দৃষ্টান্ত: জনজাতিভুক্ত প্রথম মহিলা হিসাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন দ্রৌপদী মুর্মু। ছবি: পিটিআই
ভারত দেশের রাষ্ট্রপতি মহোদয়া, জোহার। আপনাকে মুন্ডারি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত আপনার মাতৃভাষা সাঁওতালিতে প্রত্যভিবাদন করার মধ্য দিয়ে এই ভাষার কাছে আমার ঋণ স্বীকার করছি। ‘জোহার’ থেকে শিখেছি, কী ভাবে একটি শব্দের সাহায্যে সকল মানুষের সঙ্গে সকল মানুষের মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক স্বীকৃতি পায়— সে সম্পর্কে বয়স, লিঙ্গ, জাতি ধর্ম ইত্যাদির ভেদাভেদ করা হয় না। কেবল মানুষে মানুষে নয়, এই সম্বোধনের মধ্য দিয়েই আমরা শিখেছি, কী ভাবে মানবিক সম্পর্ক মানুষের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। আমরা অজ্ঞান বলে জানার চেষ্টা করিনি, যে-সমাজে এই ভাষার উদ্ভব, সেই সমাজ সব মানুষ ও প্রকৃতির সকল সৃষ্টির মধ্যে সমতা ও ন্যায্যতার দর্শনের উপরে প্রতিষ্ঠিত। জন্মজাত ভাবে ভারত দেশের আদি বাসিন্দা ও নির্মাতাদের সামাজিক ধারায় আপনাকে, এবং যাঁরা আপনাকে নির্বাচিত করেছেন, এবং যাঁরা আপনার নির্বাচনের বিপক্ষে মত দিয়েছেন— সবাইকে জোহার।
মানতীয়, আপনার রাষ্ট্রপতি পদে বৃত হওয়ার সময়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এক দিকে যখন ভারত রাষ্ট্র পরিচালনায় ভারতের আদি-বাসিন্দাদের প্রতিনিধিত্বের বার্তা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, অন্য দিকে তখন আদিবাসী মানুষদের নিজভূমি ও পরিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগগুলো প্রবলতর বিক্রমে অনুষ্ঠিত। বহু দিনের সংগ্রামে আদিবাসীদের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ভারতবাসী প্রকৃতির সঙ্গে সহযোগিতা ও সহভাগিতার ভিত্তিতে বাঁচবার আংশিক স্বীকৃতি পেয়েছিল— ২০০৬ সালের অরণ্যের অধিকার আইনের মধ্য দিয়ে। আপনার নির্বাচনের প্রাক্-মুহূর্তেই সেই আইনকে খণ্ডিত করা হল। বলে দেওয়া হল, উন্নয়নের কারণে চিরাচরিত অরণ্য ধ্বংস করার প্রয়োজন মনে করা হলে তা-ই করা হবে, এ-বিষয়ে প্রকৃত অর্থে অরণ্যের পালিত ও পালক আদিবাসীদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। আপনি ভারত দেশের নির্মাতাদের সমাজ থেকে উঠে আসা, এবং আপনি জানেন, অরণ্য ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ কেবল দেশের ভবিষ্যতেরই নয়, মানবনৈতিকতারও পরিপন্থী।
মানতীয়, আপনি জানেন, এ-দেশের আদি বাসিন্দা ও নির্মাতাদের সামাজিক দর্শন হচ্ছে অনসূয়া— মানুষ কাউকে হিংসা করবে না, তা সে মানুষই হোক বা জীবজন্তু, গাছপালা, প্রাণিকুল। এবং, আপনি এ-ও জানেন যে, এই দর্শন প্রত্যেকের সমানাধিকারের কথা স্বীকার করে— শিশু-বৃদ্ধ সকলেই নিজ মতামত ব্যক্ত করতে পারে, বিরোধী কণ্ঠস্বর তুলে আনতে পারে, অসহমতির অধিকার ভোগ করে। অথচ, আপনার রাষ্ট্রপ্রধান রূপে শপথ গ্রহণের কালটিতে, দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে, কী ভাবে শাসনক্ষমতা মানুষের উপরে নানাবিধ বলপ্রয়োগ করছে। গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে আদিবাসীদের উচ্ছেদ থেকে শুরু করে, ভিন্ন মতাবলম্বীদের গ্রেফতার, তাঁদের উপরে সশস্ত্র হামলা, ধর্মীয় ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর নাগরিক অধিকার হরণ, এবং যে কোনও বিরোধিতার কণ্ঠরোধের মতো অন্যায্যতা ভারত দেশের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। আদিবাসী ভারত থেকে বহমান আধুনিক ভারতের অন্তর্দেশে যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ টিকে ছিল, আজকের ভারত রাষ্ট্র সেই মূল্যবোধকেই হনন করে চলেছে। আপনি জানেন, এই বৈর মানব আদর্শের উপরে আক্রমণ।
মানতীয়, আপনার চেয়ে কে বেশি জানে যে, একটা প্রকৃত সমাজে সকলের সমান অধিকারের চেয়ে বেশি কাম্য কিছু হতে পারে না। অথচ, এই দেশে কোটি কোটি মানুষ অধিকারগত বৈষম্যের শিকার, আর তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পীড়া যাঁদের অনুভব করে চলতে হয়, তাঁরা হচ্ছেন, আদিবাসী। শিক্ষার কথাই ধরা যাক। ব্রিটিশ বৈর-শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পরও আদিবাসীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের অক্ষর পরিচয়টুকুও হল না, আদিবাসী নারীদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত আরও দুর্বিষহ। আরও অন্যায্যতা, এই নিরক্ষরতার জন্য দায়ী করা হল আদিবাসীদেরই— তাঁরা নাকি লেখাপড়া শিখতে চান না! ওয়াকিবহাল লোকমাত্রেই জানে, দেশের আদিবাসী অঞ্চলগুলির বেশির ভাগেই বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই— স্কুল যদিও বা হল, শিক্ষক নেই; অথবা নিযুক্ত শিক্ষক বিজাতীয় দ্বেষদোষে অন্ধ।
একই রকম ভাবে, মানতীয়, বিপুলসংখ্যক দেশবাসী ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত বৈষম্যের শিকার। তাঁদের মধ্যে আবার আদিবাসীরা যেন আরও দগ্ধভাগ্য। আজকের দিনেও দেশে গড় যত শিশুমৃত্যু ঘটে (প্রতি হাজারে ৪২), আদিবাসীদের মধ্যে হয় তার চেয়ে প্রায় কুড়ি শতাংশ বেশি। দেশে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় যক্ষ্মারোগে সংক্রমিত হন ২৫৬ জন, আর আদিবাসীদের মধ্যে এই সংখ্যাটি হল ৭০৩— আদিবাসীরা দেশের জনসংখ্যার ৮ শতাংশ, কিন্তু যক্ষ্মায় মৃতদের ১৫ শতাংশই আদিবাসী। এক দিকে তাঁদের চিরায়ত জীবনজীবিকা থেকে উচ্ছিন্ন করে একটি মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থব্যবস্থাকে মজুরি-নির্ভর অর্থব্যবস্থায় বদলে দেওয়া, এবং এক নিরন্ন, নিঃসম্বল জীবন চাপিয়ে দেওয়া, অন্য দিকে রাষ্ট্র-স্বীকৃত অধিকারগুলি থেকেও বঞ্চিত থেকে যাওয়া, আদিবাসীরা যেন এই দুইধার তরবারির আঘাত সইবার জন্যই এই দেশটা নির্মাণ করেছিলেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্র তাঁদের নাগালের বাইরে, চিকিৎসক নেই, ওষুধ নেই, স্বাস্থ্যকর্মীর দেখা নেই। অথচ, তাঁদেরই বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘ওরা তো জড়িবুটি, ঝাড়ফুঁক করে; আধুনিক চিকিৎসা নিতে চায় না’। মানতীয়, আপনি জানেন, কী ভাবে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাবের সুযোগে আদিবাসী মানুষের উপরে আধুনিক চিকিৎসার প্রয়োগ হয় ভয়ানক আদিম প্রক্রিয়ায়— হাতুড়ে, মুদির দোকানি, হাটের ব্যাপারীদের দ্বারা।
আদিবাসীদের দোষী করা হয় ডাইনি প্রথা মেনে চলার অভিযোগে, কিন্তু এই প্রথার আগমন ঘটে সম্পত্তির ব্যক্তি-মালিকানার মতো তথাকথিত আধুনিক মতাদর্শের হাত ধরে। এবং তার সঙ্গে এক কুৎসিত শ্রেণিবিভাজন চাপিয়ে দিয়ে— যে বিভাজনে কিছু লোক মালিক, আর ব্যাপক জনসমূহ হয়ে যায় মজুর। আবার তাঁদের মধ্যে আদিবাসীরা চরম অসামঞ্জস্যে আটকে পড়া। দেশে মোট কর্মনিযুক্তিতে খেতমজুরের ভাগ মাত্র ২৪%, অথচ আদিবাসীদের মধ্যে এই হার ৩৬%, অন্যান্য মজুরির হিসাব যোগ করে এঁদের প্রায় ৯০ শতাংশের বেলাতেই ‘গরিবের গতরেরে গরব, যেদিন আনল সেদিন পরব’ আর ‘বড়লোকের পরব বারোমাস’।
মানতীয়, আধুনিক রাজনীতি ও অর্থনীতির হাত ধরে যে বিস্মরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে, সে বিষয়ে আপনার ওয়াকিবহাল থাকার কথা। এক দিকে আদিবাসীদের জানতে দেওয়া হল না তাঁদের কী প্রাপ্য, কী তাঁদের অধিকার, বিশ্বপৃথিবীতে কোথায় তাঁদের অবস্থান। আর তার চেয়েও বড় বঞ্চনা ঘটে সারা দেশের মানুষের— আদিবাসী সমাজের অসামান্য দার্শনিক উপলব্ধি এবং মানবিক বোধ সম্পর্কে বেড়ার অন্য পারে থাকা ছদ্ম উৎকর্ষের গৌরবে গর্বিত থেকে তাঁরা জানতেও পারেন না, কী বিপুল জ্ঞান ও চিন্তা-সমৃদ্ধি থেকে তাঁরা বঞ্চিত থেকে গেলেন। মতৈক্য না হওয়া পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, পরিবারে শিশুরও আপত্তি তোলার অধিকার স্বীকার করা, প্রতিটি মানুষ ও সৃষ্টির সমস্ত কিছুকে সম্মান করতে শেখা, শ্রমের গৌরবে গর্ববোধ করা, অ-শ্রমের তঞ্চকতায় লজ্জা পাওয়ার মতো গুণ আদিবাসী সমাজের অঙ্গ। দুর্ভাগ্য, এই সব সামাজিক মহিমা সম্পর্কে তথাকথিত ভারতীয় বিদ্যাচর্চা, রাজনীতি, আইনব্যবস্থা— কোথাও কোনও স্বীকৃতি নেই। এই অস্বীকার আবার শাসনতন্ত্রের নিয়মে আদিবাসী সমাজেও ঢুকে পড়ে। ক্ষমতার দাপটে আদিবাসীদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে এমন এক জীবনে, যেখানে ক্ষুন্নিবৃত্তিই মানুষের একমাত্র আরাধনা। এই আরাধনায় তাঁরা নিজেদের সহস্র বছরের মানবিক অর্জনগুলোও অনেক সময় বিস্মৃত হন, আবার বারংবার ক্ষমতাবানের উৎকর্ষের ‘নকল’ কষ্টিপাথর দেখতে দেখতে নিজেরাও কখন যেন সেটাকেই ‘আসল’ বলে ভেবে নেন। বিস্মরণের এই প্রক্রিয়া কেবল আদিবাসীই না, সমগ্র মানবসমাজের জন্য এক বিষাক্ত প্রস্রবণ।
মানতীয়, এ-সবই আপনার পরিজ্ঞাত। এবং, এ কথাও আপনার জানা যে, ক্ষমতার অলিন্দে আপনার যে স্থান, তা আণুবীক্ষণিক একটি অংশের প্রতিনিধি রূপেই। আপনি যে সমাজ থেকে এসেছেন, তার দার্শনিক মূল্যবোধগুলো আপনি জাগ্রত রাখতে চাইবেন, না কি স্বেচ্ছা-বিস্মৃত হবেন, তা শর্তাধীন। তবে, অভিজ্ঞতালব্ধ মূল্যবোধে আদিবাসীরা পাঁচটি আঙুল হাতের তালুতে মিলিয়ে যে শক্তি অর্জনের কথা বলে এসেছেন, দুই হাত জোড় করে দশ আঙুলে সবাইকে জোহার জানানোর যে সমাজদর্শনের অনুশীলন করে এসেছেন, তা প্রতিটি ভারতবাসীর কাছেই শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। আপনার কাছেও।
জোহার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy