গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পুলওয়ামাকাণ্ড, নির্বাচনী বন্ড, সিএএ ইত্যাদি বিবিধ বিতর্কিত জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর সরকার। প্রচারমাধ্যমের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও সত্যকে আড়াল করা সম্ভব হচ্ছে না।
জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক খোলসা করে জানিয়েছিলেন, কী ভাবে আধাসামরিক বাহিনীর ৫০ জন জওয়ান কেন্দ্রীয় সরকারের সুনির্দিষ্ট গাফিলতির জন্য ‘খুন’ হয়েছিলেন। ওই জওয়ানদের দেহ নিয়ে রাষ্ট্রীয় ভাবাবেগ তৈরি করে ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন মোদী।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেই ‘নির্বাচনী বন্ড’ চালু। চূড়ান্ত গোপনীয়তা মারফত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পরিকল্পনা। একই সঙ্গে ভারতীয়দের মধ্যে বিভাজনের পাঁচিল তৈরি করার লক্ষ্যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) পাশ করা।
নির্বাচনী বন্ড চালু করার সময় থেকেই দেশের সুস্থ ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক দল-সহ নাগরিক অধিকার সচেতন বিভিন্ন গোষ্ঠী ওই আইনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করে। আদালতে মামলা হয়। প্রায় ছ’বছর পর সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে।
সিএএ-র সাংবিধানিকতা এখনও সুপ্রিম কোর্টে বিচার্য। এর বিরুদ্ধে গোটা দেশে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। দেশব্যাপী বিক্ষোভের সুনামির সম্ভাবনা দেখা দেয়। কোভিড অতিমারির কারণে সে যাত্রায় সরকার রক্ষা পায়। স্বাস্থ্যবিধির কারণে মানুষকে ঘরে আটকে থাকতে হয়। তবে, আইন কার্যকর করার বিধি চালু করা সম্ভব হয়নি। ২০২৪-এর নির্বাচনের ঠিক আগেই ওই আইন চালু করা হল। লক্ষ্য বিভাজন এবং ভোটের ফায়দা।
আমাদের দেশের নাগরিক আইন বুঝতে গেলে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামকে দুর্বল করে দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভাবন ও পরিণতিতে দেশভাগের ঐতিহাসিক পটভূমিকা মাথায় রাখতে হবে। হিন্দু ও মুসলমান— দুই ধর্মের মৌলবাদীরাই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের জন্য দায়ী। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েছেন মৌলবাদী তত্ত্বের শিকার। ওই ঐতিহাসিক পটভূমিতে সংবিধান প্রণেতারা নাগরিকত্ব নিয়ে যে চিন্তাভাবনা করেছেন, সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
আমাদের সংবিধান বা ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে কোথাও নাগরিকের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া নেই। তবে সাধারণত সকল ব্যক্তিই নাগরিক। রাষ্ট্রের আনুগত্য যিনি স্বীকার করেন তিনিই রাষ্ট্রের নাগরিক। বিশ্বব্যাপী নাগরিক সম্পর্কে ধারণা হচ্ছে, ‘‘নাগরিকেরা বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীরই অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের নিয়েই গোষ্ঠীগুলি তৈরি হয়। তাঁরা বা তাঁদের সহযোগীরাই ব্যক্তিগত বা সমষ্টিকে রক্ষা এবং কল্যাণের জন্য সরকার গঠনে এবং তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেন।’’ নাগরিকের এই সাধারণ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতেই সংবিধান সভায় অম্বেডকর সংবিধানের নাগরিক বিষয়ক ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ উত্থাপন করে বলেন, “এই অনুচ্ছেদটি সাধারণ নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নয়। বরং আইন কার্যকর হওয়ার দিনটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের স্থায়ী নাগরিকত্ব আইনের খুঁটিনাটি লিপিবদ্ধ করা এই আইনের উদ্দেশ্য নয়... এ রকম বোঝাও উচিত নয় যে, আইন কার্যকর করার দিনটিকে নিয়ে যে সংস্থানগুলি এই আইনে রাখা হয়েছে সেগুলি স্থায়ী বা অপরিবর্তনীয়। যা করা হয়েছে সেটা সাময়িক।”
অর্থাৎ এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল, এ পার-ও পারের যাতায়াতের ফলে নাগরিকত্বের অবস্থানও পরিবর্তন হবে। ধর্মের জিগিরে দেশভাগ। মানুষের স্বাভাবিক অবস্থান ও মানসিক কারণে সীমান্তের বেড়া তৈরি হয়নি। আমাদের দেশ বিভিন্ন সময়ে নাগরিক আইন সংশোধিত হয়েছে। নাগরিকত্ব ব্যক্তির অধিকার। ধর্মের পরিচয় নাগরিকত্ব নির্ধারণ করতে পারে না।
২০১৯ সালে ওই আইনে যে সংশোধন হল তাতে ভারতকে নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল করা হল না। ক্ষুদ্র ধর্মীয় পরিচয় ও গণ্ডিবদ্ধ তিনটি দেশকে চিহ্নিত করা হল নাগরিকত্ব প্রাপ্তির নিরিখ হিসেবে। যা ভারতের সাংবিধানের মূল চরিত্র-বিরোধী। যাঁরা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এ দেশে বসবাস করছেন, তাঁরা তো দেশের আইনকানুন মেনেই করছেন। তাঁরাও নিজেদের শ্রমদানে দেশের সম্পদের অংশীদার। তাঁরাও ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছেন। কী ভাবে এলেন, কখন এলেন, কেন এলেন এ সব প্রশ্ন নিছকই অবান্তর। এক জন ব্যক্তির জৈবিক অস্তিত্বই সবচেয়ে বড় পরিচয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে মানবিক অধিকারই মূল বিবেচ্য হওয়া উচিত।
ভোটের আগে যে বিধি চালু করা হয়েছে সেই বিধি অনুযায়ী যে সব নথির দাবি করা হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে জোগান দেওয়া অসম্ভব। জীবন-জীবিকার তাড়নায় যে মানুষ দিবারাত্র পরিশ্রম করে, তার পক্ষে নিজের শংসাপত্রই দেওয়া দুষ্কর, সে কী করে তার পিতা-মাতা বা প্রপিতা-মাতার জন্ম শংসাপত্র দাখিল করবে? দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষেও এই শংসাপত্র দেওয়া সম্ভব নয়।
কী ভাবে এ দেশে এলেন? এ প্রশ্ন করা মানেই তো দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। জবাব তো দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। চাহিদা মতো নথি জমা দিলেও ছ’বছর অপেক্ষা করতে হবে নাগরিকপত্র পেতে। যাঁরা দরখাস্ত করলেন, কিন্তু চাহিদা মতো নথি দিতে পারলেন না, তাঁরা রইলেন ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। নাগরিকত্বের দাবি করে নিজেকে অপরাধী প্রমাণ করে দিলেন। তাঁদের কী হাল হবে তা কিন্তু দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট ভাবে বলতে পারছেন না। ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ২০১৪ সালের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে যাঁরা এ দেশে এসেছেন তাঁরা নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন।
ধর্মীয় নিপীড়নের নথি কে দেবে? শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মায়ানমার ইত্যাদি দেশের নিপীড়িতরা নয় কেন? এই সব তথ্য কে দেবে? গোটা ব্যাপারটাই ধোঁয়াশা। কেন্দ্রীয় সরকারের এই আইন ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বিরোধী। সংবিধান-বিরোধী।
শিকাগোর ধর্মীয় মহাসম্মেলনে নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ) তথাকথিত হিন্দু ধর্মের স্বীকৃত প্রতিনিধি ছিলেন না। হিন্দুত্ববাদী বৃত্তের বাইরের সংস্কার মুক্ত হিন্দু হিসেবে নিজের মেধার ভিত্তিতে ওই মহাসভায় বক্তৃতা করার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতায় তিনি ভারতীয় সভ্যতার সহনশীলতার ঐতিহ্যের উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘‘অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল হিসাবে ভারতীয় সমাজ সর্বজনবিনিত।’’
বর্তমানে মোদী সরকার নিপীড়িত মানুষের মধ্যেও বিভাজন টানার অভিপ্রায়েই চালু করেছে সিএএ। ভারতের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বিরোধী এই আইনকে প্রত্যাখ্যান করাই সাংবিধানিক দায়িত্ব।
(লেখক আইনজীবী এবং রাজ্যসভায় সিপিএম সাংসদ। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy