প্রতীকী ছবি।
নির্মলা সীতারামন তাঁর বাজেটে জানালেন, ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ডিজিটাল মুদ্রা চালু করতে চলেছে। পাশাপাশি জানা গেল, ডিজিটাল সম্পদের উপর ত্রিশ শতাংশ কর ধার্য করা হচ্ছে। প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে অভিনব। কেন্দ্রীয় সরকার স্পষ্ট করে দিল যে, রাষ্ট্র হিসাবে ভারত ডিজিটাল মুদ্রা প্রবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা নেবে। চিন এখনও বিষয়টিকে ভাবনাচিন্তার স্তরেই রেখেছে; ইংল্যান্ড-আমেরিকাও এ বিষয়ে সন্তর্পণে এগোচ্ছে।
ডিজিটাল মুদ্রা একটি ইন্টারনেট-ভিত্তিক মুদ্রা, যার সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হল বিটকয়েন। এই মুদ্রা দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ব্যবসা করা সম্ভব পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। টাকা পাঠানো, বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের কোনও বিড়ম্বনা নেই। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই মুদ্রায় লেনদেন করতে পারেন, কোনও রকম সরকারি বিধিনিষেধ বা নজরদারি ছাড়াই। এই মুদ্রাটির সঞ্চালন হয় ব্লকচেন বলে একটি আন্তর্জাল ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে। এ-হেন ক্রিপ্টোকারেন্সি যেমন সোনা বা শেয়ারের মতো সম্পদ হতে পারে, তেমনই হতে পারে টাকা বা ডলারের মতো ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যম। বাজেটের আগে অবধি ভারতে ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন নিয়ে এক ধরনের অস্বচ্ছতা ছিল। নির্মলা এই সম্পদের উপর আয়কর ধার্য করে একে বৈধতা দিলেন। এই করের বোঝা ধনীরাই বইবেন বলে মনে হয়। কারণ, ধরে নেওয়াই যায় যে, মূলত সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরাই এই ডিজিটাল মুদ্রা ভিত্তিক লেনদেন করবেন বেশি।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, অতঃপর ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি করবে, এবং তাকে বাজারে ছাড়বে। এই ডিজিটাল মুদ্রা ভারতের লিগাল টেন্ডার বা বৈধ মুদ্রা হবে— যার অর্থ, এখন থেকে এই মুদ্রা দিয়ে দেশের মধ্যে যে কোনও ঋণ পরিশোধ করা যাবে। বেসরকারি ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রে একটা মস্ত সমস্যা হল, কে বেচছেন, আর কে কিনছেন, সেই পরিচয় অজ্ঞাত রেখেই কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়। সরকারি ডিজিটাল মুদ্রায় এই সমস্যা কমই হওয়ার কথা। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক তার ব্লকচেন প্রযুক্তি দিয়ে ডিজিটাল মুদ্রার লেনদেনের উপর সার্বিক তদারকি করতে পারবে বলেই মনে হয়। অতএব সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি) প্রচলন হলে বেআইনি লেনদেনের উপর রাশ টানা যাবে। কিন্তু এই সরকারি ডিজিটাল মুদ্রা অন্য রকম জটিলতার সৃষ্টি করবে না তো?
প্রথমত, নাগরিকদের হাতে এখন সরাসরি চটজলদি লেনদেনের তিনটি মাধ্যম তৈরি হচ্ছে— নগদ টাকা, বেসরকারি ডিজিটাল মুদ্রা, আর সিবিডিসি। নগদ অর্থের ব্যবহার সে ক্ষেত্রে হ্রাস পেতে পারে। অনেক ব্যাঙ্ক হয়তো নগদ নিতেই নারাজ হতে পারে, যেমনটি ঘটেছিল ২০১৮ সালে সুইডেনে। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষ এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের ব্যবসায়ীরা, যাঁদের লেনদেন মূলত নগদ টাকাভিত্তিক। এতে ২০১৬ সালের ডিমনিটাইজ়েশনের দুঃস্বপ্ন ফিরে আসতে পারে, সেই আশঙ্কা থাকছে।
দ্বিতীয়ত, সিবিডিসির প্রবর্তনের ফলে দেশে কি মূল্যস্ফীতি হতে পারে? সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে একটা অন্য প্রশ্ন করা প্রয়োজন— সিবিডিসির সঙ্গে সরকারি বাজেটের কী সম্পর্ক? নির্মলা সীতারামনের বাজেট থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে, এই বিপুল সরকারি কর্মযজ্ঞের জন্য টাকার ব্যবস্থা হবে কোথা থেকে। আয়কর কিন্তু বাড়ছে না। অর্থমন্ত্রী বলছেন, সরকার ঋণপত্র বিক্রি করে টাকা তুলবে। কিন্তু, যা স্পষ্ট করে বলা হল না, তা হল, এই ঋণপত্র বিক্রি করা হবে কাদের— জনসাধারণকে, যােক বলা হল বন্ড ফাইনানসিং; না কি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে, যাকে বলে ডেট মনিটাইজ়েশন? যদি প্রথমটি হয়, তা হলে সরকার জনসাধারণের কাছ থেকে ধার চাইছে। সরকারের ঋণের চাহিদা বাড়ানোর জন্য সুদের হার বাড়াবে। এতে ঋণবদ্ধ ক্ষুদ্র সংস্থাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি কম হবে। যদি সরকার দ্বিতীয় পদ্ধতিতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে ধার নেয়, তা হলে মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ এই পদ্ধতিতে মুদ্রার জোগান বাড়বে। তবে মনে রাখতে হবে যে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এখন আর টাকা ছাপাতে নাও পারে, কারণ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এখন সিবিডিসি দিয়েও সরকারি ঋণপত্র কিনতে পারবে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে মুদ্রার জোগান খুব বেশি বাড়বে না। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি যদি এই ডিজিটাল মুদ্রা বা সিবিডিসিকে রিজ়ার্ভ কারেন্সি বা সংরক্ষিত মুদ্রা হিসাবে রাখে, তা হলে তার কোনও প্রভাব মূল্যস্ফীতির উপর পড়বে বলে মনে হয় না, যদি না ব্যাঙ্কগুলি সমস্ত সংরক্ষিত সিবিডিসি ঋণ হিসাবে দিয়ে দেয়।
তৃতীয়ত, যদি সিবিডিসি এবং বেসরকারি ক্রিপ্টোকারেন্সি একই সঙ্গে বাজারে চালু থাকে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। যদি সাধারণ নাগরিক সিবিডিসি আর নগদ টাকা ছেড়ে বেসরকারি ক্রিপ্টোকারেন্সিতেই লেনদেন করতে বেশি পছন্দ করেন, তা হলে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আরবিআই বাজারে মুদ্রা সরবরাহ করতে চাইলেও, এর কোনও প্রভাব অর্থনীতির উপর নাও পড়তে পারে।
কেন্দ্রীয় বাজেট এ রকম অনেক ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত বেশ অস্বচ্ছ। ডিজিটাল মুদ্রা ভাল, যদি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এই প্রসঙ্গগুলি মাথায় রাখে।
অর্থনীতি বিভাগ, ডারহাম ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy