গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সোমবার বিকালে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকর করেছে। লোকসভা ভোটের আগে কেন্দ্র সরকারের এই পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টজনেদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ। সিএএ নিয়ে কী মতামত তাঁদের? জানার চেষ্টা করল আনন্দবাজার অনলাইন।
কথাপ্রসঙ্গেই নাট্য নির্দেশক ও পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের মনে পড়ছিল ২০১৯ সালে সংসদে সিএএ বিল পাশ হওয়ার পর দেশ জুড়ে প্রতিবাদের কথা। ‘‘আমি তখন মুম্বইয়ে। সেখানে প্ল্যাকার্ড তৈরি থেকে শুরু করে মিছিলে যোগ দেওয়া— সবই করেছিলাম। বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সেটাকে ফিরিয়ে আনা হল দেখে অবাক হচ্ছি।’’ স্মৃতিচারণ করলেন সুমন। পুরো বিষয়টার নেপথ্যে যে আসন্ন লোকসভা ভোট, তা নিয়ে ‘হারবার্ট’ ছবির পরিচালকের মনে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর কথায়, ‘‘ভোটের আগে একের পর এক “হিন্দুত্ববাদী’ কার্ড ওরা খেলতে শুরু করেছে। তবে প্রতিবাদের স্বর যদি ওঠে, আগের মতোই আমি সেখানে থাকব। কারণ, আগে যদি বিরোধিতা করে থাকি, তা হলে আগামী দিনেও সেটাই করব।’’
সিএএ-র ঘোষণার মধ্যে দিয়ে সরকারের সংখ্যালঘুদের প্রতি মনোভাব অনেকাংশে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বলেই মনে করছেন সুমন। বের্টোল্ট ব্রেখ্টকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক নাটক ‘বেচারা বি বি’র প্রসঙ্গ তুললেন নাট্যকার। সুমন বললেন, ‘‘সেখানে একটা অংশ আমি সিএএ প্রসঙ্গে রেখেছিলাম। একটি চরিত্র প্রশ্ন তোলে যে, হঠাৎ পাসপোর্টের খোঁজ কেন করা হচ্ছে। অন্য এক জন বলে যে, জবাই করার সময়ে মানুষকে যাতে জলদি খুঁজে পাওয়া যায়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।’’
সুমন মনে করেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পৃথিবী এগিয়ে চললেও ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে খুব বেশি বদল ঘটেনি। তাই ক্ষমতাবানেরা নিজের প্রয়োজনে দুর্বলকে ব্যবহার করতেই চাইবে বলে মনে করছেন সুমন। তাঁর কথায়, ‘‘নির্বাচনের আগে এখন রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন তুরুপের তাস খেলতে চায়। সকলেই আটঘাট বেঁধে ময়দানে নামে। কিন্তু সেই তাস সিএএ-এ হলে, সেটা মারণাস্ত্র!’’
কোনও ব্যক্তির দেশে পুনর্বাসন যদি নিয়ম মেনে হয়, তা হলে তার মধ্যে কোনও দোষ দেখছেন না পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। কিন্তু তিনি মনে করিয়ে দিতে চাইছেন, ‘‘সেই প্রক্রিয়া যদি ধর্মের ভিত্তিতে করা হয়, সেখানে আপত্তি উঠতে বাধ্য। এটা অত্যন্ত বৈষম্যমূলক একটা পদক্ষেপ।’’ সিএএ-র মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনের আগে মেরুকরণকে স্পষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে করেন কমলেশ্বর। তাঁর যুক্তি, ‘‘সিএএ ঘোষণা করে দেশের সীমান্তবর্তী ভোটকেন্দ্রের বাসিন্দাদের কাছে কী বার্তা পাঠাতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার, সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেল।’’
সিএএ-কে নির্বাচনী কৌশল হিসেবেই দেখছেন কমলেশ্বর। তাঁর কথায়, ‘‘অতীতেও আমরা এ রকম কৌশল দেখেছি। তার ফলে মেরুকরণ হয়তো বাস্তবায়িত হয়েছে, ভোটে লাভ হয়েছে। কিন্তু সার্বিক ভাবে দেশের মানুষের কোনও উন্নতি হয়নি।’’ কমলেশ্বর মনে করেন, নির্বাচনের আগে নিজেদের দুর্বলতা থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ফেরাতেই সরকার সিএএ নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। তিনি বললেন, ‘‘অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব দেশে একটা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। পাশাপাশি, নির্বাচনী বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ। সব মিলিয়ে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল চাপে পড়়েছে বলেই এখন সিএএ-কে হাতিয়ার করা হয়েছে।’’ লোকসভা নির্বাচনের তারিখ এখনও ঘোষণা করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন দেশের বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বৈঠক করছে। কমলেশ্বর বিশ্বাস করেন, আগামী দিনে সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরও জোরালো হবে।
সিএএ প্রণয়ন করার নেপথ্যে একাধিক কারণকে ‘অনুঘটক’ হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা কৌশিক সেন। তিনি বললেন, ‘‘নির্বাচনী বন্ড নিয়ে স্টেট ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশ্যে এসেছে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনার অরুণ গয়াল পদত্যাগ করেছেন। ফলে শাসকদলের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।’’ তাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতেই এখন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে হাতিয়ার করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন কৌশিক। কিন্তু সেখানেও সমস্যা রয়েছে বলে উল্লেখ করলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘পড়ে দেখলে বোঝা যাবে, অনেক কমিটি এবং নথিপত্র খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে। এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে মানুষকে কেন যেতে হবে? তাঁরা তো এই দেশেই থাকছেন! আবার বিগত কয়েক বছরে সিএএ-র বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়েছে। বিচারাধীন পরিস্থিতিতে কী ভাবে এই আইন ঘোষণা করা হল, জানি না।’’
সিএএ নিয়ে অতীতে প্রতিবাদের সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। এ রাজ্যেও সেই প্রতিবাদের আঁচ লেগেছিল। কিন্তু নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ কেন চুপ, তা ভেবে হতাশ কৌশিক। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘প্রত্যেক বার শুধু আমরা গুটি কয়েক মানুষ কেন প্রতিবাদ করব? বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ তো বামফ্রন্টের সময়েও চুপ করে ছিলেন, এখনও তাই।’’ কৌশিকের মতে, বুদ্ধিজীবীদের নির্দেশিত পথে জনগণ হাঁটবে, সেই দিন এখন বদলেছে। বরং অস্তিত্বের সঙ্কটে চিন্তিত মানুষ ঘুরে দাঁড়ালে সেই প্রতিবাদকে অনুসরণ করবে তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ সম্প্রদায়। তিনি বললেন,‘‘আমরা চুপ করে থাকলে প্রশ্ন ওঠে, কেন চুপ করে রয়েছি। আর যাঁরা দীর্ঘ দিন চুপ করে রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে কিন্তু মানুষ প্রশ্ন করেন না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy