পুজো যে আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সে আমরা জানি, কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে পুজো এখনও একটা ক্ষতি বলেই সচরাচর ভাবা হয়। পুজো এলেই ছুটি, কাজ বন্ধ, অর্থনীতির চাকাও অচল ইত্যাদি। অথচ পুজোর উৎসবে কি অর্থনীতিও নানা ভাবে লাভবান হয় না? কেবল এখনকার কথা নয়, পুরনো হিন্দুশাস্ত্রেও তো পড়ি, পুজোর ঐতিহ্য ও পরম্পরার মধ্যে অর্থনীতির বিশেষ ভূমিকার কথা। সুদীর্ঘ কাল ধরে পুজোকে কেন্দ্র করে সমাজে বিভিন্ন জাত-বর্ণ-ভিত্তিক পেশাগত মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক আদানপ্রদান চলেছে। মৃৎশিল্পী, কুমোর, ঢাকি, নাপিত, মালাকার, পটুয়া শিল্পী, তাঁতি, গোয়ালা, ময়রা, পুরোহিত প্রভৃতি বিভিন্ন বর্গের মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে পুজোয় যুক্ত থেকেছেন। বাংলার দুর্গোৎসব আড়ম্বরের দিক দিয়ে ব্রাজ়িলের রিয়ো ডি জেনেইরোর কার্নিভালের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। কার্নিভালকে ঘিরেও যেমন অর্থনীতি শক্তি ও সচলতা পায়, আমাদের পুজোকে ঘিরেও তেমনই।
শারদোৎসব এখন সর্বজনীন শারদবাণিজ্য। কলকাতা ও জেলায় প্রায় ত্রিশ হাজার দুর্গাপুজো হয়। কালীপুজোও কয়েক হাজার। কম করে এক লক্ষ থেকে কয়েক কোটি টাকা বাজেট ধার্য হয় প্রতি পুজোর জন্য। বহু মানুষের জীবিকা নির্ভর করে এর উপর। শারদোৎসব এখন নিজেই এক বিরাট শিল্প। হুগলির পাণ্ডুয়ায় মাটির প্রদীপ তৈরিতে মগ্ন থাকেন মৃৎশিল্পী। মোমবাতি, ফানুস ও বিভিন্ন বৈদ্যুতিন বাতি তৈরিতে ব্যস্ত হন কারিগর। কলকাতার মেটিয়াবুরুজে মুর্শিদাবাদ থেকে আগত মুসলিম কারিগর পুজোর ছয় মাস আগে থেকেই ব্যস্ত থাকেন জামা প্যান্ট তৈরির কাজে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার আতসবাজি ও রংমশাল শিল্পের কেন্দ্র চম্পাহাটি ও নুঙ্গি এলাকায় প্রায় আট হাজার ছোট-বড় কারখানা আছে। বহু পরিবার তুবড়ি, আতসবাজি ও রংমশাল শিল্পে যুক্ত। হাওড়া ব্রিজের কাছে মল্লিকঘাটে ফুলবিক্রেতাদের ব্যস্ততা। রানাঘাট, ধানতলা ও সন্নিহিত এলাকার ফুলচাষি অপেক্ষায় থাকেন কবে আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা হবে। নদিয়ার শান্তিপুর, ধনেখালিতে বহু রাত পর্যন্ত তাঁতের খটাখট শব্দ। মালদহ মুর্শিদাবাদের রেশমশিল্পীর রাতের ঘুমে টান। কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে মৃৎশিল্পীর সঙ্গে কাদামাটির সহাবস্থান। বাঁকুড়ার টেরাকোটা শিল্পীর অপূর্ব কারুকার্যময় প্রতিমা। জঙ্গলমহলে আদিবাসী কেন্দুপাতা থেকে থালা বাটি তৈরিতে ব্যস্ত। চন্দননগরের আলোকশিল্পের বাজার দুর্গাপুজো থেকেই শুরু। শোলার অপ্রতুলতার জন্য থার্মোকলের ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত। প্রতিমা নিরঞ্জন ও শোভাযাত্রায় সম্পৃক্ত বাজনাবাদক ও বাহকবাহিনীর আয়ও বাড়ে। পুজো উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে, বহু মানুষের দৈনন্দিন রোজগার সেই মেলার বেচাকেনার উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকির দল পুজোর আগে শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে নেমে কলকাতা ও শহরতলির বিভিন্ন পুজোমণ্ডপে হাজির হন। কলকাতার মহাত্মা গাঁধী রোডে মেছুয়াবাজারে ফলব্যবসায়ীদের ছোটাছুটি। গ্রামগঞ্জ থেকে সব্জির পসরা নিয়ে বিক্রেতাদের আনাগোনা প্রবলতর শিয়ালদহের কোলে মার্কেটে।
এই যদি সাবেকি বেচাকেনার ছবি হয়, শহরের শপিং মলে শারদবাণিজ্য কোন স্তরে পৌঁছয়, সে আমাদের জানা। কয়েক মাস আগে থেকেই পুজো ডিসকাউন্ট ঘোষণা, বিজ্ঞাপনের হুড়োহুড়ি। মোবাইলে সকলেই ব্যস্ত, সস্তায় পুজোর বাজার করতে, কেবল শহরে নয়, গ্রামেগঞ্জেও। দেশবিদেশের কোম্পানি পুজো উপলক্ষে কোটি কোটি টাকা স্পনসর করে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের বিশেষজ্ঞ দলের চাহিদা বিপুল। আর এখন বাঙালি উৎসবের বিশেষ অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে ধনতেরাস, যে উপলক্ষে শেয়ার মার্কেট বা স্টক এক্সচেঞ্জে নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক সময়ের পরেও লেনদেন চলতে থাকে। সংস্কার চালনা করে বাজার অর্থনীতিকে।
শারদোৎসবে অর্থনীতির হাল ভাল হয় না মন্দ, তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক। মাত্রাছাড়া শারদবাণিজ্যের অনৈতিকতা নিয়েও অনেক কথা। ক্রমশ বারোয়ারি পুজোর আড়ম্বর বাড়ছে, তার সমালোচনাও শুনি। তবে মনে হয়, পুজোবাণিজ্য চালু থাকলে বাংলার সর্ব স্তরের ব্যবসাবাণিজ্যের উপকার হওয়ারই কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy