বাস্তব: কলকাতা ৭১ ছবির দৃশ্য Sourced by the ABP
‘‘এ দেশের যে শহরটা, শুনে থাকি, বারুদে ঠাসা— তার নাম কলকাতা… কলকাতায় বিক্ষোভ, ক্রোধ, ব্যারিকেড আর বোমা। কলকাতা বেপরোয়া, কলকাতা মারমুখী।” (মৃণাল সেন, ‘ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ’, ১৯৭৭)
মৃণাল সেনের কিছু প্রিয় গল্প ছিল। কলকাতা ৭১ নিয়ে তেমন কয়েকটা গল্প লিখে গেছেন। ১৯৭২ সালে ছবিটা যখন মুক্তি পেল, মৃণাল মেট্রো সিনেমা হলে দাঁড়িয়ে থাকতেন।ভিড় করে মানুষ ছবি দেখছে, বেরিয়ে এসে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তর্ক করছে। এ সেই বারো বছর আগেকার বাইশে শ্রাবণ-এর মতো অভিজ্ঞতা নয়, যার কথা লিখেছেন আশীষ বর্মন। তখন ওঁরা পূর্ণ সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে সভয়ে দেখেছিলেন, ছবি দেখে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যাচ্ছে দর্শক, মুখে রা নেই। কলকাতা ৭১ দেখে কেউ অন্তত সেই সময় নীরব থাকতে পারেনি। এক দিন একটি ছেলে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, এই ছবির শুটিং কবে হয়েছে? পরিচালক যখন জানালেন, একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে, সে রেগে চেঁচিয়ে বলেছিল, মিথ্যে কথা, আপনি মিথ্যেবাদী!তার সঙ্গী ছেলেটি এই অভদ্রতায় বিব্রত হয়ে জানায়, ছবিতে তাদের এক বন্ধুকে দেখা যাচ্ছে জনসভায়। ১৯৬৯-এ যে দিন সেই সভায় সে গিয়েছিল, সে দিন সন্ধ্যায় তাকে সিআরপি গুলি করে মেরে ফেলে।
ওই ১৯৬৯ সালে সিপিআই (এমএল)-এর জন্ম, মাও জে-দং কথিত স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে পরিণত করবার আয়োজন করবে যে দল। সেই সময় থেকে মিছিল আর সমাবেশের ছবি তুলে রাখছিলেন মৃণাল। সে সব দৃশ্য তাঁর ইন্টারভিউ (১৯৭০), কলকাতা ৭১, পদাতিক (১৯৭৩) আর কোরাস-এর (১৯৭৪) মতো ছবিকে সময় সময় কাহিনির হাত ছাড়িয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। যখন কলকাতা ৭১ চলছে, এক দিন হলের ভিতরে এক মহিলার আর্তনাদ শোনা গেল। পরিচালকের সঙ্গীরা ছুটে গিয়ে দেখলেন, মহিলা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। নিজের ছেলেকে উনি পর্দায় দেখেছেন, যে ছেলেকে কিছু দিন আগে পুলিশ গুলি করে মেরেছে। ছবির টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে পুলিশের খাতায় নাম-থাকা কিছু যুবক গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিল। এই রকম নানা গল্প মৃণালের লেখায়, সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায়। বোঝা যায়, ওই উত্তপ্ত সময়টা কতখানি ওতপ্রোত এই ছবিগুলোর সঙ্গে। সেই সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে এদের গুণাগুণ বিচার করা সহজ নয়। ছবির ফ্রেমের ঠিক বাইরে যা ছিল, তা অনায়াসে ঢুকে পড়েছিল সীমানা টপকে। এটা সব সময় হয় না। সবার ছবিতে হয়নি।
ঠিক ওই সময় নাটকে বা চিত্রকলাতেও রাজপথের বাস্তবতা ফ্রেম ডিঙিয়ে ঢুকে পড়বার প্রবণতা দেখা গেছে। সদ্যপ্রয়াত শিল্পী ভিভান সুন্দরম তেলরং ছেড়ে ক্যানভাসে তুলে এনেছিলেন সংবাদ আর গ্রাফিতির কোলাজ। বাদল সরকারের নাটক মঞ্চের চৌকাঠ পেরিয়ে পথে নেমে এসেছিল। রাস্তায় বিক্ষোভ, রাস্তায় শীর্ণ, ক্ষুধার্ত মানুষ, ছুটে পালানো যুবক, রাস্তায় হাঁটছে পদাতিক-এর বিমানের মতো, কোরাস-এর মায়ের মতো চরিত্র। পুলিশের তাড়া খেয়ে গলি দিয়ে দৌড়তে থাকা যে যুবকের ছবি বার বার এই ছবিগুলিতে ফিরে আসে, তার পায়ে পায়ে উপদ্রুত হয়ে ওঠা কলকাতার রাস্তাকে মৃণাল ওই সময়ের প্রধান ইমেজ করে তুলেছেন। সহজে তাকে ভোলা যায় না।
কিন্তু সে দিন র্যাডিক্যাল মহলে কাউকে ছেড়ে কথা বলবার রেওয়াজ ছিল না। এক নামী বামপন্থী সাপ্তাহিকে অশোক রুদ্র লিখলেন, কেন কলকাতা ৭১-এ এত মিছিল দেখছি। প্রকাশ্য মিছিলের দিন চলে গিয়েছে, এখন তো গেরিলা লড়াইয়ের সময়! অর্থাৎ, বছর তিনেক আগের কলকাতা দেখব কেন, বর্তমান দেখানো হোক ঘটমান দশায়। কিছু ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকায় দেখছি নানা অভিযোগ— ছবির শেষে ওই যে ময়দানে গুলি খাওয়া যুবক এসে বলে, আমাকে কে মারল আপনারা খুঁজে বার করুন— কেন বলে দেওয়া হল না যে, কারা ওকে মেরেছে? কেউ লিখেছেন, ছেলেটি কোন দল করে তা জানানো হল না কেন? অন্য অভিযোগও ছিল: বিপ্লবী ছবিই যদি হবে, তবে ফর্ম এত ভাঙাচোরা জটিল কেন? মেহনতি মানুষ বুঝবে এই সব? কিন্তু মনে হয় ওই তরুণ তার্কিকরাও জানতেন যে, আর কোনও পরিচালক চার পাশে নেই, যিনি ছবিকেই তর্কের মতো করে সাজাচ্ছেন, প্রশ্ন করতে চাইলে যাঁকে হাতের কাছেই পাওয়া যায়।
এই বর্তমানে বাঁধা ছবি কিন্তু বাংলা সাহিত্যের হাত ধরে অতীত পরিক্রমা করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল, সমরেশ বসুর তিনটি গল্পে ‘১৯৩৩’, ‘১৯৪৩’, ‘১৯৫৩’ সালের ঠিকানা বসিয়ে ’৭১-এ পৌঁছয়। যে সূত্রে এই দশকগুলো গাঁথা, তা হল ক্ষুধা। সত্তরের প্রথম বছরগুলোতে চারটে ছবি জুড়ে যে পরিক্রমা মৃণাল করলেন, তাতে কখনও দৃশ্যে, কখনও সংবাদের মতো ভেসে ওঠা অক্ষরে, কখনও নেপথ্য কণ্ঠে ক্ষুধার কথা ফিরে ফিরে আসে। এর আগে বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০), আর পরে আকালের সন্ধানে (১৯৮০) ছবির কেন্দ্রে রয়েছে ১৯৪৩-এর মন্বন্তর। মৃণাল সেনের সত্তর দশক আসলে চল্লিশের অভিজ্ঞান বহন করে।
তিনি নিজে জানিয়েছেন, গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্য না হলেও গণনাট্যের শিল্পই তাঁর ছবি তৈরির মূল প্রণোদনা। পদাতিক-এর শেষে নায়ক সুমিতের সঙ্গে তার বাবার নতুন এক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, ক্রমশ একা হয়ে পড়া নকশাল কর্মী সুমিত যেন এক জন নতুন কমরেডকে চিনতে পারে। এ কাকতালীয় নয় যে, বাবার ভূমিকায় অভিনয় করলেন বিজন ভট্টাচার্য— ১৯৪৩-এর পরে পরে যাঁর নাটক গণনাট্যর সূচনা করে।
দশ বছরের ফারাক মেপে ‘ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ’ নামক প্রবন্ধে আর এক খতিয়ান লিখেছিলেন মৃণাল সেন। ১৯৪৯ নাগাদ প্যারাডাইস কাফেতে বসে আড্ডা দিচ্ছেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়দের সঙ্গে। সিগারেট ও চায়ের দাম দিয়ে উঠতে পারছেন না, এ দিকে মাথায় ভূত চেপেছে ফিল্ম বানানোর। সে সময় তেভাগার কাকদ্বীপে কৃষক নারী অহল্যার হত্যার খবর এল। চিত্রনাট্য লেখা হল: ‘জমির লড়াই’। প্রাচীন এক ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরাও জোগাড় করা হল। কিন্তু সেই গেরিলা ছবি করা হয়ে ওঠেনি। ১৯৫৯-এ বর্ধমানের গ্রামে বাইশে শ্রাবণ-এর শুটিং-এর মাঝে খবর এল, কলকাতায় ভুখ মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে বহু মানুষকে মেরেছে। সে দিন শুটিং বন্ধ হয়ে গেল। পরের দিন ওঁরা তুললেন ‘৪৩-এর দুর্ভিক্ষের দুঃসহ অভিজ্ঞতার একটি দৃশ্য।
আরও দশ বছর পরে, ১৯৬৯-এ, কয়েক ঘণ্টায় চিত্রনাট্য লিখে ফিল্ম ফাইনান্স কর্পোরেশনে পাঠিয়ে মাত্র দেড় লাখ টাকায় বানিয়ে ফেললেন ভুবন সোম। ভারতীয় ছবিতে ‘নবতরঙ্গ’-র সূত্রপাত ঘটল। সাড়া-জাগানো এই হিন্দি ছবিটির আদলে তিনি আরও ছবি করুন, এমন দাবি নিয়ে প্রযোজকরা নিজেরাই বাড়িতে এসে হাজির হলেন। কিন্তু তত দিনে সত্তর সাল এসে গিয়েছে। দূরের পটভূমিতে সবার ভাল লাগার মতো ছবি করা আর সম্ভব নয়। মৃণাল লিখছেন, “মনে পড়ল ঊনপঞ্চাশ সালের কথা… ভুবন সোম নয়, আসুক অন্য কিছু।”
এর পরে ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে চারটে ছবি— যার দৈনিক সংবাদ জানাবে যে, সেই বর্তমানের অন্দরে এক অতীত গাঁথা ছিল— আর ক্ষুধা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে আধুনিক আর্টেরপ্রথম উদ্যোগের স্মৃতি। অতীতই হয়ে উঠছিল বর্তমান। আরও বার দুই দশ বছর পেরোলে পরে ভারতীয় শিল্পে চল্লিশের সঙ্গে এই বিনিময় চেনা কঠিন হয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy