ছোটবেলায় জানতাম, জ্বর ছাড়লে শিঙি অথবা মাগুর মাছের পাতলা ঝোল দিয়ে ভাত খেতে হয়। ঠাকুমা সেই ঝোল অসাধারণ বানাতেন। তার পর কাপড় কেচে স্নান করে ফেলতেন। এক বার ঠাকুমার জ্বর হল। জ্বর ছাড়ার পর বললাম, তোমাকে কে ঝোল রেঁধে দেবে? তিনি বললেন, “ছি! অমন কথা বলতে নেই।” কেন বলতে নেই? কারণ, তিনি বিধবা। সাদা শাড়ি পরেন, কুঁচি না দিয়ে। এবং নিরামিষ খান। বিজেপি সরকার সকলকে নিরামিষ খাওয়ানোর জন্য চেষ্টাচরিত্র করে বলে আমরা অনেকেই অভিযোগ আনি। অথচ, যুগের পর যুগ ধরে আমাদেরই সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষকে আমরা নিরামিষ এবং কঠোর জীবনচর্যার মধ্যে আটক রেখেছি, এবং সেটাই ‘স্বাভাবিক’ বলে বিশ্বাস করেছি, করিয়েছি।
চিত্রটা আগে আরও ভয়ঙ্কর ছিল, ঠিক। কিন্তু কিছু পরিবর্তন এলেও এখনও যে ‘বৈধব্য’ নামক ‘অভিশাপ’-এর হাত থেকে মেয়েরা পুরোপুরি রেহাই পাচ্ছেন, তা-ও নয়। বিধবা মানেই যে বিষণ্ণ, অশুভ, অকল্যাণকর এক অস্তিত্ব, এ কথা অধিকাংশ মানুষের মনেই এখনও রয়ে গিয়েছে। কয়েক দশক ধরে নারী আন্দোলনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিপ্রা দেও’র একটি লেখা পড়ে জানলাম, রাজস্থানের কিশোরীপূজায় তেরো বছরে বিবাহিত এবং ‘গাউনা’র (পতিগৃহে যাত্রা ও স্থায়ী বসবাস) আগেই বিধবা হওয়া সেই মেয়ে তার বাক্সে বেরঙিন কৈশোরের সঙ্গে রাখত একটা লাল রিবন। মাঝেমাঝে গোপনে সেই রিবন চুলে লাগিয়ে সে ভাবতে চেষ্টা করত ‘সুহাগন’ থাকলে তাকে কতখানি রঙিন দেখাত।
রাষ্ট্রের পঞ্চায়েত দফতর সরকারি নির্দেশ জারি করে বলেছে গ্রাম-পঞ্চায়েতগুলিতে ‘বৈধব্য’ পালন বাধ্যতামূলক করা চলবে না। প্রস্তাবটি প্রথম এসেছিল কোলাপুরের হেরওয়াড় গ্রাম-পঞ্চায়েত থেকে। রাজা রামমোহন রায়ের আড়াইশোতম জন্মজয়ন্তী বছরে নারীশিক্ষা সংগ্রামী সাবিত্রীবাই ফুলের রাজ্য তা হলে দেশকে এক উপহার দিল!
সারা বিশ্বে প্রায় ছাব্বিশ কোটি বিধবা আছেন এবং তার একটি অংশ জুড়ে রয়েছে নাবালিকা বিধবারা। কোভিডকালে সেই সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘বৈধব্য’র বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। ২৩ জুনকে ‘আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস’ হিসাবে উদ্যাপন করা হচ্ছে— বৈধব্যের নিষ্ঠুরতা নিবারণ এবং বিধবাদের সমানাধিকার, সম্মান, নিরাপত্তা ইত্যাদির দাবিতে। বিশ্বের মোট বিধবার চল্লিশ শতাংশের বেশি বাস করেন ভারতে। ভারতে প্রতি দশ জন নারীর এক জন বিধবা।
বিদ্যাসাগরের চেষ্টার ফলে বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ হল, কিন্তু এই দু’শো বছরে সমাজ তাকে সর্বতো ভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। দু’হাজার বছর আগে ‘মহান’ মনুর নিদান আজও সমাজমানসে ক্রিয়াশীল, ‘সদাচারী স্ত্রী স্বামীর মৃত্যু হলে ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বন করবেন। কিন্তু কখনওই পরপুরুষের সংযোগে পুত্র উৎপাদন করবেন না। কারণ অপুত্রা হলেও উক্ত ব্রহ্মচারীদের মতোই তিনিও স্বর্গেগমন করতে পারবেন।’ আর যদি তাঁর পুরুষ সংসর্গ হয়, তবে পরজন্মে তাঁকে শেয়াল হতে হবে, কুষ্ঠ রোগে ভুগতে হবে। ভারত জুড়ে মনুর সন্তানরা সে বাণী ভোলেন কী ভাবে? স্ত্রী জাতি ‘অপদার্থ এবং মিথ্যা’। তাঁদের আয়ত্তে রাখতে হবে, একাকী ভোগ করতে হবে, দরকার মতো ‘সতীত্ব’, ‘মাতৃত্ব’ অথবা ‘দেবত্ব’র ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে তাঁদের আলাদা করে ফেলতে হবে।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘দোরোখা একাদশী’ কবিতায় বালিকা বিধবার অবর্ণনীয় যন্ত্রণার ছবি এঁকে বলেছেন, “ওদিকে ঐ ক্ষীণ মেয়েটি নিত্য একাহারী/ একাদশীর বিধান পালন করছে প্রাণে ম’রে।” পাথরের শিবলিঙ্গের উপর ঝারির জলের ফোঁটা দেখে সে আকুল হয়ে ঢোক গিলছে। জ্ঞান হারালেও মুখে জল দেওয়া যাবে না। পাশের ঘরে যে পুরুষ আড়াই দিস্তা লুচি দেড়কুড়ি আম-সহ উড়িয়ে চলেছে, সে কোনও বিধবার পিতা, সন্তান অথবা ভাই। তার কষ্ট হচ্ছে না! তার লজ্জা করছে না! এই চিত্রটি আজও বহু অঞ্চলে হয়তো একই আছে। আজও বিধবা মায়ের জন্য লাল শাড়ি কিনে আনতে ক’জন সন্তান পারেন? ছেলেমেয়ের জীবনের শুভকাজে ক’জন বিধবা মা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন? অথচ, বিপত্নীক বাবার ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ থাকে না।।
ওয়াটার ছবিতে দীপা মেহতা দেখিয়েছিলেন, সেই মৃত্যুপথযাত্রী কঙ্কালসার বৃদ্ধাকে, যিনি একটা লাড্ডু এক বারে মুখে পুরে দিয়ে কী অনবদ্য আকুলতায় ফিরে গিয়েছিলেন সুখের অতীতে। তিনি তো কেবল ছায়াছবির চরিত্র নন। যুগ যুগ ধরে বাঙালি তথা ভারতীয় বিধবাদের নির্বাসিত করা হয়েছে বৃন্দাবন, কাশী, মথুরাতে। আজও বৃন্দাবন সাদাকালো ‘বিধবার শহর’ (ছ’হাজারের বেশি অসহায় বিধবার বাস)। সকলে সেখানে স্বেচ্ছায় যান না। কাউকে পাঠানো হয় পরিত্যক্ত জিনিসের মতো, কেউ চেনা পরিসরে ভিক্ষা বা দাসীবৃত্তি করতে না পেরে অচেনা শহরে গিয়ে তার দ্বারা গ্রাসাচ্ছাদন করেন। ওই বিধবারা জানেন না, তাঁদের দেশে ‘সম্পত্তির অধিকার আইন’, ‘উত্তরাধিকার আইন’ ইত্যাদি পাশ হয়ে গিয়েছে। যাঁরা শহরের ফুটপাতে, রেলস্টেশনে, বৃদ্ধাবাসে বা বাড়ির এককোণে ছিবড়ে হয়ে পড়ে থাকেন, তাঁরাও অধিকাংশই এ সব জানেন না। জানলেও তাঁদের শিক্ষা বা শারীরিক ক্ষমতা নেই নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার।
মহারাষ্ট্র যে ডাক দিয়েছে, সেটা থেকে শুরু হোক বিধবাদের আইনি স্বীকৃতির লড়াই। তবে আইনের সঙ্গে সমাজটাও বদলানো চাই বইকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy