বৃত্তের কি প্রান্তবিন্দু থাকে? পরিধি আঁকতে তো কম্পাসে লাগানো পেনসিলটাকে যেখানে খুশি বসিয়ে শুরু করা যায়। আমাদের ঋতুচক্রের গোড়াতেই কি গ্রীষ্ম? নতুন বছর কি পয়লা বৈশাখেই শুরু? একই প্রশ্ন সপ্তাহের ক্ষেত্রেও: শুরুর দিনটা ঠিক কবে? রবিবার কি ‘সকল দিনের পরে’ ধীরে ধীরে পৌঁছয়, না কি সবার আগেই আসে?
আমার মতো অফিসযাত্রী করণিকদের কাছে সপ্তাহের মাথা সোমবারে আর সপ্তাহান্ত শুক্রবারে। কিন্তু এখনকার বিশ্বায়িত বাজারে অনেকেরই ‘শিফট’-এর কাজে রবিবার মানে ছুটির দিন নয়। গত দেড় বছরের লকডাউন যেন সাতটি অহ-কে নিয়ে মানুষের বানানো এই সরল বৃত্তকে এক বার ভেংচি কেটে গেল। ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম চক্করে কোন দিনটা যে বুধ, কোনটাই বা শুক্র, সে খেয়াল করিনি। মহাকাল যেন দু’দিকে আদি-অনন্তবিস্তৃত এক সরলরেখা হয়ে শায়িত, গণিতের পরিভাষায় যাকে বলে, মাইনাস ইনফিনিটি থেকে প্লাস ইনফিনিটি।
তবু আগমনী আসে, বাজারি অর্থনীতিতেও। পুজোয় চাই নতুন জুতো: আমাদের শৈশবের এই স্লোগানকে অর্থনীতির আধুনিক তত্ত্ব দিয়ে আজকাল সহজেই ব্যাখ্যা করা হয়। তবে, ভোগবাদের এই চক্রবৎ আচরণ তো আজকের নয়; মানুষ চাষ করতে শেখামাত্র নিশ্চয় প্রকৃতির ধাঁচে তাল মিলিয়ে ‘ঘুরতে’ শুরু করেছিল। কৃষিসমাজে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তও হয়ে গেল বৃত্তাকার। শিল্পবিপ্লব এলেও অর্থনীতির চক্র রয়েই গেল। অর্থনীতিবিদদের ‘বিজ়নেস’ ও ‘কনজ়াম্পশন সাইকেল’ মডেল তৈরি হল।
একটা পরম্পরা চার দশক আগেও বহাল ছিল। আজকের মতো ধনতেরাসে সোনা কেনার চল তো ছিল না। তবে বৈশাখে নতুন হালখাতা, আশ্বিনে নতুন জামা, পূজাবার্ষিকী, গানের রেকর্ড আসত। নিয়ম করে কেনা হত সপ্তাহে এক দিন পাঁঠার মাংস, প্রতি মাসে সংসারের মাসকাবারির সামগ্রী। বৃহস্পতিবারে নিরামিষ-ভক্ষণ ধর্মীয় আচার হলেও, রবিবার সকালের মাংসের দোকানে লাইন দেওয়ার রীতি সামাজিক ‘হার্ড বিহেভিয়র’।
প্রকৃতি নিজের মনে চক্রবৎ পথে ঘুরে চলে, প্রতি বছর ছয় ঋতু ঘুরে ঘুরে আসে। এর তো কোনও শুরুর বিন্দু নেই। মা দুর্গা বাপের বাড়ি আসেন বলেই শরতের মাধুর্য। বসন্তের নবীন পাতা বলেই রোমাঞ্চ। “বরষ ফুরায়ে যাবে,... আসিবে ফাল্গুন পুন, তখন আবার শুনো নবপথিকের গানে নূতনের বাণী”?
বিদেশে, বিশেষত বিলেতে, পারিবারিক জীবনের বার্ষিক চক্র শুরু সেপ্টেম্বরে, জানুয়ারিতে নয়। স্কুল-কলেজের নতুন বছর, খেলার মাঠের নতুন ‘সিজ়ন’ও শরতে। বিদেশের গাছ শরতে অন্য মূর্তি ধারণ করে। এখানে সব বড় গাছই পর্ণমোচী, জুন মাসে গরমকালটা যেন বসন্তের মতো। ঝাঁকড়া সবুজ পাতা উপচে পড়ে, গাছের ভিতরে কোনও ডাল দেখা যায় না, শুধু মোটা একটা গুঁড়ি আর উপরে পাতার মেলা। একই গাছে অগস্টের শেষ থেকে বদল শুরু; সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে নানা রঙে সেজে ওঠে তারা। কোথাও হালকা হলুদ, কোথাও বা ঘন লাল, কোথাও আবার গাঢ় বাদামি। শরৎকে এরা বলে ‘ফল’, যেন পাতা ঝরানোই মূল উদ্দেশ্য। ঋতুর নাম যে কেন এত বিয়োগান্ত রেখেছে কে জানে। ঝরার আগে রঙের বাহারের কথাও তো ভাবা যেত। এ যেন মহালয়ার আবাহনের আগেই দশমীর বিসর্জনের চিন্তা।
এ দেশে পাতাঝরাটা অবশ্য এক দিনে হয় না; দু’-তিন মাস ধরে ঝরে। তবু একটা দিন আসে, সত্যি যেন বিসর্জনের মতো, এক সঙ্গে অনেক পাতা ঝরে যাওয়ার দিন। কে যেন বলত, দশমীতে দেখবি একটু বৃষ্টি হবেই, মা নাকি কান্না চাপতে পারেন না; ঠিক সে রকম। এই দিনটা আসার আগে অবধি নানা-রঙে-সাজা গাছগুলোকে দেখে মনে হয় সারা বছর এরা পাতাবাহারি হয়েই থাকবে; কিন্তু এক সন্ধের মুখে বৃষ্টি নামে, ঝড় ওঠে। রিক্ত গাছগুলো পর্ণ মোচন করে শীতের প্রতীক হয়ে যায়, আগামী বসন্তের অপেক্ষায়। আজকাল বড্ড ভয় লাগে, এই ‘আসছে বছর আবার হবে’ কত দিন চলবে— চলবে তো?
আশঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে বইকি। ডালাসে, আথেন্সে বরফ পড়ছে, লন্ডন চল্লিশ ডিগ্রি গরমে পুড়ছে, বাস্তবেই, কল্পকাহিনিতে নয়। উষ্ণায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তা অমূলক নয়। খালি চোখে দেখা না গেলেও, শিল্পবিপ্লবের পরে গত দু’শো বছরে সারা পৃথিবীর গড় তাপমান কয়েক ডিগ্রি বেড়েছে। কলকারখানা তো বন্ধ করা যাবে না। সামাল কে দেবে, কী করে? হয়তো এই বিশ্ব ক্রমে পুরোই বদলে যাবে। প্রাক্-জুরাসিক যুগে গোটা ভূ-গঠন আলাদা ছিল; সমুদ্রতটের জীবাশ্মই প্রমাণ, ইংল্যান্ডের অবস্থান ছিল দক্ষিণ গোলার্ধে। আজ কি ভাবা যায়?
একশো বছর আগে অর্থনীতিজ্ঞ কেনস সাহেব বলেছেন, “ইন দ্য লং রান, উই আর অল ডেড।” জলবায়ু পরিবর্তন দেখেও কেউ বলতেই পারেন, “আমাদের কী? আমরা তো তখন মৃত, পরের প্রজন্ম ভাবুক।” সেটাই করব আমরা? দায়িত্ব নেব না?
কিন্তু একটা কথা তো ভুলতে পারি না আমাদের এই ‘খেলা যখন ছিল তোমার সনে’-র মাঝে ঘুরতে ঘুরতে। এই ছোট ছোট বৃত্তের বাইরে, ব্যাপ্ত এক মহান, বৃহদাকার চক্রের অস্তিত্ব আছে নিশ্চয়। এই ভয়ে কমলাকান্তও ধন্দে পড়ে মহাকালের মনমোহিনীকে জিগ্যেস করেন, “ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন, মুণ্ডমালা কোথা পেলি?” তার মানে, সৃষ্টির আগেও আর একটা ব্রহ্মাণ্ড ছিল? তা হলে তো, এ বারেরটাও এক দিন না এক দিন শেষ হবেই!
অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy