‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবির পোস্টারে মুখ্য অভিনেতা চন্দন সেন।
ছবিটা দেখতে দেখতে আগাগোড়া প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে টিকটিক করছিল। সেই প্রশ্নগুলো এতটাই গূঢ় যে, এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে অহর্নিশ।
ডুগডুগি বাজিয়ে, সাইকেলের উপর তৈজসপত্র চাপিয়ে সরু গলির ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক বাসনওয়ালা। দূর থেকে খানিক সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে এক আটপৌরে, দীনহীন লোক। ঢোলা ট্রাউজ়ার্স। ঢলঢলে ফুলস্লিভ শার্ট। পায়ে চপ্পল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। রোদ বাঁচাতে মাথায় ছাতা।
এই লোক জীবনে সরু হয়ে বাঁচে। অফিসে নিজের দফতর থেকে বেরিয়ে লিফ্টে চিলুবিলু ভিড় দেখে সে দিক না-মাড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে টুকটুক করে নীচে নামে। প্রতি দিন ফুটপাথের এক নিষ্পত্র, মরা গাছের গোড়ায় জল দেয়। তার পরে মুখ তুলে মগডালের দিকে তাকায়। যদি পাতা গজায়!
যা কিছু পরিত্যক্ত, তা নিয়েই তার জীবন। সে নিজেও প্রায় নির্বান্ধব। প্রাচীন বাড়ির পরিত্যক্ত ছাদে পরিত্যক্ত এবং ভাঙাচোরা টেলিভিশনের খোলের মধ্যে পোষে লতাগুল্মের ঝাড়। ঘরের বিছানায় সমাজ এবং পরিবার-পরিত্যক্ত ডিমেনশিয়া-আক্রান্ত পিতা। তাঁর বুকের পাঁজর গোনা যায়। তাঁর বুকের উপর তাঁর মতোই স্থাণু বসে থাকে আদ্যিকালের বদ্যি টেপ রেকর্ডার। তাতে প্রায় গোঙানির মতো বেজে চলে রবীন্দ্রসঙ্গীত। অদম্য কৌতূহল এবং সারল্যমাখা গলায় তিনি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘নেতাজি কি ফিরলেন?’’ স্নেহমাখানো এবং পিতাসুলভ উদ্বেগ কণ্ঠে নিয়ে অফিস যেতে উদ্যত পুত্রকে বলেন, ‘‘টিফিনটা খেয়ে নিয়ো।’’ পুত্র পোড়োবাড়ির মতো সেই আপাত-পরিত্যক্ত ঘরে বাবার জন্য রাতে মশারি টাঙায়। বাজারে গিয়ে দামি মাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চুনো মাছ কিনে ফেরে। কাজে বেরোনোর আগে বাবার বুকে-ঘাড়ে-পিঠে-বগলে জল স্প্রে করে কাকস্নান করায়। থালা থেকে মাছ বা সামান্য তরিতরকারির সঙ্গে ভাতের গ্রাস বানিয়ে বাবার মুখে গুঁজে দেয়। সেই একই থালা থেকে নিজেও খেয়ে নেয় কয়েক গরাস। অফিসে গিয়ে ফাইলের পাহাড়ের পাশে বসে থাকে নিষ্পলক।
তার আছে সেই মাঠ, শকুন-ওড়া যে প্রান্তরে শহরের যা কিছু পরিত্যক্ত এবং পরিত্যাজ্য, সে সবের ঠাঁই হয়। যে মাঠে ফনফন করে বাতাস বয়। সেই দমকা হাওয়ায় উড়ে যায় তার জমিয়ে-রাখা টুকিটাকি। তার আবৃত্তি শেখানোর আকর্ষণ আটক থাকে দু’টি পান্তুয়ায়। ছাত্রের মায়ের দেওয়া সেই পান্তুয়া দু’টি গলাধঃকরণ করে সে মন্দ্রস্বরে সুকুমার রায় আবৃত্তি করে—
‘আজকে দাদা যাওয়ার আগে বলব যা মোর চিত্তে লাগে নাই বা তাহার অর্থ হোক নাই বা বুঝুক বেবাক লোক।’
বিনা নোটিসে সেই চাকরিটি হারানোর পর সে যখন দোকানে গিয়ে দু’টি পান্তুয়া কিনে গপগপ করে খায়, তখন মনে হয়, মাসে ৩০০ টাকার চাকরি আর মাটির ভাঁড়ে রসে চোবানো পান্তুয়া কোথাও মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেটের ফিতে জড়িয়ে গিয়ে গান থেমে যায়। যেমন থেমে যায় টিকটিক করে চলতে থাকা তার বাবার জীবন। আরও একলা হয়ে যাওয়া তাকে দজ্জাল বৌয়ের তাড়না-লাঞ্ছিত বাড়িওয়ালা এক মাসের নোটিস দেয় বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বাবার দাহসংস্কারের পর গঙ্গায় ক্ষৌরকর্ম করাতে গিয়ে তার আধা ন্যাড়া মাথায় তিরের মতো বিঁধতে থাকে কটকটে রোদ্দুর।
আর তখনই তার একাকী বর্ণহীন, সাদা-কালো, রং-রূপ-রসহীন জীবনের দরজা ঠেলে আচমকা ঢুকে পড়ে একখণ্ড মেঘ!
তরঙ্গহীন দৈনন্দিনতা ভন্ডুল হয়ে যায়! সেই মেঘ তার জীবনে প্রথমে আনে আতঙ্ক। তার পরে বন্ধুত্ব। অতঃপর প্রেম। প্রথমে সে সেই মেঘখণ্ড থেকে তড়বড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তার মনে হয়, রোদ ঝলমলে আকাশে চরে বেড়ানো সেই মেঘ তার পিছু ধাওয়া করছে। জীবনে আচম্বিতে ঢেউ ওঠে। তার সরু অস্তিত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। যখন সেই মেঘ তার ছাদের উপরের আকাশে স্থির হয়ে থাকে, তখন সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে চুপি চুপি ভিতু ভিতু চোখে তাকে দেখে। রাস্তায় চলতে চলতে ছাতা দিয়ে মেঘের নজর থেকে নিজেকে ঢেকে রাখে। অন্য কেউ সেই মেঘকে দেখতে পায় না। খালি সে দেখে। সে দেখে আর ভয় পায়। তার একমাত্র বান্ধব তাকে নিয়ে যায় চোখের ডাক্তারের কাছে। খুড়োর কলে সে যখন থুতনিটি ঠেকিয়ে বসে আছে, তার বন্ধু চিকিৎসককে বলে, ‘‘মেঘ দেখসে। একটা মেঘ নাকি ২৪ ঘণ্টা ওকে ফলো করসে!’’
চক্ষুচিকিৎসক খেঁকুটে গলায় বলেন, ‘‘মেয়ে ফলো করছে? তা, তার সঙ্গে কথা বললেই হয়!’’
মেয়ে নয়। মেঘ। তবু কথাটা মনে ধরে তার। সেই শুরু। মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা ছেড়ে বন্ধুত্ব এবং ক্রমশ প্রেম। ছাদের সেই মেঘ তাকে আগলে রাখে, ছায়া দেয়। তৈরি করে এক মায়াবী বিভ্রম। সেই মেঘ থেকে অঝোরে ঝরে-পড়া বৃষ্টির জল লোহার বালতিতে পরম যত্নে ধরে রাখে। নগ্ন হয়ে সেই জলে ধারাস্নানে তার আশরীর ভালবাসাবাসি হয় প্রেয়সীর সঙ্গে। মেঘের প্রশংসা পেতে চেয়ে বৈশাখের ঠা-ঠা গরমে কোট-প্যান্ট পরে সে চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকে গড়ের মাঠে। নতুন বাড়ি খোঁজার সময় ‘ছাদওয়ালা’ বাড়ি খুঁজতে শুরু করে। মেঘকে সে বলে, ‘‘একটা ছাদ ছাড়া কি আমাদের হয়? বলো?’’ বাড়িওয়ালাকে শেষ বারের মতো চাবি দেওয়ার সময় বলে, ‘‘আমরা কাল সকালেই চলে যাব।’’ আমরা। অর্থাৎ, তার আর মেঘের সংসারের দু’জন।
প্রকৃতিগত ভাবে নিঃসঙ্গ। ঘটনাবিহীন, একঘেয়ে এক জীবন। বিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা, নৈকট্য, বন্ধুত্ব, প্রেমবিলাস নিয়ে এক অভিযাত্রা। নাগরদোলায় অবিরল ওঠানামার মতো।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আমরাও কি জীবনে একটা ফ্যান্টাসি চাই না? ওই মেঘের মতো? যে আমাদের ছায়া দেবে। আমাদের একার হয়ে থাকবে। আমরা, যারা ঢোলা ট্রাউজ়ার্স, ঢলঢলে ফুলস্লিভ শার্ট বা দৈনন্দিন লুঙ্গি-স্যান্ডো গেঞ্জির বাঙালি নিম্নবিত্ত। আমরা, যাদের বাস শৌচাগারের দেওয়ালে ধ্যানমগ্ন, দার্শনিক এবং নিথর মাকড়সা বা সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে টাঙানো ছবির পিছনে বসবাসকারী বাচাল টিকটিকির সঙ্গে।
এই লোকটির প্রতিটি চাহনি, প্রতিটি দুঃখ, প্রতিটি হাসির মধ্যে কোথাও যেন নিজেকে দেখতে পাই। নিজের অজান্তেই নিজের মধ্যে একটা জাদুবাস্তবতা তৈরি হয়। তার সঙ্গে পথ হাঁটি। তার ছাতার তলা থেকে উঁকি মেরে নিজের প্রিয় মেঘটিকে দেখি।
ছবির নাম ‘মানিকবাবুর মেঘ’। এই ছবি দেশ-বিদেশের প্রচুর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ঘুরেছে। ‘সেরা অভিনেতা’-সহ দেশ-বিদেশে প্রচুর পুরস্কারও পেয়েছে। একাধিক মহাদেশে এই ছবির প্রিমিয়ার হয়েছে। কিন্তু ৯৮ মিনিট ২৫ সেকেন্ডের এই ৯৮ শতাংশ সাদা-কালো ছবির পিছনে যদি সে সমস্ত পেখম না-ও লাগানো থাকত, তা-ও মানিকবাবু এবং তার মেঘ সম্ভবত এমনই প্রভাবিত করত। আমি ফিল্মের বোদ্ধা নই। যেমন আমি মার্গসঙ্গীতেরও বোদ্ধা নই। সঙ্গীতমূর্খের কানেও কোনও গান শুনতে ভাল লাগলে সেটাই তার উৎকর্ষের সূচক হয়ে থাকে। ফলে এই ছবি ‘ছবি’ হিসেবে কেমন, তা বলতে গেলে নিজের অশিক্ষা এবং মূর্খামির বিজ্ঞাপন হয়ে যাবে। যেমন হবে এই ছবিতে কে কেমন অভিনয় করেছেন, তা মাপতে গেলেও। সে সবের ধৃষ্টতা আমার নেই। ছিলও না কোনও দিন।
কিন্তু দেখতে দেখতে বুঝতে পারি, এই ছবি এক নিঃসঙ্গতার কথা বলে। কিন্তু উচ্চকিত ভাবে বলে না। এই ছবিতে সংলাপও খুব সীমিত। কারণ, এই ছবির লোকের জীবনে কোনও ঘটনা নেই। তরঙ্গ নেই। আলাপ নেই। বিলাপ নেই। তাই সংলাপও নেই। সে সব কিছু নীরবে মেনে নেয়। প্রিয়জনের চলে যাওয়া, সংসারের নানা ঝক্কি এবং দায়িত্ব, প্রতারিত হওয়া, বাড়িওয়ালার ঘ্যানঘেনে উৎপীড়ন, টিউশনির বাড়িওয়ালির নিষ্করুণ ব্যবহার, পদে পদে হেরে যাওয়া এবং তজ্জনিত বিষণ্ণতা— সব। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এগুলোই মিলেমিশে কি আমরা নই? আমরা কি সকলেই ভিতরে ভিতরে খুব একা, নিঃসঙ্গ আর নির্বান্ধব নই? নিঃসঙ্গতায় কি আমরাও অহরহ থাকি না? আমরা কি বিবিধ সম্পর্কের সিমেন্ট গেঁথে দেওয়ালের সেই ফাঁকফোকরগুলো ভরানোর চেষ্টা করি? না কি করি না? আমরা কি এত শব্দ চাই চারপাশে? আমরাও কি এক টুকরো মেঘেরই অপেক্ষা করি?
আগাগোড়া প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে টিকটিক করছিল। সেই গূঢ় প্রশ্নগুলোই তাড়া করে বেড়াচ্ছে অহর্নিশ। আর কল্পনায় রয়ে যাচ্ছে রসে টইটম্বুর দু’টি পান্তুয়া সহযোগে মন্দ্রকণ্ঠের আবৃত্তি—
‘হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা, নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা। হেথায় রঙিন আকাশতলে স্বপ্ন দোলা হাওয়ায় দোলে।’
(শিরোনাম ঋণ: সুকুমার রায়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy