সাড়ে চার বছরের বাচ্চা ছেলেটি মিষ্টি বিস্কুট চেয়েছিল। কৃমির সমস্যা, তাই মা দেননি। রেগে চিৎকার করে আলমারিতে ঘুষি, কাচ ভেঙে রক্তারক্তি কাণ্ড। হাসপাতাল, বুকে কব্জিতে সেলাই। প্রায় মাসখানেক পর সে সুস্থ হলে পড়শিদের পরামর্শে বাবা-মা নিয়ে যান মনোবিদের কাছে। সেখানেও মুশকিল, প্রথম সাক্ষাতেই শিশুটি তাঁর দিকে পেপারওয়েট ছুড়ে মারতে যায়।
চিকিৎসক বলেন বাচ্চাটি সুস্থ, কিন্তু তার ভিতরে উত্তেজনা অস্বাভাবিক বেশি, এক-এক সময়ে এক-এক কারণে বা অকারণেই তা হাট হয়ে পড়ছে। তিনি পরামর্শ দেন বাচ্চাটিকে কোনও সৃষ্টিশীল কাজে— ছবি আঁকা, মাটি দিয়ে কিছু গড়া বা কাগজ দিয়ে কোলাজ করা, এ সবে নিয়োজিত করতে। তিনি লক্ষ করেছিলেন, একটু আগে পেপারওয়েট ছুড়ে মারতে যাওয়া বাচ্চাটিই চেম্বারে অ্যাকোয়ারিয়ামের রঙিন মাছ দেখছে শান্ত হয়ে। তিনি বুঝেছিলেন, শাসন বা শৃঙ্খলার বেড়িতে এই ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার-অ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডার (এডিএইচডি) সারার নয়। চাই সৃষ্টিশীল নিয়োজন— আর্ট থেরাপি।
বিশ্ব জুড়ে এডিএইচডি, অটিজ়ম স্পেকট্রাম ডিজ়অর্ডার (এএসডি)-সহ প্রায় পঁচিশ রকম ‘কন্ডিশন’-যুক্ত বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশু আছে— ইউনিসেফ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সংখ্যাটা প্রায় চব্বিশ কোটি। বিশেষজ্ঞ-মত, এদের অনেককেই এই থেরাপির মাধ্যমে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আর্ট থেরাপি শিশুটির মানসিক বিকাশ ও সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রকে খুলে দেয়।
শিল্পকলা যে চিকিৎসাশাস্ত্রের অঙ্গ হতে পারে, বুঝেছিলেন মার্গারেট নোমবার্গ। তিনি একাধারে মনোবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, লেখক, আর্ট থেরাপির অগ্রণী তাত্ত্বিক। ১৯১৪ সালে নিউ ইয়র্কে শিশুদের জন্য একটি স্কুল খোলেন, প্রায় পঁচিশ বছর ধরে শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁর চোখে পড়েছিল তাদের কিছু শারীরিক-মানসিক দুর্বলতা। শিশুদের হাতে তিনি তুলে দেন ছবি আঁকার সরঞ্জাম। খেয়াল করেন, তাদের শরীরী ভাষায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে ইতিবাচকতা। সামাজিক মেলামেশার মধ্যে তারা আনন্দ পাচ্ছে, যা আগে ছিল না। শিল্পকলা ও চিকিৎসাবিজ্ঞান বেশ কিছু ক্ষেত্রে যে একে অন্যের পরিপূরক, তা নিয়ে লেখালিখি শুরু করেন তিনি।
১৯৪০-এর দশকে তাঁর এই মত প্রতিষ্ঠা পায়, বিভিন্ন পেশার মানুষ এই থেরাপি নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেন। ১৯৪২ সালে ‘আর্ট থেরাপি’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ শিল্পী অ্যাড্রিয়ান হিল। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই সময়ে যক্ষ্মার চিকিৎসার সীমিত পরিসর সত্ত্বেও তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাঁর মতে, অসুস্থ অবস্থায় রোজ ছবি এঁকে যাওয়া তাঁর ক্ষেত্রে থেরাপির কাজ করেছিল।
যে কোনও শিল্প মানুষের মনের ইতিবাচক আবেগগুলিকে সঙ্গ দেয়। মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে, বেশি ডোপামিন হরমোনের নিঃসরণ আমাদের আনন্দের অনুভূতি বাড়ায়। এডিএইচডি, এএসডি, পারকিনসন’স, ওবেসিটি, মাদকাসক্তি, স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া-সহ নানা রোগ ও অবস্থার ক্ষেত্রে এই হরমোনের গুরুত্ব অসীম।
ভারতের অন্যান্য শহরে তো বটেই, কলকাতাতেও এখন বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুদের জন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিল্পের আন্তরিক চর্চা দিয়ে ওদের মনের জগৎ আগলে রাখেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শিশুদের সৃষ্টিশীলতা যথেষ্ট উচ্চ মানের। তবে যত ক্ষণ না এদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, সেটা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। সাধারণ পাঠ্য বিষয় দিয়ে এদের ‘বিচার’ অনুচিত।
ওদের রঙের ভাবনার ব্যাপ্তি বিরাট। যে সব রং এরা অক্লেশে ব্যবহার করে, যে ভাবে তার বিন্যাস ঘটায় তা দেখে চমৎকৃত হতে হয়। মাটির কাজও ওদের খুব আকর্ষণ করে। কেউ মজা পায় ডুডলিং-এ, কেউ বা পেনসিল ড্রয়িংয়ে। যাদের শারীরিক ক্ষমতা খুব কম তারা মাথা ও কপালের সঙ্গে পয়েন্টার বা ব্রাশ যুক্ত করে চমৎকার কাজ করে। আবার প্রযুক্তির ব্যবহার এই সৃষ্টিশীলতা বাড়িয়ে দিতে পারে বহুগুণ, হাতের তুলির টানে যা করা অসম্ভব তা ফুটিয়ে তুলতে পারে কম্পিউটারের পর্দায়।
অনেক ক্ষেত্রে শুরুতেই বোঝা যায় না যে একটি শিশু বিশেষ ভাবে সক্ষম। হয়তো স্কুলে, ক্লাসরুমের আচরণে ধরা পড়ে তা। দেখা যায়, সাধারণ পাঠ্য বিষয়ের ক্লাসে সে অস্থির, উগ্র, কিন্তু আর্ট বা মিউজ়িক ক্লাসে শান্ত। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে সমন্বয় খুব জরুরি, অনেক ক্ষেত্রেই যা হয় না। শিশুর শরীর-মনের অসঙ্গতি অভিভাবকরা মানতে পারেন না, আবার ক্লাসের অন্য শিশুদের কথা মাথায় রেখে শিক্ষকরাও বুঝে উঠতে পারেন না কী করা উচিত।
এতে শিশুটির ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। তার জন্য বিশেষ শিক্ষণ প্রক্রিয়া প্রয়োজন কি না, বুঝতে হবে সংবেদনশীলতার সঙ্গে। দরকারে মনোবিদের পরামর্শ নিতে হবে। তার সঙ্গে তার মতো করে মিশতে পারার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে বাকি সমাজের। করুণা-মাখা সহানুভূতি নয়, চাই ভালবাসা-মেশা সমানুভূতি। এ কাজেই সঙ্গী হতে পারে শিল্পচর্চা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy