নিশ্চিন্ত?: প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সরানোর পর বিদ্রোহীদের জয়োৎসব, দামাস্কাস, ১৩ ডিসেম্বর। ছবি: রয়টার্স।
এই তো সে দিন ২৭ নভেম্বর আবু মহম্মদ আল-জুলানির নেতৃত্বাধীন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামক বাশার আল-আসাদ সরকার-বিরোধী দেশের অন্যতম প্রধান বিদ্রোহী গোষ্ঠী রাজধানী দামাস্কাস থেকে অন্তত হাজার কিলোমিটার দূরে নিজেদের ঘাঁটি গেড়ে ছিল। অথচ, এর মাত্র দিন দশেকের মধ্যে ৮ ডিসেম্বর এই বিদ্রোহীরা প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ আলেপ্পো শহর ও নিকটবর্তী এলাকা দখল করে হমস এবং হামা দখলের পরে রাজধানী শহরের নিয়ন্ত্রণও রীতিমতো নাটকীয় কায়দায় নিজেদের দখলে নিয়ে ফেলেছে। এই বিদ্রোহীদের সামরিক নৈপুণ্য ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জোরে কার্যত বিনা প্রতিরোধে প্রেসিডেন্ট আসাদ তাঁর সিকি শতকের রাজত্ব ছেড়ে আকাশপথে দেশ ছেড়ে পালিয়ে তাঁর সরকারের দীর্ঘ দিনের বন্ধু রাশিয়াতে আশ্রয় নিয়েছেন।
এইচটিএস-এর এই চকিত যুদ্ধজয় গোটা বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার উপরে ইউক্রেন যুদ্ধের চাপ বা অন্য বন্ধু ইরানের ইজ়রায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ার পরিস্থিতিতে সে ভাবে নজর দিতে না পারায় এবং লেবাননের হিজ়বুল্লা গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতৃত্ব অতর্কিতে ইজ়রায়েল নির্মূল করার ফলে প্রবল পরাক্রমশালী আসাদ সরকার বিদ্রোহীদের অভূতপূর্ব অভিযানের ফলে কার্যত অসহায় হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় আসাদ সরকারের ধারাবাহিক বিরোধী কণ্ঠস্বর রোধ করার প্রয়াসে জেরবার, সরকারি নিগ্রহ ও নৃশংস অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষ দীর্ঘ এই স্বৈরাচারের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে স্বভাবতই উল্লসিত। সেই উল্লাসের প্রকাশ সর্বত্র।
কিন্তু প্রশ্ন হল— এই চোখধাঁধানো জয়ের পর বিজিত এলাকাগুলির অধিবাসীদের একত্রিত করে সুসংহত শাসন প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, কুশলতা এবং সহিষ্ণুতা। সদ্য ক্ষমতাসীন এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতৃত্বের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলি আছে তো?
সিরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আল বশির ইটালির এক সাংবাদিককে জানিয়েছেন যে, তাঁর সরকারের প্রথম লক্ষ্য হবে দ্রুত দেশের শহরগুলিতে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। অন্তর্বর্তী সরকার একই সঙ্গে আগ্রহী বিপুলসংখ্যক সিরীয় উদ্বাস্তুকেও দেশে ফেরাতে। আগ্রহী, সিরিয়াতে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে।
কিন্তু এক দিকে অবিলম্বে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, আর অন্য দিকে অতীতের ‘অপরাধী’দের খুঁজে বার করে তাঁদের শাস্তি দেওয়া, এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য গড়ে তোলা মোটেই সহজ কাজ নয়। আসলে কোনও অন্যায্য ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলা তুলনায় সহজ। পরমতসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষবিহীনতার ভিত্তিতে সর্বব্যাপী বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা যে কতটা কঠিন, সাম্প্রতিক কালে শেখ হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
সিরিয়ার মোট দু’কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই আরব মুসলমান। কুর্দ সম্প্রদায়ের মানুষ ৯ থেকে ১০ শতাংশ। এ ছাড়াও তুর্কি ৪ শতাংশ, অ্যাসিরীয় ৩ শতাংশ, আর্মেনীয় ২ শতাংশ। রয়েছেন আলবেনীয়, গ্রিক ও চেচেন সম্প্রদায়ের মানুষ। বৈচিত্র অন্যত্রও— সুন্নিরা যেখানে মোট জনসংখ্যার অন্তত ৩১ শতাংশ, সেখানে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ প্রায় ১৭ শতাংশ। এ ছাড়াও আছেন দ্রুজ়, ইসমাইলি, ইয়াজ়িদি গোষ্ঠীর মানুষ। রয়েছেন খ্রিস্টান ও ইহুদিরাও।
বস্তুত, বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানুষের ধারাবাহিক অভ্যাগমন তাঁদের এই অঞ্চলকে দখল ও নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস বিগত সাড়ে পাঁচ হাজার বছরে এই এলাকার জনবৈচিত্র বাড়িয়েছে। আলেকজ়ান্ডারই হোন, বা রোমান, বাইজ়ান্টাইন কিংবা অটোমান সাম্রাজ্য, প্রভাব পড়েছে সবার সব অভিযানেরই। মোঙ্গল বা তুর্কিদের আগমন ঘটেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে বর্তমানের রাজধানী দামাস্কাস ব্রিটিশ ও আরব সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৯২০-তে এই অঞ্চলের বেশির ভাগ ফরাসিদের দখলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পরে অবশেষে ১৯৬৪ সালে ফরাসি সৈন্য এখান থেকে প্রত্যাহারের পরে সিরিয়া স্বাধীনতা পায়।
কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যুত্থান এই আরব দেশটির নিত্য সঙ্গী। এমনই এক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ১৯৭০-এর নভেম্বরে সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করেন হাফেজ় আল-আসাদ। পরের বছরে তিনি দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। তার পরে পাঁচ দশকেরও বেশি পরিবারতন্ত্র। আর তার সঙ্গী বিরোধী, বিদ্রোহী বা প্রতিবাদীদের উপরে নৃশংস অত্যাচার। হাফেজ়ের মৃত্যুর পরে যখন তাঁর অন্যতম পুত্র এবং এক সময়ে লন্ডনে পেশাগত ভাবে দন্ত চিকিৎসক বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আসেন, তখন অনেকের প্রাথমিক ভাবে তাঁকে নরমপন্থী ও অপেক্ষাকৃত সহিষ্ণু মনে হয়েছিল। পাশ্চাত্যে তাঁর প্রশিক্ষণ হয়তো মানুষের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করেছিল। তবে অচিরেই এই ভ্রান্তি দূর হয়।
২০১১-তে টিউনিশিয়া এবং মিশরের পর যখন ‘আরব বসন্ত’-এর জোয়ার সিরিয়াতে এসে পৌঁছয়, বাশারের সরকার আন্দোলনকারীদের উপরে দমন-পীড়নকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, সেই থেকে দেশব্যাপী গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ-যাবৎ নিদেনপক্ষে ছয় লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছেন। নিজভূমে পরবাসী হতে হয়েছে অন্তত সত্তর লক্ষ মানুষকে। আরও অন্তত ষাট লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে তুরস্ক, জর্ডন বা লেবাননের মতো প্রতিবেশী দেশে আশ্রিত। এই উদ্বাস্তুদের অন্তত অর্ধেকই তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন। অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল জার্মানির চ্যান্সেলর থাকাকালীন তাঁর সরকারের অপেক্ষাকৃত নমনীয় মনোভাব ইউরোপের এই দেশটিতেও সিরীয় ছিন্নমূল অনেক মানুষ আশ্রয় পেয়েছিলেন। তবে সিরিয়াতে এই অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক পর্বান্তর এই মুহূর্তে জার্মানি বা অস্ট্রিয়ার মতো দেশে নতুন আশ্রয়প্রার্থী সিরীয়দের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে।
বছর বিয়াল্লিশের জুলানির অতীত নজরে আসবেই। সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করা জুলানির আল-কায়দা এবং ইসলামিক স্টেট-এর মতো সংগঠনের সঙ্গে বা আবু বকর আল-বাগদাদি’র মতো তাত্ত্বিকদের সঙ্গে পূর্ব ঘনিষ্ঠতা সিরিয়া তার পরবর্তী ভূমিকা সম্পর্কে সংশয় আপাতত রাখবেই। জুলানি তাঁর নাম (সাবেক আহমেদ আল-শারা) এবং পোশাক পাল্টালেও তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কি সত্যিই রূপান্তর ঘটেছে? উগ্রায়নের পথ সম্পূর্ণ ভাবে পরিহার করতে কি তিনি প্রস্তুত?
অন্য দিকে, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে প্রায় আট দশক আগে সিরিয়ার মুক্তি ঘটলেও বহিঃশক্তির অযাচিত প্রভাব অব্যাহত ছিল। এই মুহূর্তে রাশিয়ার অপসরণ ঘটলেও মস্কো সিরিয়াতে তার আমেরিকার নৌ ও বিমানঘাঁটির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমেরিকায় দ্বিতীয় বারের জন্য সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন যে, সিরিয়ার বিষয়ে আমেরিকার আগ্রহ নেই। বিষয়টি সিরিয়ার নিজস্ব। কিন্তু সুযোগসন্ধানী ইজ়রায়েল সরকার এই সুযোগে সিরিয়ার সামরিক শক্তিকে অকেজো করতে রাসায়নিক ও অন্য অস্ত্রের ঘাঁটিগুলিকে বারংবার আক্রমণ করে গেছে। গোলান হাইটস-এর নিরস্ত্রীকৃত এলাকাও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের কাতর আবেদন সত্ত্বেও জেরুসালেমের কর্মসূচি বদলায়নি।
এই প্রেক্ষাপটে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব পারের উত্তর-পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। ইজ়রায়েলের বিভিন্ন প্রতিস্পর্ধী আরব দেশের পিছু হটা এবং বহিঃশক্তিগুলির আপাত অনাগ্রহ ইজ়রায়েলের কর্তৃত্ব বাড়িয়েছে। সিরিয়ার আশু পুনর্গঠনে বিপুল পুঁজি-প্রত্যাশী ভারপ্রাপ্ত সংস্কার প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিকে অতিক্রম করে এই অস্পৃশ্য সিরিয়ার বৈচিত্রের পুনরুদ্ধার করতে পারবে, না নতুন মেজাজে প্রত্যাঘাতের রাজনীতিতে আশ্রয় নেবে, সমগ্র পৃথিবীর নজর থাকবে সেই দিকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy