অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস (২০১৯) গ্রন্থে কর্মহীন দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। অওধের নবাব শাহাবুদ্দিন আসাফ-উদ-দৌল্লা অনাহারক্লিষ্ট প্রজাদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে লখনউয়ের বড়া ইমামবড়া নির্মাণের কাজ শুরু করেন ১৭৮৪ সালে। এই নির্মাণ চলে দীর্ঘ দিন ধরে। তার একটি বিশেষ কারণ ছিল। গরিব নিম্নবিত্তের মানুষেরা সকলেই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন, কিন্তু সমস্যা হল দুর্ভিক্ষপীড়িত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষদের নিয়ে। তাঁদের পক্ষে সামাজিক লজ্জা অতিক্রম করে, হতদরিদ্র প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে এই কাজে যোগ দেওয়া ছিল যেমন অসম্ভব, তেমনই শর্তসাপেক্ষ অর্থ জোগানের অন্য কোনও পথও নবাবের জানা ছিল না।
নবাব এই সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা চালু করলেন। ঠিক হল, দিনের বেলায় দরিদ্র মানুষেরা নির্মাণ কাজ করবেন, এবং নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক পাবেন। রাতের অন্ধকারে নির্মাণ ভেঙে ফেলার কাজ জুটল সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষদের। যে হেতু সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের সংখ্যা দরিদ্র মানুষের তুলনায় একেবারেই নগণ্য, তাই ধীর গতিতে হলেও এগিয়ে চলল এই নির্মাণকাজ। নির্মাণ শেষ হতে সময় লেগেছিল স্বাভাবিক সময়ের থেকে অনেক বেশি, প্রায় দশ বছর।
গরিব মানুষের জন্য উপার্জনের এই যে ব্যবস্থা, এটা শর্তসাপেক্ষ টাকা হস্তান্তর। এখনও আমরা বড় ব্যাপ্তি নিয়ে টাকা হস্তান্তরের যে সব প্রকল্প দেখে অভ্যস্ত, তা মূলত শর্তসাপেক্ষ টাকা হস্তান্তর। যেমন, জননী সুরক্ষা যোজনা, যা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান প্রসবের জন্য নির্দিষ্ট। আবার, প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা যোজনা, যা আমাদের দেশে চালু হয়েছে ২০১৭ সালে। গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়েরা নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে এই প্রকল্পের সুযোগ নিতে পারবেন। মেয়েদের লেখাপড়া শেখাকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পটিও শর্তসাপেক্ষ টাকা হস্তান্তর প্রকল্প।
কিন্তু আমাদের রাজ্যে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটি চরিত্রে অন্য রকম। পরিবারের কর্ত্রীর নিশ্চিত আয়ের লক্ষ্যে গত ১ সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকার লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প চালু করে। এর বিশেষত্ব হল, এটি একটি শর্তহীন টাকা হস্তান্তর প্রকল্প। এ রাজ্যে বসবাসকারী প্রায় এক কোটি ষাট লক্ষ পরিবারের মহিলা প্রধান এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী হবেন। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক তাদের একটি প্রতিবেদনে জানায় যে, পৃথিবীর ১১৯টি দেশে এই ধরনের শর্তহীন টাকা হস্তান্তরের কোনও না কোনও প্রকল্প চালু আছে।
এই ধরনের টাকা হস্তান্তর প্রকল্পের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রশ্ন হল, কত টাকা খরচ হবে আর টাকা আসবে কোথা থেকে। এ বারের বাজেটে রাজস্ব খাতে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের জন্য ৭,০০০ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। রাজ্যের এই খাতে বার্ষিক আনুমানিক ব্যয়ের পরিমাণ ১২,০০০ কোটি টাকা। এই টাকা খরচ করার সাধ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে পরিসংখ্যান। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, রাজ্যের রাজকোষে ইতিমধ্যেই বেশ খানিক ঘাটতি রয়েছে, এবং লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্প চালাতে হলে সেই ঘাটতির পরিমাণ নিশ্চিত ভাবেই আরও বাড়বে। অর্থাৎ, প্রকল্পটি চালাতে হলে রাজ্য সরকারকে আরও ঋণ করতে হবে। গৃহস্থের পক্ষে ঋণ করে ঘৃত পান অবশ্যই নিন্দনীয়, কিন্তু সরকারের ক্ষেত্রে সর্বদা সে নিয়ম খাটে না। রাজকোষে ঘাটতি সত্ত্বেও কিছু কিছু খরচ করা সরকারের কর্তব্য, এবং তাতেই মানুুষের লাভ। লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটি চরিত্রে তেমনই কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে দুটো কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন— এক, মাথাপিছু ধারের হিসাবে দেশের বড় রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান একাদশতম। দ্বিতীয় কথা হল, রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে মোট বকেয়া ঋণের অনুপাত কমছে। এ বছরের মার্চ মাসের হিসাব অনুযায়ী, রাজ্যের বকেয়া ঋণের পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৩৪.৭%। এটি সর্বোচ্চ ছিল ২০০৬ সালে, ৪৯.৭ শতাংশ। অর্থাৎ, সরকার চাইলে লক্ষ্মীর ভান্ডােরর মতো প্রকল্পে টাকা খরচ করার উপায় আছে। প্রশ্ন হল, তার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না।
মর্গান হাউসেল-এর সম্প্রতি প্রকাশিত সাইকোলজি অব মানি: টাইমলেস লেসনস অন ওয়েলথ, গ্রিড অ্যান্ড হ্যাপিনেস বইটিতে লেখক লিখছেন যে, পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র মানুষেরা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করেন লটারি টিকিট কেনার জন্য। ওঁরা এ-ও জানেন যে, লটারিতে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। মর্গান হাউসেল বলছেন, ওই গরিব লোকেরা আসলে লটারি টিকিট কেনেন না, ওঁরা লটারি টিকিটের মাধ্যমে স্বপ্ন কেনেন। এই স্বপ্নই হল ওঁদের চালিকাশক্তি। অর্থনীতির যাবতীয় হিসাব, যুক্তি-তর্ক পেরিয়ে মনে হয়, আমাদের রাজ্যের লক্ষ্মীর ভান্ডারও শুধুমাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা নয়। গরিব মহিলাদের কাছে এ এক স্বপ্নমালা। প্রকল্পটির ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই আমাদের রাজ্যে গরিব মহিলাদের মধ্যে দেখছি এক দারুণ উন্মাদনা। তাঁদের জীবনে না ছিল নতুন কিছু ভাবার সুযোগ, না কোনও নতুন স্বপ্ন— প্রায় গুরুত্বহীন জীবন।
মুহূর্তের ঘোষণায় শুরু হয়ে গেল স্বপ্নের জাল বোনা। বাড়িতে অসুস্থ নাতনিকে ভাল ডাক্তার দেখানো, দুটো ছাগল কিনে পোষা, ছেলেকে চারটে মুরগি আনতে বলা, উৎসবে সবাইকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেওয়া— আরও কত কী।
সম্প্রতি কালনা মহকুমার সমুদ্রগড়ে দেখা হল ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে ফিরছেন এমন কয়েক জন মহিলার সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলাম, টাকা পেলেন, এখন কী করবেন টাকা দিয়ে? মুখে একগাল হাসি। সবার উত্তরই প্রায় একই রকম— অনেক কিছুই তো ভেবেছি।
বিশ্বাস দৃঢ় হল, সরকার লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে টাকা নয়, ট্রান্সফার করছে একগুচ্ছ স্বপ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy