই লিখে রেখেছিল।’’

 Hardik Pandya and MS Dhoni

মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মশাল বহনের যোগ্যতম ব্যক্তি তিনিই। ছবি: পিটিআই।

সত্যিই। নিয়তিই বটে। নড়বড়ে বোলিং (প্রত্যেক ম্যাচে হুদোহুদো ওয়াইড)। অত্যন্ত সাধারণ মানের ফিল্ডিং (কয়েক জনকে তো মাঠে লুকোনো যায় না)। নেহাত তিনি মহাকাব্যের নায়ক এবং ভালবাসার মানুষ হয়ে গিয়েছেন বলে কেউ আর বলে না। কিন্তু সত্যি হল, নিজেও ব্যাটিংয়ে ব্যর্থ (ফাইনালেও প্রথম বলেই আউট)। এই লগবগে টিম নিয়ে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নিজেও কি ভেবেছিলেন চ্যাম্পিয়ন হবেন? কে জানে! স্বেচ্ছা-আরোপিত নিয়ন্ত্রণের আলখাল্লা টান মেরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাঁর মধ্যে যে আবেগের বিস্ফোরণ দেখলাম, মনে হল ভাবেননি। গত মরশুমে ১০টা টিমের মধ্যে ৯ নম্বরে শেষ করেছিল তাঁর দল। মনে হচ্ছিল না, এ বারেও বেশি দূর যেতে পারবে। সেখান থেকে একেবারে চ্যাম্পিয়ন! এ জিনিস নিয়তির হাত না-থাকলে হয় নাকি! ট্রফি জয়ের নিরিখে নিজেকে ক্রমশ অবিশ্বাস্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রিকেটের একনিষ্ঠ সাধক। এমনিতেই গোটা দেশে একটা অরণ্যদেবোচিত ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে তাঁর। তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার কাছাকাছির কোনও উদাহরণ সাম্প্রতিক কালে চোখে পড়ছে না। যেখানে যাচ্ছেন, কূল ছাপিয়ে এসে তাঁকে সিক্ত করে যাচ্ছে হলুদ ঢেউ। তিনি মাঠে নামামাত্র বা ড্রেসিংরুমে বসে থাকাকালীন জায়ান্ট স্ক্রিনে তাঁকে একঝলক দেখালে যে গর্জন উঠছে মাঠ জুড়ে, স্টার স্পোর্টস গবেষণা করে বার করেছে, সেই আওয়াজ রকেট উৎক্ষেপণ বা এরোপ্লেন টেক অফ করাকেও সময়ে সময়ে ছাপিয়ে গিয়েছে (একদা আইপিএল টিমে তাঁর সতীর্থ এবং অধুনা ধারাভাষ্যকার ম্যাথু হেডেন শব্দের মাত্রামাপক ‘ডেসিবেল’-এর অনুকরণে নাম দিয়েছেন ‘ধোনিবেল’) । সোমবার রাতের অবিশ্বাস্য জয় তাঁকে ধরাছোঁয়ার আরও বাইরে নিয়ে গেল।

ঠিক সেই কারণেই তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ভেবেছিল, এই মঞ্চই হোক তাঁর অবসরের জন্য শ্রেষ্ঠতম। সিংহাসনে থাকতে থাকতে মুকুট খুলে নামিয়ে রাখুন তিনি। আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজের ক্রিকেটগাথার শেষ পাতাটা লিখে প্রকাশককে পাণ্ডুলিপি দিয়ে দিলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচা যেত! অবশ্য তার একটা স্বার্থপর কারণও ছিল। তিনি মাঠে নামলেই এই ভয়াবহ টেনশন আর নেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু জনতার ভালবাসার কারণ দেখিয়ে তিনি অবসরের জল্পনাটা সেই ভাসিয়েই রাখলেন। টেনশন এবং চোঁয়া ঢেকুরের সম্ভাবনা সেই থেকেই গেল।

MS Dhoni

সোমবার রাতের অবিশ্বাস্য জয় তাঁকে ধরাছোঁয়ার আরও বাইরে নিয়ে গেল। ছবি: পিটিআই।

সারা পৃথিবীতে পেশাদার ক্রিকেটের অন্যতম সেরা মঞ্চ আইপিএলের ফাইনালে মাঠের মধ্যে অনেকগুলো মুহূর্ত তৈরি হল। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে শুভমন গিলের সহজতম ক্যাচ ফস্কালেন দীপক চাহার। শুভমন তখন মাত্র ৪। গেলেন ৩৯ রানে। কিন্তু ৪ এবং ৩৯-এর মধ্যবর্তী সময়ে তিনি চাবুকের মতো যে সমস্ত শট খেললেন, সেগুলো দেখার জন্য রাত জাগা সার্থক। নিজের বলে ঋদ্ধিমানের কট অ্যান্ড বোল্ডও ফস্কালেন চাহার। জীবন পেয়ে ঋদ্ধি হাফ সেঞ্চুরি মেরে গেলেন। চোখে লেগে থাকবে স্রেফ টাইমিংয়ে অজিঙ্ক রহাণের সাইট স্ক্রিনে উড়ে গিয়ে পড়া ওভার বাউন্ডারিটা। অলস শিল্পের মতো। সম্ভবত ম্যাচের সেরা শট।

কিন্তু মাঠের মধ্যে সেরা ক্রিকেটীয় মুহূর্তটা তৈরি হল, যখন সেকেন্ডের ভগ্নাংশে শুভমনকে স্টাম্প করলেন ধোনি। সামান্য, ডেলিভারিটা সামান্যই টেনে দিয়েছিলেন জাডেজা। ক্রিজ থেকে শুভমনের ব্যাকফুটের বুটটা কতটা বেরিয়েছিল? সম্ভবত কয়েক সেন্টিমিটার। ফিরে আসার আগেই বিদ্যুৎঝলকের মতো স্টাম্প ভাঙলেন ৪১ বছরের ধোনি। লোকে বলে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রিফ্লেক্স কমে যায়। কোথায় কী! সারা দুনিয়া দেখল, উইকেটের পিছনে ধোনির ক্ষিপ্রতা এখনও চিতাবাঘের মতো।

ম্যাচের বাইরের অন্যতম সেরা মুহূর্তও তৈরি হল তাঁর হাতেই। আসলে তাঁর হাতে নয়। বরং তাঁর হাত না-ছুঁয়ে। অবিশ্বাস্য ম্যাচ জিতে পঞ্চম বার আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হলেন। ছুঁয়ে ফেললেন মুম্বইয়ের রেকর্ড। কিন্তু পুরস্কার নিতে গিয়ে ট্রফিতে হাতটাও ছোঁয়ালেন না। সন্তর্পণে এক পাশে সরে গিয়ে আলোকবৃত্তের মধ্যে ডেকে নিলেন অম্বাতি রায়ডুকে। সঙ্গে জাডেজা। কেন? কেন না প্রথম জন ঘোষণা করেছেন, এই ফাইনালই আইপিএলে তাঁর শেষ ম্যাচ। সেই অন্তিম ম্যাচে ছোট কিন্তু ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে দলকে ট্রফির দিকে কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছেন। আর দ্বিতীয় জন না-থাকলে তো শেষ দু’বলে ১০ রানে ট্রফিটাই আসে না! রায়ডু-জাডেজা নেবেন না তো কি ট্রফি তিনি নেবেন? স্রেফ অধিনায়ক বলে? দলের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজেকে এগিয়ে দিলে তো তিনি নিছকই ‘অধিনায়ক’ হয়ে থাকতেন। ‘নেতা’ হতেন না। ধোনির হাতে ট্রফি— এই ফ্রেমটা সোমবার রাতে কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। বরং তার চেয়ে অনেক বেশি দেখেছি দলের কনিষ্ঠতম সদস্য শ্রীলঙ্কার তরুণ বোলার পাথিরানার হাতে।

MS Dhoni and Ravindra Jadeja

পুরস্কার নিতে গিয়ে ট্রফিতে হাতটাও ছোঁয়ালেন না। আলোকবৃত্তে ডেকে নিলেন অম্বাতি রায়ডুকে। সঙ্গে জাডেজা। ছবি: সিএসকের টুইটার থেকে।

অবশ্য ধোনির রাজত্বে সেটাই দস্তুর। ভারতের প্রাক্তন ফিল্ডিং কোচ আর শ্রীধর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, অধিনায়ক ধোনি ভারতীয় দলে একটা রীতি চালু করেছিলেন— যে কোনও ট্রফি জিতে সেটা প্রথমেই টিমের জুনিয়রতম খেলোয়াড়ের হাতে তুলে দিতে হবে। যাতে নবীনতম সদস্যও নিজেকে দলের গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ভাবতে শুরু করে। সোমবার রাতে সেই ধোনিই সম্মানের লাল কার্পেট বিছিয়ে দিলেন তাঁর দলের বিদায়ী সতীর্থ এবং জয়ের স্ট্রোক-নেওয়া সহ-ক্রিকেটারের পদপ্রান্তে।

মুহূর্ত। অন্যতম সেরা মুহূর্ত। কিন্তু ‘সেরা’ নয়।

সোমবারের গভীর রাত (না কি মঙ্গলবারের ভোররাত?) যখন মনে মনে রিওয়াইন্ড করছি, সব ছাপিয়ে ভেসে আসছে— বাঁ হাত জড়িয়ে আছে সতীর্থের ঘর্মাক্ত পিঠ। ডান হাত মাথায়। মুখ কানের কাছে। কোলের কাছে গুটিয়ে-যাওয়া, শেষ মুহূর্তের ব্যর্থতায় কুঁকড়ে যাওয়া চেহারাকে সেই ঠোঁট অস্ফুটে বলছে— ঠিক আছে। ঠিক আছে।

মনে হচ্ছিল, চুলোয় যাক বাকি সব উচ্ছ্বাস। গভীরতর রাতের গভীরতম মুহূর্ত এটাই। ব্যক্তিগত ব্যর্থতায় মরমে মরে থাকার সময়ে ওই আশ্বাসটা দরকার হয়। যিনি সেই আশ্বাস দেন, ‘অধিনায়ক’ থেকে তাঁর উত্তরণ হয় ‘মন অধিনায়ক’-এ। লেখা হয় রূপকথার পরিচ্ছেদ। যেমন লিখলেন হার্দিক পাণ্ড্য। হারেও রইলেন মহীয়ান।

একটু ভয়ই করছে। ২০২৪ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আইপিএলের মঞ্চে ফিরে এলেও এ হৃদয়ের দফতর না বদলে যায়!

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy