পাঁচ মাসে বিভিন্ন নেটমাধ্যমে সন্দেহভাজন প্রায় ২৫ হাজার শিশু পর্নোগ্রাফি আপলোড করা হয়েছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
নিষিদ্ধের প্রতি মানবমনের টান অনেককাল থেকেই। কখনও হয়ত তা নিখাদ কৌতূহল, কিন্তু কখনও সেই কৌতূহলই পরিণত হয়েছে আসক্তিতে। আর অজান্তেই সেই আসক্তি ‘মান’ আর ‘হুঁশ’-কে ছুড়ে ফেলে পাশের বাড়ির চেনা ভাল মানুষটিকে করে তুলেছে প্রবৃত্তির দাস। কে জানত নিউটাউনের ফ্ল্যাটের অন্দরে চলছে পর্নোগ্রাফির শ্যুটিং? কে জানত শিল্পা শেট্টির স্বামী রাজ কুন্দ্রার কথা? ‘ইরোটিকা’ না পর্ন, সেই বিতর্ক যে তৈরি হবে, তা-ও তো ঘুণাক্ষরে টেন পাননি দেশবাসী। সত্যিই কি তাই? নাকি ভিতরে ভিতরে গেরিলা কায়দায় আমার-আপনার মনের যৌন কৌতূহল মেটাতে ফোনের লুকোন ফোল্ডারে, কম্পিউটারের ভিপিএন পেরিয়ে যাওয়া ওয়েবসার্চে লোভ দেখাচ্ছে নিষিদ্ধ ছবি? ভারতবাসীর অন্তরের আঁচ পাওয়া যায় পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই। শুধু পর্ন নয়, চমকে যেতে হয় শিশু পর্নোগ্রাফিতে ভারতবাসীর আসক্তির কথা জানলেও!
শিশু পর্নোগ্রাফির উদাহরণ নিতে পিছিয়ে যেতে হবে তিন বছর। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস। কাঠুয়ার বাসিন্দা, সাত বছরের আসিফা বানোকে ধর্ষণ করে খুন করে দুষ্কৃতীরা। নৃশংস সেই ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল জাতীয় রাজনীতি। সর্বস্তরে ধর্ষণের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রতিবাদ। তার মধ্যেও নেশাগ্রস্তের মতো একদল ছুটেছিল প্রবৃত্তির পিছনে। ভাইরাল হয়েছিল একটি স্ক্রিনশট, যেখানে দেখা যাচ্ছিল একটি পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটে সার্চের শীর্ষে চোখ ঝলসে দিচ্ছে একটি পাঁচ অক্ষরের নাম— আসিফা। শিশু পর্নোগ্রাফির প্রতি এই বিপুল আগ্রহই চোখ কপালে তুলতে বাধ্য করেছে সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনের। পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, পাল্টায়নি ছবিটা। অতিমারির ফলে চলা লকডাউনে ভারতে শিশু পর্নোগ্রাফি সামগ্রীর ব্যবহার বেড়েছে ৯৫ শতাংশ! বিশ্বের সবচেয়ে বড় পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট, পর্নহাবের তথ্য থেকে এ-ও জানা যাচ্ছে যে, গত বেশ কয়েক বছর ধরে পর্নোগ্রাফি সামগ্রীর ব্যবহারের দিক থেকে ভারত এখন প্রথম তিনের একটি দেশ। ২০১৯-এ আমেরিকার ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেড চিলড্রেন’-এর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৯ সালে শিশু পর্নোগ্রাফি, শিশুদের যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত ছবি ও ভিডিয়ো নিজের কাছে রাখা এবং আদানপ্রদানের ১৯ লক্ষের বেশি ঘটনা ঘটেছে দেশে।
লকডাউনে সময় ইন্টারনেটের হাত ধরে শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক— উভয়েই অনলাইনে বেশি সময় ব্যয় করছেন এবং অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এই সুযোগ নিয়েই মাঠে নেমেছে সাইবার অপরাধীরা। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় শিশু পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত কনটেন্টের বণ্টন, এমনকি, নেটমাধ্যমকেও কৌশলে ব্যবহার করছে তারা। গত বছর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেড চিলড্রেন’-এ দেশের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)–র কাছে জমা দেওয়া রিপোর্টে জানিয়েছে, পাঁচ মাসে বিভিন্ন নেটমাধ্যমে সন্দেহভাজন প্রায় ২৫ হাজার শিশু পর্নোগ্রাফি আপলোড করা হয়েছে। রাজ্যভিত্তিক সম্পূর্ণ তালিকা না পাওয়া গেলেও ওই তালিকার শীর্ষে আছে দিল্লি। তার পরেই মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য।
কয়েক মাস আগে ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস (এনসিপিসিআর)’-এর অভিযোগের উপর ভিত্তি করে ‘মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্ম’-এ শিশু পর্নোগ্রাফি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার অভিযোগে দিল্লি পুলিশ টুইটারের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করে। এক দিকে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন সামগ্রীর উৎপাদনও ছড়িয়ে দেওয়া যেমন হয়েছে, তেমনই অন্য দিকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিশুর উপর যৌন অত্যাচার ও হেনস্থার ঘটনাও বেড়েছে। এই লকডাউনের ভিতরেই লক্ষ লক্ষ শিশু যৌন অত্যাচারকারী, শিশুধর্ষক ও শিশু পর্নোগ্রাফি আসক্ত মানুষের সক্রিয়তা বেড়েছে নেটমাধ্যমে।
‘ইন্ডিয়া চাইল্ড প্রোটেকশন ফান্ড’ লকডাউনের সময় দেশজুড়ে এক সমীক্ষা করে দেখতে পেয়েছে, অনলাইনে ‘চাইল্ড ‘পর্ন’, ‘সেক্সি চাইল্ড’ এবং ‘টিন সেক্স ভিডিয়ো’-র মতো শব্দবন্ধের অনুসন্ধানের চাহিদা অভাবনীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের ১০০টি বড় শহরে প্রতি মাসে গড়ে ৫০ লক্ষ শিশু পর্নোগ্রাফির চাহিদা কেবল ওয়েবমাধ্যমেই হয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, ওই চাহিদা কোনও নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে আবদ্ধ নয়। তবে প্রায় ৯০ শতাংশই পুরুষ। মাত্র ১ শতাংশ মহিলা। বাকিদের লিঙ্গ পরিচয় জানা যায়নি। শিশু পর্নোগ্রাফি ব্যবহারকারীরা পরিচয় ও অবস্থান গোপন করতে রাখতে প্রযুক্তিগত কৌশলের সাহায্য নিয়ে থাকে। যেমন পুদুচেরি, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড থেকে ‘ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন)’-এর মাধ্যমে অনলাইনে কর্মকাণ্ড চালানো হয়। গোপনীয়তার এই কৌশল ব্যবহার করা সত্ত্বেও কোন অঞ্চলে শিশু পর্নোগ্রাফির চাহিদা বেশি, তা তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। কোথা কী ধরনের পর্নের চাহিদা রয়েছে?
১) পর্নহাবের মতো পর্নোগ্রাফিক প্ল্যাটফর্মে ‘জেনেরিক চাইল্ড পর্নোগ্রাফি’-র সর্বাধিক চাহিদা ছিল ভুবনেশ্বর এবং চেন্নাইয়ে।
২) নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর চাহিদাও আছে অনেক। যেখানে ব্যক্তির আগ্রহ শুধু সুনির্দিষ্ট যৌনক্রিয়া নিয়ে। বয়স, সেক্স, পজিশন দিয়ে সার্চ করেছেন অনেকে। কলকাতা, শিলিগুড়ি, হাওড়া, চণ্ডীগড়, গুয়াহাটি, ইনদওর, ভুবনেশ্বর এবং চেন্নাইয়ে এই চাহিদা নজরে পড়েছে।
৩) সারা দেশে স্পষ্ট ভাবে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে শিশু পর্নোগ্রাফির চাহিদাও আলাদা করে খুঁজে দেখা হয়েছে। উত্তর ভারতের দিল্লি, লুধিয়ানা, রায়পুরা, লখনউ, চণ্ডীগড়, আগ্রা এবং সিমলা; মধ্য ভারতে রায়পুর, রাঁচি এবং ইন্দোর; পশ্চিমে মুম্বই, ঠানে, পুণে এবং আহমেদাবাদ; পূর্বে ইম্ফল, গুয়াহাটি, কলকাতা, হাওড়া এবং শিলং; দক্ষিণ ভারতে কোচি, বেঙ্গালুরু এবং তিরুবনন্তপুরমে এই চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের শিশু সুরক্ষার অবনতি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। মানুষের মধ্যে লালসা বা যৌন বিকার ছিল না তা নয়। কিন্তু প্রযুক্তি তাকে একটা আধার দিয়েছে। মানুষের হাতে সহজলভ্য করে তুলেছে নিষেধের পাহারায় থাকা নানা উপাদান। তাতে আত্মহারা মানুষ ভুলে যাচ্ছে এত বছরের সামাজিকতার ইতিহাস। ফাঁকফোঁকর গলে বেরিয়ে পড়ছে ‘লিবিডো’-র নৃশংস তাড়না। তবে একথাও ঠিক, শিশু পর্নোগ্রাফি আটকাতে উদ্যোগী হতে হবে সেই সাধারণ মানুষকেই। গড়ে তুলতে হবে সচেতনতা। ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়ে হতে হবে সচেতন। যতই ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করা হোক, প্রক্সি অ্যাড্রেসের ফাঁক দিয়ে সে ফের পৌঁছে যাবে এক ক্লিকের দূরত্বে। তাই আমাকে-আপনাকে ঠিক করতে হবে কোনটা আমরা গ্রহণ করব আর কোনটা বর্জন। তাতেই একমাত্র মুক্তি। নইলে ক্রমে তলিয়ে যেতে হবে আরও অন্ধকারে।
(সূত্রঃ ইন্ডিয়া চাইল্ড প্রটেকশন ফান্ড, ২০২০। লেখক প্রতীচী (ইন্ডিয়া) ট্রাস্টের ন্যাশনাল রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy