Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bangladesh Protest

শহিদ আবু সাঈদ: এই যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে? কারা?

পুলিশবাহিনীর বন্দুকের নল থেকে ক্রমাগত ছিটকে-আসা রবার বুলেট কি আসলে তার বিশ্বাসকেই বিদ্ধ করছিল? ছিন্নভিন্ন করছিল ক্রমাগত?

এঁকেছেন শৌভিক দেবনাথ।

এঁকেছেন শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২৪ ০৯:০১
Share: Save:

কত ক্ষণের হবে ভিডিয়ো ক্লিপটা? মেরেকেটে মিনিটখানেক! দেখতে দেখতে অসুস্থ লাগছিল। ভিতরে একটা অস্বস্তি।

যুবকের মুখে কোমল দাড়ি-গোঁফ। পরনে কালো গোল-গলা টি-শার্ট আর ধূসর ট্রাউজ়ার্স। পায়ে ম্যাড়মেড়ে, ধূলিধূসরিত স্নিকার্স। দুটো হাত দেহের সঙ্গে সমান্তরালে আড়াআড়ি ছড়ানো। ডান হাতে একটা বাঁশের খেঁটে লাঠি নিয়ে চেহারাটা দাঁড়িয়ে আছে বুলেটের মুখোমুখি। একেবারে একা। তার কথা শোনা যাচ্ছিল না। সম্ভবত সে বলছিলও না কিছু। কিন্তু তার শরীর বলছিল। তার চাহনি বলছিল। তার ভঙ্গি বলছিল।

তার ঠিক পিছনেই একটা ধাপ উঠে একটা মরা ঘাসের চত্বর। সেখানে সার দিয়ে গাছ পোঁতা। সেই গাছের সারির আশপাশে প্রচুর যুবক-যুবতী। ছাত্রছাত্রীই হবেন নিশ্চয়ই। তাঁরা কি খানিকটা অবাক হয়েই দেখছিলেন আগুয়ান চেহারাটাকে? সামনে বন্দুক তাক করেছে হেলমেটধারী, উর্দি-পরিহিত পুলিশবাহিনী। কিন্তু চেহারাটা দাঁড়িয়েই আছে। দুটো হাত দেহের সঙ্গে আড়াআড়ি ছড়ানো। ডান হাতে একটা খেঁটে বাঁশের লাঠি। অনড়। অটল।

‘ফটাস’ করে একটা শব্দ হল। চেহারাটায় কি একটা আলতো ঝটকা লাগল? আবার ‘ফট-ফট-ফট’ শব্দ। দেখা গেল, হাতের লাঠিটা দিয়ে চেহারাটা তাকে লক্ষ্য করে ছুটে-আসা বুলেট আটকানোর চেষ্টা করছে! একটু কি বিস্ময় তার দৃষ্টিতে? এক বার কোমরটা ঝুঁকিয়ে নিজের বুকের দিকে অবিশ্বাসীর মতো তাকালও কি? সে কি ভেবেছিল, প্রায় নিরস্ত্র হাতে শুধু একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়ানো তাকেই সটান তাক করবে বন্দুকধারী পুলিশবাহিনী? সেই বন্দুকের নল থেকে ছিটকে-আসা রবার বুলেট কি আসলে তার বিশ্বাসকেই বিদ্ধ করছিল? ছিন্নভিন্ন করছিল ক্রমাগত? যে, আমি তো আক্রমণ করিনি! আমি তো বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে এক মৌনী প্রতিবাদ জানাচ্ছি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে! আমি তো কোনও অপরাধ করিনি! তা সত্ত্বেও কেন গুলি করছে ওরা!

রাষ্ট্রযন্ত্র অবশ্য এ সব বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তোয়াক্কা করে না। বুলেটবৃষ্টি অতএব হতেই থাকল। সেটা এড়াতে একটু তিড়িংবিড়িং লাফাল চেহারাটা। তার পরে আবার দু’হাত আড়াআড়ি দেহের সমান্তরালে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাত্রই কয়েক সেকেন্ড যদিও। এক একটা করে বুলেট এসে লাগছিল, আর এক একটা ঝটকা খেতে খেতে চেহারাটা পিছিয়ে যাচ্ছিল। পিছোতে পিছোতে পিছনের ধাপ বেয়ে ঘাসের চত্বরে উঠে গেল চেহারাটা। তার পরে দু’পায়ের আঙুলগুলোর উপর ভর দিয়ে উবু হয়ে বসে পড়ল।

ডান দিক থেকে এক জোড়া পা দৌড়ে এল। ডান হাত ধরে টেনে তুলল চেহারাটাকে। চেহারাটা দাঁড়াল লগবগ করতে করতে। কয়েক পা সামনে এগোনোর চেষ্টা করল। তখনও। যে দিকে উদ্যত বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশবাহিনী। তখনও। কিন্তু তত ক্ষণে সম্ভবত জীবন নিঃশেষিত হয়ে আসছিল তার। পিছু ফিরল সে। সামনে দাঁড়ানো একটা রংচঙে রিকশা। সেটাতেই বোধ হয় তাকে তোলার চেষ্টা করছিল সতীর্থ। চেহারাটা শুনল না। টলমলে পদক্ষেপে রিকশাটাকে কাটিয়ে গেল। তার পরেই হাঁটু ভেঙে গেল তার। কাটা কলাগাছের মতো ভাঙাচোরা একটা ‘দ’ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল চেহারাটা।

আশপাশ থেকে দৌড়ে এল আরও কয়েক জোড়া পা। বুলেটবিদ্ধ চেহারাটা ধরাধরি করে মাটি থেকে তুলে নিয়ে কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যে তারা যেন কোথায় একটা চলে গেল।

তারা গিয়েছিল রংপুর মেডিক্যাল কলেজে। অবশ্য সেখানে পৌঁছনোর আগেই রবার বুলেটে ঝাঁজরা সেই চেহারা থেকে প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছে। ‘চেহারা’ থেকে ‘দেহ’ হয়ে গিয়েছে কিছু আগে সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো শরীর।

রুজির ধান্দায় গত সাড়ে তিন দশকে অজস্র গণ আন্দোলন কভার করার অবকাশ ঘটেছে। কিন্তু পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে এমন বুক টান করে কাউকে আগে দাঁড়াতে দেখিনি কখনও। গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়া কথাটা বহু বার বলতে শুনেছি। পড়েওছি। চোখে দেখিনি কখনও। এই প্রথম দেখলাম— বুক পেতে দেওয়া!

দোহারা চেহারাটাকে ওই ভাবে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পঁয়ত্রিশ বছর আগে তিয়েনানমেন স্কোয়্যার মনে পড়ে যাচ্ছিল। এমনই এক ছাত্রবিক্ষোভে অংশ নিতে সেখানে জড়ো হয়েছিল লক্ষ জনতা। বিক্ষোভ দমন করতে তিয়েনানমেনে ট্যাঙ্কবাহিনী পাঠিয়েছিল চিনের কমিউনিস্ট সরকার। কথিত যে, সেই বাহিনী স্কোয়্যারের মধ্যে পিষে মেরেছিল কয়েক হাজার ছাত্রকে। দমনলীলা চালিয়ে যখন পরদিন স্কোয়্যার ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ফৌজি ট্যাঙ্ক, বাঁ’হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে ট্রাউজ়ার্স-বুশ শার্টের এক সাধারণস্য সাধারণ চেহারা দাঁড়িয়ে পড়েছিল কলামের একেবারে প্রথম ট্যাঙ্কটির সামনে। চালক পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেই চেহারা জায়গা বদলে আবার ট্যাঙ্কের সামনে হাজির হচ্ছিল। হতেই থাকছিল।

জুন ১৯৮৯। তিয়েনানমেন স্কোয়্যার। বেজিং। ট্যাঙ্ক ম্যান।

জুন ১৯৮৯। তিয়েনানমেন স্কোয়্যার। বেজিং। ট্যাঙ্ক ম্যান। ছবি: সংগৃহীত।

শেষ পর্যন্ত ট্যাঙ্কবাহিনী তিয়েনানমেন স্কোয়্যার থেকে কী করে বেরিয়েছিল, বা সেই একলা প্রতিবাদীর কী হয়েছিল, সেটা জানা যায়নি। কিন্তু সেই এক একা মানুষের কালান্তক ট্যাঙ্কের মুখোমুখি নিথর দাঁড়িয়ে থাকার ফ্রেম দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বৈগ্রহিক ছবি হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিত হয়ে রয়েছে। সেই অখ্যাত, অজ্ঞাত এবং অপরিচিত মানুষটি বিশ্ব জুড়ে পরিচিত হয়ে রয়েছেন ‘ট্যাঙ্ক ম্যান’ নামে।

ট্যাঙ্ক ম্যানের সেই প্রতিবাদের পঁয়ত্রিশ বছর পরে বাংলাদেশের রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো যুবক আবু সাঈদের ছবিটিও বিগ্রহের মতোই পূজিত হতে শুরু করেছে পৃথিবী জুড়ে। সেই ছবি যে তীব্র, তীব্রতম অভিঘাত তৈরি করেছে, তার তুল্য সাম্প্রতিক কালে আর কিছু মনে করতে পারছি না। আবু সাঈদ যে প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা বলতে শুরু করেছেন, ‘‘আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে ওই গুলি ছোড়া হয়নি। ছোড়া হয়েছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষকে লক্ষ্য করে। মারা গিয়েছে আবু সাঈদ। কিন্তু আবু সাঈদ সকলের প্রতিনিধি।’’ বলছেন, ‘‘আবু সাঈদকে খুন করা হয়েছে! ওখানে কোনও সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আবু সাঈদ পুলিশকে আক্রমণও করতে যায়নি। একজন নিরস্ত্র মানুষের বুক, মাথা, পেট লক্ষ্য করে কেন গুলি করা হবে? একটা পাখিকেও এ ভাবে গুলি করা যায় না!’’

আবু সাঈদ এখন ‘শহিদ আবু সাঈদ’। যে চত্বরে তাঁর ভিতরে রবারের বুলেট ভরে দেওয়া হয়েছিল, সেই চত্বরের নাম হয়ে গিয়েছে ‘শহিদ আবু সাঈদ চত্বর’।

বন্দুকের সামনে বুক টান করে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবিটির সঙ্গে বহির্বিশ্বের পরিচয় গত ১৬ জুলাই। রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ডেথ সার্টিফিকেটে যে তারিখটি লেখা রয়েছে। জুন মাস থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন। যার পুরোভাগে ছাত্রছাত্রীরা। জুনে যে আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে শুরু করেছিল তুষের আগুনের মতো, জুলাইয়ের প্রথম থেকে তা ছড়াতে শুরু করে দাবানলের মতো। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নামতে শুরু করেন। তাঁদের মাথায় বাঁধা জাতীয় পতাকার ফেট্টি। হাতে প্রমাণ সাইজ়ের জাতীয় পতাকা।

তাঁদেরই একজন ছিলেন আবু সাঈদ। ‘শহিদ’ আবু সাঈদ।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের বয়স পঁচিশ। বাড়ি রংপুরের নীলগঞ্জ উপজেলার এক গণ্ডগ্রামে। বাবা দিনমজুর। তাঁর ন’জন সন্তানের মধ্যে আবু সাঈদ এক জন। অর্থাভাবে দিনমজুরের ছেলের লেখাপড়া হওয়া দুঃসাধ্যই ছিল। কিন্তু আবু সাঈদ ইস্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নিজের প্রিয় বিষয় ইংরেজি নিয়ে। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালাতেন। সঙ্গে বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতেন মাসে মাসে। বাংলাদেশ জুড়ে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছে, আবু সাঈদ ছিলেন তার একেবারে সামনের সারিতে। কো-অর্ডিনেটর। পোশাকি ভাষায় ‘সমন্বয়ক’। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ রেকর্ড-করা ভিডিয়োয় আবু সাঈদের পরনে সাদা-কালো চেক শার্ট। চোখে চশমা। মাথায় জাতীয় পতাকার রঙের ফেট্টি। তিনি বলছেন, ‘‘আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা শঙ্কিত। তবে আমরা চাচ্ছি, যাতে এই ব্যাপারে আমাদের তরফ থেকে কোনও সমস্যা না হয়।’’

তাঁকে দেখে, তাঁর কথা শুনতে শুনতে এক বারও মনে হয়নি, তাঁর জীবনটা আর কয়েক দিনের ওয়াস্তা। মনে হয়নি, এই সাদামাঠা চেহারার যুবক ওই ভাবে বুক টান করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। মনে হয়নি, তাঁর দেহের সমান্তরালে ছড়ানো দু’হাতে ধরা থাকবে নীরব এবং অহিংস প্রতিবাদের অদৃশ্য পতাকা।

মনে হচ্ছিল যুগে যুগে, কালে কালে, দেশে দেশে ছাত্রছাত্রীরা গণ আন্দোলনে নেমে ইতিহাস বদলে দিয়েছেন। মনে পড়ছিল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হোক কলরব’ আন্দোলন যখন তুঙ্গে, প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং অধুনাপ্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘ছাত্র আন্দোলন কখনও দমন করতে নেই। ছাত্রদের কোনও পিছুটান থাকে না। মনে শঙ্কা থাকে না। ভয় থাকে না। ছাত্র আন্দোলন সমস্ত আন্দোলনের চেয়ে আলাদা।’’

মনে হচ্ছিল, ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা আবু সাঈদের বন্দুকের সামনে বুক টান করে দাঁড়ানো এবং গুলি খেয়ে মরার চলমান দৃশ্য সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে বিস্ময়, শোক এবং তজ্জনিত ক্রোধের হুতাশন জ্বালিয়ে দিয়েছে, তাঁর দিনমজুর পিতার আর্তি কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর মধ্যে যে তরঙ্গ এবং হিল্লোল তুলেছে, সেই যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে? কারা?

ভিডিয়োটা দেখতে দেখতে অসুস্থ লাগছিল। ভিতরে একটা অস্বস্তিও হচ্ছিল। ঠিকই। কিন্তু অবাকও লাগছিল। এমন এক মানুষও বেঁচে ছিলেন আমাদের এই পৃথিবীতে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy