রঙের উৎসব, তাৎপর্য এক একজনের কাছে এক এক রকম। বন্ধুবান্ধব, হইহল্লা, রং মাখা, খানাপিনা— তাতেই যেমন কারও আনন্দ, তেমনই কেউ চান পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা বাড়তি ছুটিটুকু কাজে লাগিয়ে বসন্ত-প্রকৃতির আহ্বানে বেরিয়ে পড়তেন।
কিন্তু যাবেন কোথায়? পুরুলিয়া, বাঁকু়ড়া, সেখানে পলাশের টান আছেই। শান্তিনিকেতনের সঙ্গেও বসন্ত উৎসবের নিবিড় যোগ। তবে, এর বাইরে কাছে-পিঠে অনেক জায়গাই ঘুরে নেওয়া যায় বসন্তোৎসবে।
বড়ন্তি-গড়পঞ্চকোট
ট্রেনের টিকিট না পেলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন বড়ন্তি, গড় পঞ্চকোটের উদ্দেশ্যে। বসন্ত-প্রকৃতির এমন উজাড় করা রূপ সর্বত্র মেলে না। অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণি, সবুজ বনানী আর তারই মধ্যে প্রকৃতি আলো করে থাকা পলাশের রূপ।
বাংলা এবং ঝাড়খণ্ড সীমানায় পুরুলিয়ার নিতুড়িয়া ব্লকে পাঞ্চেত পাহাড়ের কোলে গ়ড়পঞ্চকোট। শোনা যায় গড়পঞ্চকোট এক সময় পঞ্চকোট রাজাদের রাজধানী ছিল। এখানেই রয়েছে খুব পুরনো একটি মন্দির। প্রাচীনত্বের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাঙা গড়। বর্ষায় এখানে উপভোগ করা যায় প্রকৃতির শ্যামলিমা, আর বসন্তে পলাশের চোখ ধাঁধানো রূপ। এই চত্বরেই রয়েছে একটি নজরমিনারও। গড় পঞ্চকোট থেকে ১৩ কিলোমিটার গেলে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের একটি গ্রাম হল বড়ন্তি। পাহাড় ঘেরা একটি সুন্দর জলাশয় রয়েছে এখানে। সেটি পরিচিত বড়ন্তি লেক নামে। এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য ভারি সুন্দর লাগে। হাতে দিন তিনেকের সময় থাকলেই গড়পঞ্চকোট, বড়ন্তি ঘুরে নেওয়া যায়। গড় পঞ্চকোটে থাকার হোটেল, সরকারি বিভিন্ন দফতরের পর্যটন আবাস রয়েছে। বড়ন্তিতেও হোটেল আছে। এখান থেকে ঘুরে নেওয়া যায় পাঞ্চেত, মাইথন জলাধারও। দোলের মরসুমে গড়পঞ্চকোট বা বড়ন্তিতে থাকার জায়গা না মিললে মাইথন, আসানসোলে থেকেও কিন্তু গাড়িতে এই স্থানগুলি ঘুরে আসা সম্ভব। কলকাতা থেকে গড়পঞ্চকোটের দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার। দোলের সকালে ভোর থাকতে বেরিয়ে পড়লে ঘণ্টা চার-পাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।
ঝাড়গ্রাম
কলকাতা থেকে ঘণ্টা তিনেকেই পৌঁছে যেতে পারেন ঝাড়গ্রাম। ভোরে গিয়ে সারা দিন ঘুরে ফিরে আসা যায় রাতেও। শাল-পিয়ালের জঙ্গলের ঘেরা ঝাড়গ্রামের বনভূমি, কনক দুর্গার মন্দির, ডুলুং নদী, অনেক কিছুই দেখার আছে এখানে। কেউ কেউ এক রাত ঝাড়গ্রামে কাটিয়ে পরদিন বেলপাহাড়ির দিকেও চলে যান। অরণ্যের গা দিয়েই গিয়েছে পিচ ঢালা কালো মসৃণ রাস্তা। তবে বনভূমির রূপ উপভোগ করতে পিচ রাস্তা ছেড়ে ডাঁয়ে, বাঁয়ে চলে যাওয়া মোরাম বিছানো পথেও যেতে পারেন। তবে সাবধান, এখানে মাঝেমধ্যেই হাতি আসে। স্থানীয়েরা সে সব খবর রাখেন। তাই তাঁরা যদি সাবধান করেন, অবশ্যই তাঁদের কথা মানতে হবে।
ঝাড়গ্রামে থাকার জন্য বনোন্নয়ন নিগমের পর্যটক আবাস রয়েছে। আছে হোটেলও। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতেও অগ্রিম বুকিং করলে থাকার সুযোগ মিলতে পারে।
বৃন্দাবনপুর
শাল-সেগুনের বন। ফুটে থাকা পলাশের টানে বসন্তে যাওয়া চলে বৃন্দাবনপুরে। বাঁকুড়ার বড়জোড়া ব্লকের বৃন্দাবনপুর নিয়ে ইদানীং উৎসাহ তৈরি হচ্ছে পর্যটকদের। বিশেষত যাঁরা চেনা ছকের বাইরে নতুন জায়গায় ঘুরতে চান, তাঁদের ঠিকানা হতে পারে বৃন্দাবনপুর। জঙ্গলঘেরা গ্রামে পর্যটকদের জন্য তৈরি হয়েছে একটি পরিবেশবান্ধব আস্তানাও। দেখার জায়গা বলতে শুধুই প্রকৃতি। শাল, সেগুনের বন। তবে বসন্তে এ জঙ্গলের রূপও বদলায় পলাশ ফুটলে। কাছেই রয়েছে সোনামুখি-পাথরা নজরমিনার। সেখান থেকে দূরদূরান্ত পর্যন্ত জঙ্গলের রূপ উপভোগ করা যায়। এ ছাড়া দেখে নিতে পারেন বিষ্ণপুর দুর্গের ভগ্নাবশেষ। গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসা যায় মদনমোহন মন্দির, গড় দরওয়াজা, রাসমঞ্চ।
কলকাতা থেকে গেলে বৃন্দাবনপুরের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারের মতো। হাতে এক বা দু’দিন রাখলেই ঘুরে আসা যাবে সেখান থেকে।
গড়জঙ্গল
সকালে বেরিয়ে যদি আবার সে দিনই ফিরতে চান, তা হলে যেতে পারেন গড়জঙ্গল, ইছাই ঘোষের দেউল। বর্ধমানের গৌরাঙ্গপুরের অজয় নদীর তীরে পুরনো দেউল। স্থানীয়েরা বলেন, রাঢ় বাংলার সামন্ত ছিলেন ইছাই ঘোষ। তিনি এটি তৈরি করেন। তবে শুধু দেউল নয়, দোলের দিনে এমন জায়গা বেছে নেওয়ার কারণ ভিন্ন। পশ্চিম বর্ধমানের পথে পড়ে গড়জঙ্গল। শালের গহীন অরণ্য। দেউল যাওয়ার সময় এই বনভূমি এবং সেখানে ফুটে থাকা পলাশের রূপও উপভোগ করতে পারবেন পর্যটকেরা। গড়জঙ্গলের প্রকৃতি ভুলিয়ে দেবে শহুরে ক্লান্তি। জঙ্গলের ভিতরে রয়েছে শ্যামরূপা মন্দির। ঘুরে নেওয়া যায় মেধস আশ্রম। শোনা যায়, এখানে রাজা সুরথ দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। সেই পুজো এখনও হয়ে আসছে।
কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস হয়ে পানাগড়। সেখান থেকে কাঁকসার দিকে এগিয়ে পানাগড়-মোড়গ্রাম সড়ক ধরে যেতে হবে গড়জঙ্গল। জায়গাটি পড়ে পশ্চিমবর্ধমানের কাঁকসা ব্লকে। দুর্গাপুর থেকে দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে দূরত্ব ১৭৭ কিলোমিটার।