Advertisement
E-Paper

বহু ধারা মেলে প্রয়াগসঙ্গমে

প্রয়াগ স্থান-মাহাত্ম্য বর্ণনায় হিন্দু, অহিন্দু, সবাই বার বার মুগ্ধ। সমুদ্র-রূপ কুম্ভের মন্থন করে অমৃত সংগ্রহ বহুলপ্রচলিত। আসলে, প্রয়াগ শব্দের আক্ষরিক অর্থ, ‘প্র’+‘যাগ’ অর্থাৎ প্রকৃষ্ট যজ্ঞ।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫ ০৭:২৫
Share
Save

মহাকুম্ভে পুণ্যস্নান করা মানুষের সংখ্যা নিয়ে আস্ফালন, এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে প্রধানত উদ্‌যাপনের উচ্ছ্বাস বা কোনও পক্ষের কুম্ভের সঙ্গে অন্য মেলার তুলনা টানা— এই তিন প্রবণতা আমরা দেখলাম। কিন্তু এ সবের ঊর্ধ্বে রয়ে গেল আর একটা কথা। প্রয়াগরাজ, কুম্ভমেলা এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সঙ্গম-সহ স্থানগুলিতে আদতে যুগ যুগ ধরে স্থান পেয়েছে নীরব তীর্থযাত্রীদের বহুত্ব। স্থান-মাহাত্ম্য, মহামানবদের যোগসূত্র এবং শাসকের আকর্ষণ— এই তিন সূত্রে বহুত্বের স্বরটি আমরা খুঁজতে পারি।

প্রয়াগ স্থান-মাহাত্ম্য বর্ণনায় হিন্দু, অহিন্দু, সবাই বার বার মুগ্ধ। সমুদ্র-রূপ কুম্ভের মন্থন করে অমৃত সংগ্রহ বহুলপ্রচলিত। আসলে, প্রয়াগ শব্দের আক্ষরিক অর্থ, ‘প্র’+‘যাগ’ অর্থাৎ প্রকৃষ্ট যজ্ঞ। প্রয়াগ স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মার ক্ষেত্র বা যজ্ঞবেদি। ঋগ্বেদে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গম, ‘পদ্মপুরাণ’, ‘মৎস্যপুরাণ’-সহ নানা পুরাণ, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’-এও স্থানটির উল্লেখ আছে বার বার। প্রয়াগ-সঙ্গম তীর্থরাজ, কারণ ত্রিলোকে যত তীর্থ আছে, তা মাঘ মাসে বেণীমাধবের সন্তোষের জন্য মিলিত হয়— যে বেণীমাধব বা বিষ্ণু হলেন সব তীর্থের রাজা। প্রয়াগের ‘নগর দেবতা’ বেণীমাধবের সূত্রে ১২টি মাধব-মূর্তির নাম পাওয়া যায়। তার মধ্যে আদি বেণীমাধব জলব্রহ্ম স্বরূপে সঙ্গমে এবং অনন্তমাধব অক্ষয়বটের কাছে অবস্থান করছেন। এখানেই উপস্থিত হয়ে মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রম রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে দেখাচ্ছেন, এমন বর্ণনা রয়েছে বাল্মীকির ‘রামায়ণ’-এ, তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’-এও।

পাশাপাশি, মেগাস্থিনিস থেকে আল-বেরুনি, সবার বর্ণনাতেই প্রয়াগ হল তীর্থস্থান। পরিব্রাজক হিউয়েন সাংয়ের বিবরণেও রয়েছে সঙ্গম, অক্ষয়বটের কথা। আবার বদায়ুনি বলছেন, ১৫৭৪-এ আকবর ত্রিবেণী সঙ্গমে এসে দেখলেন হিন্দুরা বৃক্ষ (অক্ষয়বট) থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে দেহত্যাগ করছেন। মার্ক টোয়েন বোধ হয় এমন বিস্ময়কর ঐতিহ্যের জন্যই প্রয়াগকে বলেছেন ‘ঈশ্বরের শহর’।

এমন স্থান-মাহাত্ম্যের জন্যই এখানে বার বার মহামানবদের পা পড়েছে। কথিত, এখানে ধর্মপ্রচার করতে এসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। আবার, মাঘ মাসেই প্রয়াগে এসে দশ দিন ধরে মকর স্নান করেছেন চৈতন্যদেব। শুধু তা-ই নয়, সঙ্গমের অদূরে প্রয়াগের দশাশ্বমেধ ঘাটে রূপগোস্বামীকে ভাগবত শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। বেণীমাধব মন্দিরের ফলকে এখনও লেখা, চৈতন্যদেব এখানে সঙ্কীর্তন করেছিলেন। তবে চৈতন্যদেব মাঘ মাসে প্রয়াগে এলেও, তা কুম্ভমেলার সময়েই কি না, সেটা নিশ্চিত নয়। কুম্ভমেলার অতীত-সম্পৃক্ততা মাঘমেলাকে কেন্দ্র করে। মহামহোপাধ্যায় উমেশ মিশ্র প্রমাণ করেছেন, ‘পুরাণে কুম্ভ-যোগের কোনও চর্চা নেই’। বড় অংশের মতে, শাস্ত্রে মাঘমেলায় যে ‘কুম্ভ-যোগ’, তার রূপকার আদি শঙ্করাচার্য।

সম্ভবত জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র, ভৌগোলিক অবস্থান, সামরিক কারণ এবং আধ্যাত্মিক ‘অধিকার’-এর জন্য প্রয়াগের আকর্ষণ এড়াননি শাসকেরাও। হিউয়েন সাংয়ের বিবরণ থেকে তর্কসাপেক্ষ ভাবে জানা যাচ্ছে, সম্রাট হর্ষবর্ধন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে ধন-রত্ন বিতরণ করতেন। হর্ষবর্ধনের পূর্বপুরুষেরা শৈব, বাবা সৌর, বড় ভাই ও বোন বৌদ্ধ উপাসক। হর্ষ শেষ বয়সে বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়েছিলেন।

পরে মরাঠা থেকে মোগল শাসকদেরও আগ্রহের অন্যতম জায়গা সঙ্গম। সেখানে ইলাহাবাদ দুর্গের নির্মাণ করেছিলেন খোদ আকবর। তিনিই প্রয়াগের নাম রেখেছিলেন ইলাহাবাস, অর্থাৎ সর্বশক্তিমানের আবাস। শব্দটির অর্ধেক আরবি, অর্ধেক সংস্কৃত। আকবর এই কেল্লা তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন ঝুসির হিন্দু রাজাকে। কেল্লাটি সঙ্গমের অক্ষয়বটকে ঘিরে ছিল, পরে যার অবস্থান কিঞ্চিৎ বদলেছে। কিন্তু বদলায়নি জনশ্রুতি, যার কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি না থাকলেও, বহুত্বের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। এখনও গাইডদের মুখে শোনা যায় জনশ্রুতিটি— তপস্বী মুকুন্দ ব্রহ্মচারী অক্ষয়বটের কাছে বাস করতেন। এক দিন দুধ পান করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবে গরুর একটি লোম গিলে ফেলেন তিনি। প্রায়শ্চিত্তের জন্য তিনি অক্ষয়বট থেকে নদীতে ঝাঁপ দেন এবং শেষ মুহূর্তে ‘শ্রেষ্ঠ যবন’ হিসেবে পুনর্জন্মের প্রার্থনা করেন। মুকুন্দের এক শিষ্যও গুরুর সহগমন করেন। বিশ্বাস, মুকুন্দই পরজন্মে আকবর, আর মুকুন্দের ওই শিষ্য বীরবল! প্রসঙ্গত, ঔরঙ্গজেবকে নিয়েও একটি জনশ্রুতি প্রচলিত। জনশ্রুতি, কুম্ভে বাঘাম্বরী মঠের জন্য জমি দান করেছিলেন ঔরঙ্গজেব।

সঙ্গমে আত্মাহুতির প্রচলন ছিল। কালিদাসের ‘রঘুবংশম্’-এও বলা হচ্ছে, ‘সমুদ্রপত্নী গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থলে অবগাহনপূর্বক দেহত্যাগ করেন যাঁরা, তাঁরা তত্ত্বজ্ঞান ছাড়াই পুনর্জন্ম থেকে নিবৃত্তি পান।’ এই আত্মাহুতিকে কিছুটা তরল ভাবে দেখে চৈতন্য-প্রভাবিত বাংলায় জন্ম নিয়েছে প্রবাদ, ‘প্রয়াগে মুড়াইয়া মাথা।/ মরগে পাপী যথা তথা।’

এমন তীর্থরাজে নানা ধারার সাধক-সম্প্রদায়, দেশ-বিদেশের তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে থাকেন শিখরাও। স্বয়ং গুরু নানকের পুত্র শ্রীচাঁদের প্রবর্তিত উদাসী সম্প্রদায়, শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিংহের প্রবর্তিত শিখ সম্প্রদায়ের বহু মানুষ কুম্ভমেলায় যোগ দেন। বহুত্বের এমন স্বর প্রয়াগের প্রায় ৮০০টি তীর্থ-পুরোহিত পরিবারের মধ্যেও আছে। মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব, গুজরাত, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, কাশ্মীর ইত্যাদি অঞ্চলের প্রতিটি পরিবারের স্বতন্ত্র প্রতীক আছে তীর্থ-পুরোহিত হিসেবে।

কুম্ভ-কথার এমন বিচিত্রচারী বহুত্বের জন্যই হয়তো তাই সরস্বতী-কুণ্ডের দিকে তাকিয়ে দেবীর কাছে কোনও সন্ন্যাসী নিয়ত প্রার্থনা করে চলেন— ‘...অপ্রশস্তা ইব স্মসি প্রশস্তিম্ অম্ব নস্ কৃধি।’ (ঋগ্বেদ, ২.৪১.১৬) অর্থাৎ হে দেবী, আমরা বড়ই অপ্রশস্ত, আমাদের প্রশস্তি দিন। এই প্রশস্তি-প্রার্থনাই কুম্ভমেলার বহুত্বের আধার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kumbh Mahakumbh 2025

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}