E-Paper

আরশিনগরে পড়শির বসত

বাস থেকে নেমে ঘাটে যেতেই খবর পেলাম— দুপুরবেলায় একমাত্র মাঝির পিতৃবিয়োগ হয়েছে, তাই সে দিনের মতো নদী পারাপার বন্ধ। শীতের গাঢ় সন্ধ্যা, ফেরার উপায় নেই, কী করব, কোথায় থাকব—

পলাশ পাল

শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৭
Share
Save

তিন দশক আগে, ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে, এক মুমূর্ষু নিকটাত্মীয়ের ডাকে বাংলাদেশ যেতে হয়েছিল। গন্তব্য ছিল পিরোজপুর জেলার সোহাগদল গ্রাম। দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষ বেলায় পেরোতে হয় ‘সন্ধ্যা নদী’। কিন্তু বাস থেকে নেমে ঘাটে যেতেই খবর পেলাম— দুপুরবেলায় একমাত্র মাঝির পিতৃবিয়োগ হয়েছে, তাই সে দিনের মতো নদী পারাপার বন্ধ। শীতের গাঢ় সন্ধ্যা, ফেরার উপায় নেই, কী করব, কোথায় থাকব— এই সাত-পাঁচ ভাবনায় যখন অস্থির, তখনই হাজির হল এক কিশোর। নাম হামিদ। বলল, “রাতটা আমগো বাসায় কাটায়ে দেন ভাইজান।” বাবা নেই, বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ছোট একটি বাড়িতে হামিদের বাস, দারিদ্রের ছাপ সর্বত্র। তার বৃদ্ধা মা বললেন, “অসুবিধা কী বাবারা, আপনাগো সেবা করতে পারলে অনেক সওয়ার হবে।” বললাম, আমরা কিন্তু হিন্দু। উত্তরে তিনি বললেন, “ও বাপজান, এতে তো মোর আরও বেশি সওয়ার হবে। বিপদে পড়া মানুষরে আশ্রয় দিলে আল্লাপাক খুশি হন।” মনে করিয়ে দিই, তখন সদ্য ধ্বংস হয়েছে বাবরি মসজিদ— এ পারের সাম্প্রদায়িক উত্তাপের আঁচ ও পারেও পৌঁছেছিল যথেষ্ট।

২০১৫-র পুজোর ছুটিতে বরিশাল শহরে বেড়াতে এসেছি। এক দিন বিকেলে ডোর বেল বেজে উঠল, দরজা খুলতেই দেখি ৮-১০ জন লোক দাঁড়িয়ে, কয়েক জনের মুখে দাড়ি, মাথায় ফেজটুপি। সে রকমই এক জন তরুণ জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ফ্ল্যাটে হিন্দু পরিবার কারা আছে?” প্রথমে একটু ভয় লাগল, তার পর শুনি তাঁরা বলছেন, “ওয়র্ড কাউন্সিলার (যিনি সেই সময়ের বিরোধী দলের এক জন স্থানীয় নেতা এবং ধর্মে মুসলমান) লক্ষ্মীপুজোয় নাড়ু করার জন্য নারকেল, চিনি এবং কিছু ফল-মিষ্টি পাঠিয়েছেন।”

সম্প্রতি বাংলাদেশে উপর্যুপরি সংখ্যালঘু নির্যাতন, ভারতীয় পতাকার পদদলন থেকে শুধুমাত্র ‘ভারতীয়’ ও ‘হিন্দু’ পরিচয়ের কারণে এক জন ভারতীয় নাগরিকের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আমাদের যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। কিন্তু এগুলি দিয়ে সামগ্রিক বাংলাদেশকে দেখার চেষ্টা করা হলে সেটা হবে নিশ্চিত ভাবেই একটা খণ্ডচিত্র। সম্প্রীতি ও সৌহার্দের নিদর্শন, পারস্পরিক সহাবস্থান বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে আবহমান কাল ধরেই রয়েছে। এগুলিকে অস্বীকার করা হবে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা। বার বার এই সংস্কৃতির উপরে আঘাত এসেছে, কিন্তু মূল সুরটি কখনও মিলিয়ে যায়নি। বরং যত বার আঘাত এসেছে, তত বারই সে এক নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

শেখ হাসিনার পতনের পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে মাথাচাড়া দিয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদ ও উগ্রপন্থী সংগঠনগুলি। পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট দুষ্কৃতীরা। এ ছাড়াও রয়েছে কর্পোরেট পুঁজির লাভ-ক্ষতির হিসাব। এই রকম অরাজক ও অ-গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে, সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশের স্বার্থই বিপন্ন হয়, তারাই হয় ক্ষমতাবানদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। সমাজের মধ্যে সহাবস্থানের যে-সমস্ত বস্তুগত ভিত্তি থাকে, তাকে সমূলে নষ্ট করে দিতে চায় তারা। এই দুর্বল অংশের মধ্যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ও নারী যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় ও মতাদর্শগত সংখ্যালঘু শ্রেণি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আহমদিয়া ইসলাম ও সুফি ইসলাম-সহ উদারপন্থীরাও নানা ভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছে মন্দির, (আহমদিয়া) মসজিদ, মাজার থেকে বাউল-ফকিরের মেলার মতো সাংস্কৃতিক অঙ্গন।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে উগ্র ভারতবিরোধী রাজনীতির হাওয়া বইছে, সেটার পিছনে কট্টরপন্থীদের মদত রয়েছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, সেখানকার উদারপন্থীদেরও একটা বড় অংশ কিন্তু ভারতের বাংলাদেশ নীতির কঠোর সমালোচক। এই উদারপন্থী ও মুক্তমনা নাগরিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম ধারক, এবং বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষের শক্তি। তাঁদের অভিযোগ, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলিতে নয়াদিল্লির প্রধান উদ্দেশ্য হল বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে নিজের আধিপত্য কায়েম করার প্রবণতা। বিশেষত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে ভারতের রয়েছে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক স্বার্থ, এগুলি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রায়শই ভারত এই সব দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশের মতো ভারতের প্রতিবেশী নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মলদ্বীপেও মাঝেমধ্যে এই ভারতবিরোধী রাজনীতির স্ফুলিঙ্গ তীব্র হয়ে ওঠে। তবে উদারপন্থীরা স্পষ্ট বলে থাকেন যে, তাঁদের কাছে ভারত-বিরোধিতা মানে নয়াদিল্লির সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধিতা, যার সঙ্গে ভারতের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে তাঁরা যথার্থই আগ্রহী। তাঁরা মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত ‘ন্যায্যতা ও সমমর্যাদা’, যেটা দিল্লি বরাবরই উপেক্ষা করে এসেছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে নয়াদিল্লির উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে, গণতান্ত্রিক পরিবেশে এই উদ্বেগ নিরসন করা ও ঢাকাকে কার্যকর পদক্ষেপ করতে উৎসাহিত করতে হবে, বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই এই আলোচনা সম্ভব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bangladesh Unrest Minority Religious Fundamentalism

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।