কোভিড সঙ্কট সরকারি কোষাগারগুলোর উপর দু’দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করেছে। এক দিকে বাড়তি খরচের চাপ, অন্য দিকে আয় কমে যাওয়ার। এক দিকে, সরকারি আনুকূল্যে সাধারণ নাগরিকদের চিকিৎসা, টিকা দেওয়া ইত্যাদি ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন আর্থিক পুনর্বাসন প্যাকেজ বা আয় ও কাজের সুযোগ বাড়ানোর জন্য বর্ধিত পরিমাণে সরকারি খরচ। অন্য দিকে, কোভিডের প্রকোপে অর্থনীতি যে হেতু ঝিমিয়ে পড়েছে, সরকারের রাজস্ব আদায়ও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে। খরচ বাড়া এবং আয় কমে যাওয়ার ফলে তৈরি হয়েছে বিপুল ঘাটতি। এই সঙ্কট থেকে মুক্তির উপায় কী?
অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে ঘাটতি মেটানোর তিনটি রাস্তার কথা লেখা থাকে— করবৃদ্ধি; টাকার জোগান বাড়ানো; এবং ঋণ নেওয়া। কোভিডের ঋতুতে, যখন পৃথিবী জুড়ে আর্থিক মন্দা চলছে, তখন কর বাড়ানোটা ঠিক রাস্তা হতে পারে না। আয়কর বাড়লে মানুষের হাতে কম টাকা আসবে, ফলে জিনিসপত্রের চাহিদা কমে যাবে। বিক্রয়কর বাড়লেও চাহিদা কমে যাবে, কারণ জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। চাহিদা কমে গেলে জিনিসপত্র কম তৈরি হবে, যার ফল আরও গভীর মন্দা।
দ্বিতীয় রাস্তা হল টাকার জোগান বাড়ানো। ইদানীং অনেক খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদই দরাজ গলায় এই পদ্ধতির সুপারিশ করছেন। তাঁরা মনে করছেন যে, কোভিডতাড়িত আর্থিক দুঃসময়ে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার অন্যতম উপায় ব্যাঙ্ক-ঋণের সম্প্রসারণ; এবং তার মাধ্যমে টাকার জোগান বাড়ানো। আমেরিকার ফেডারেল রিজ়ার্ভ, ব্রিটেনের ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ড, ভারতের রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক-সহ সব কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কই বর্তমানে কম-বেশি এই নীতি গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো কম সুদে ধার দিচ্ছে তাদের আয়ত্তাধীন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোকে; যে টাকা আবার বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো ছোট-বড় নানা রকম ব্যবসায়িক সংস্থাকে সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে দিচ্ছে।
লক্ষণীয়, টাকা বলতে শুধু টাঁকশালে ছাপানো নগদ টাকাকেই বোঝায় না, ব্যক্তি বা সংস্থাগুলোর নামে যে অর্থ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোতে রয়েছে, তাকেও বোঝায়। যে হেতু নগদ না তুলে, শুধুমাত্র চেক এবং ইলেকট্রনিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে ব্যাঙ্কে জমা ওই অর্থ দিয়ে সমস্ত লেনদেন সম্ভব, এবং আধুনিক যুগে সেটাই করা হয়ে থাকে, তাই টাকার জোগানের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যাঙ্ক আমানত। কাজেই ব্যাঙ্ক-ঋণ সম্প্রসারণের তাৎপর্য সরাসরি টাকার জোগান বাড়ানো।
কোভিড সঙ্কটে কেন্দ্রীয় সরকার যে আর্থিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কম সুদে সহজ শর্তে ঋণদান। উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট, টাকার জোগান বাড়িয়েই এই ঋণের খরচ সামলানো হচ্ছে। এ ছাড়াও কোভিডের সময় সরকারের অন্যান্য আর্থিক প্রয়োজন, যেমন সরাসরি অনুদান খাতে কিংবা চিকিৎসা বা তার পরিকাঠামো নির্মাণের খাতে ব্যয়, অনেকটাই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া ঋণ দিয়ে মেটানো হচ্ছে। সরকারি ঋণপত্রের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এই টাকা সরকারের অ্যাকাউন্টে হস্তান্তর করে দিচ্ছে, যে টাকা কোভিড সঙ্কটের মোকাবিলায় খরচ করছে সরকার। এটাও কিন্তু টাকার জোগান বাড়িয়েই কোভিডের খরচ মেটানো।
টাকার জোগান বাড়ানোর মূল সমস্যা মূল্যবৃদ্ধি। বর্তমান দুরবস্থাটা যদি শুধুমাত্র চাহিদার অভাবের জন্য হত, তা হলে টাকার জোগান বাড়িয়ে চাহিদা তৈরি করলে উৎপাদন-কর্মসংস্থান বাড়ত, কিন্তু তেমন ভাবে মূল্যবৃদ্ধি ঘটত না। দুর্ভাগ্যবশত, এই অতিমারির মরসুমে সংক্রমণের ভয়ে কিছু জিনিস পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি করাই যাচ্ছে না; বা তৈরি করা গেলেও, পরিবহণের অভাবে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ, কিছু জিনিসে যেমন চাহিদার অভাব আছে, তেমনই কিছু জিনিসে জোগানের ঘাটতিও আছে। মানুষের হাতে বাড়তি টাকা আসার ফলে দ্বিতীয় ধরনের জিনিসগুলোর দাম বাড়ছে এবং ক্রমশ সেই মূল্যবৃদ্ধি অন্যান্য জিনিসের দামকেও সংক্রমিত করছে। টাকার জোগান বাড়ানোর ফলে আমেরিকায় ২০২১ সালের জুন মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ৫.৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যা সেই দেশের স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রায় তিন গুণ। ভারতেও একই ছবি। ২০২০-র অক্টোবরে মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছিল ৭.৬১ শতাংশ। ২০২১-এর জুনে এই হার ৬.৩ শতাংশে নেমে এলেও সেটা প্রাক্-কোভিড মূল্যবৃদ্ধির হারের থেকে অবশ্যই বেশি।
অতএব মূল্যবৃদ্ধিকে বশে রেখে ঘাটতি মেটাতে গেলে সরকারকে তৃতীয় রাস্তায় খানিকটা হাঁটতেই হচ্ছে— জনসাধারণের কাছ থেকে বেশি করে ঋণ নিতে হচ্ছে। ঋণ নেওয়ার দুটো সম্ভাব্য সমস্যা। এক, সরকার তার ঋণের চাহিদা বাড়ালে বাজারে সুদের হার বেড়ে গিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। দুই, খুব বেশি পরিমাণে ঋণ নিলে সেই ঋণ ফেরত দেওয়া নিয়ে ভবিষ্যতে একটা সঙ্কট দেখা দিতে পারে। ধনী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করে অর্থনীতিবিদরা অবশ্য বলছেন যে, দুটো সমস্যার কোনওটাই আসলে সমস্যা নয়।
পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই দশক ধরে পৃথিবীর ধনী দেশগুলোতে জাতীয় আয়ের অনুপাতে সরকারি ঋণ ধারাবাহিক ভাবে বেড়েছে, অথচ সুদের হার বাড়া দূরের কথা, ক্রমাগত কমেছে। আমেরিকায় ২০০০ সালে সরকারি ঋণ ছিল জাতীয় আয়ের ৬%; ২০২০-তে সেটা দাঁড়িয়েছে ১০৯%। কিন্তু, প্রকৃত সুদের হার (আর্থিক সুদের হার থেকে মূল্যবৃদ্ধির হার বাদ দিলে যেটা পাওয়া যায়) ৪.৩% থেকে কমে হয়েছে -০.১%। একই ধরনের ঝোঁক অন্য ধনী দেশগুলোতেও লক্ষ করা যাচ্ছে। এর কারণ সম্ভবত জাতীয় আয়ে সঞ্চয়ের অনুপাত বেড়ে যাওয়া। সরকারের তরফে ঋণের চাহিদা যতটা বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে জাতীয় সঞ্চয়। ফলে, ঋণের জোগান তার চাহিদার চেয়ে বেশি হয়ে গিয়ে সুদের হার কমিয়ে দিচ্ছে।
পশ্চিমের দেশগুলোতে সঞ্চয় কেন বাড়ছে? একটা কারণ ক্রমবর্ধমান অসাম্য— জাতীয় আয়ের বড় অংশ অবস্থাপন্নদের হাতে যাচ্ছে, যাঁদের সঞ্চয় প্রবণতা বেশি। তা ছাড়া মানুষের আয়ু এবং আয়ের অনিশ্চয়তা, দুটোই বেড়েছে বলে মানুষ সঞ্চয় করছেন বেশি। কারণ যা-ই হোক, মোট সঞ্চয় বেড়ে গিয়ে সুদের হার কমে যাওয়ার ফলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন যে, এই অতিমারির সময়, সরকার কোনও বড় রকমের সমস্যা ছাড়াই, বাজার থেকে ঋণ নিয়ে আর্থিক ঘাটতি পূরণ করতে পারে।
আর একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, উন্নত দেশগুলোতে আয়বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদি হার সুদের হারের তুলনায় বেশি। যেমন, ১৯৫০-২০০৮ এই সময়ের মধ্যে আমেরিকান সরকারের এক ও দশ বছরের ঋণপত্রের উপর গড় আর্থিক সুদের হার ছিল ৪.৭% এবং ৫.৬%। এই সময় গড় আর্থিক আয়বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৩%। একই প্রবণতা অন্য ধনী দেশগুলোতেও দেখা গিয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, মোটের উপর আর্থিক আয়বৃদ্ধির হারে সরকারের রাজস্বও বাড়ে। এর তাৎপর্য হল, সরকারকে যে হারে সুদ দিতে হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে সরকারের আয়। ফলে, ধার নিয়ে শোধ দেওয়ার সময় কোনও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। ঋণ নিয়ে আর্থিক ঘাটতি পূরণের পক্ষে এটা আর একটা যুক্তি।
কিন্তু, এ তো গেল বড়লোক দেশগুলোর কথা। ভারতে কী হচ্ছে? ১৯৯১-৯২ থেকে ২০১৯-২০ এই সময়ের মধ্যে ভারতে জাতীয় আয়ের অনুপাতে সরকারি ঋণ মোটের উপর বেড়েছে; ২০১৩-১৪ থেকে বেড়েছে ধারাবাহিক ভাবে এবং তীব্রতর গতিতে। পাশাপাশি আর্থিক সুদের হার ক্রমাগত কমলেও প্রকৃত সুদের হার কখনও বেড়েছে, কখনও কমেছে। উপরন্তু, ২০১৩-১৪ থেকে প্রকৃত সুদের হারে একটা পরিষ্কার ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সঞ্চয়-প্রবণতা ২০১১ অবধি বাড়লেও তার পর থেকে ধীরে ধীরে কমছে। সব মিলিয়ে এটা জোর দিয়ে বলা যাবে না যে, ভারত সরকার বাজার থেকে ধার করে ঘাটতি মেটালে সুদের হার এবং বেসরকারি বিনিয়োগের উপর তার কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
অবশ্য এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ এই সময়ের মধ্যে ভারতে গড় আর্থিক আয়বৃদ্ধি ছিল বছরে ১১.৫৭ শতাংশ এবং তুলনায় কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণপত্রের উপর গড় আর্থিক সুদ ছিল ৭.৬৫ শতাংশ। সে দিক থেকে দেখলে ঋণশোধ করতে সরকারের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যে হেতু ইদানীং সরকারি ঋণের সঙ্গে সঙ্গে সুদের হারও বাড়ছে, ঋণ নেওয়ার বিষয়ে সরকারের কিছুটা সাবধান হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy