Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

তৈরি হোক ইকো ব্রিক্‌স

দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত প্লাস্টিক বা পলিথিন-এর উৎপাদন এবং ব্যবহার। প্লাস্টিক বা পলিথিন যা আজ বাজার ছেয়ে রয়েছে সেগুলি সবই অভঙ্গুর। এর ব্যবহার না কমালে পৃথিবীকে আগামী বসবাস যোগ্য গড়ে তোলা যাবে না। লিখছেন শিবপ্রসাদ চৌধুরীকমবেশি আমাদের সকলেরই জানা রয়েছে যে, সারা পৃথিবী আজ দূষণের শিকার। গ্রিন হাউস এফেক্ট, শব্দ দূষণ, জল দূষণ, মাটি দূষণ প্রভৃতি বিনষ্ট করেছে পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিবেশ।

অপরিষ্কার পুকুর। ছবি:লেখক

অপরিষ্কার পুকুর। ছবি:লেখক

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৫৩
Share: Save:

একসময় গ্রাম ছিল সবুজের সমারোহ। নির্মল বিশুদ্ধ বাতাসের মুক্তাঞ্চল। তাই নির্জন পরিবেশের নির্মল বাতাস নিতে শহর থেকে বছরে একবার অন্তত সময় করে মানুষ আসতেন গ্রামের পরিবেশ উপভোগ করতে। তা সে দুর্গাপূজো হোক বা মেলা পার্বণ। কিন্তু দ্রুত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ছাপ গ্রামেও পড়ছে। গ্রামে এখন আর বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ দেখা যায় না। এখানেও সবুজ ধ্বংস হচ্ছে। গঞ্জ বাজার গড়ে উঠছে। বহুজাতিক সংস্থার উৎপন্ন দ্রব্য প্যাকেট ভর্তি হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে প্রবেশ করছে। সেই প্যাকিং-এর বেশিরভাগই হচ্ছে পলিথিনের তৈরি।

কমবেশি আমাদের সকলেরই জানা রয়েছে যে, সারা পৃথিবী আজ দূষণের শিকার। গ্রিন হাউস এফেক্ট, শব্দ দূষণ, জল দূষণ, মাটি দূষণ প্রভৃতি বিনষ্ট করেছে পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিবেশ। মানুষ-সহ সমস্ত জীবজন্তু এর ক্ষতিকারক প্রভাবে মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত। আর এই দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত প্লাস্টিক বা পলিথিন-এর উৎপাদন এবং ব্যবহার।

এই প্লাস্টিক বা পলিথিন, যা আজ বাজার ছেয়ে রয়েছে, সেগুলি সবই অভঙ্গুর। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সাগর-মহাসাগরে প্রতি বছর প্রায় আশি লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে। সমুদ্রস্রোত ওই প্লাস্টিক বর্জ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে। পৃথিবীর গভীরতম স্থান প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চেও প্লাস্টিকের ব্যাগ-এর অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। গবেষণায় জানা গিয়েছে, প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশ বা মাইক্রো প্লাস্টিক বায়ুবাহিত হয়ে বাতাসে মিশছে। বায়ু দূষণের অন্যতম ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে মাইক্রোপ্লাস্টিক যোগ হচ্ছে বিশ্বদূষণের খাতায়।

আকার অনুযায়ী প্লাস্টিককে মাইক্রো, মেসো এবং ম্যাক্রো এই তিন ধরনে ভাগ করা হয়। যে সকল প্লাস্টিক কণা ২-৫ মিলি মাইক্রন আকারের তা মাইক্রো প্লাসটিক, ৬-১৯ মিলি মাইক্রন আকারের তা মেসো প্লাসটিক আর ২০ মিলি মাইক্রন আকারের বড় প্লাসটিককে ম্যাক্রো প্লাসটিক বলা হয়। মাইক্রো প্লাস্টিক কণা সরাসরি বাতাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। বাড়ছে চর্মরোগ। থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণ ঘটছে। যা নানা রোগের কারণ। সমুদ্র-মহাসমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ায় সামুদ্রিক প্রাণির জীবন বিপন্ন হচ্ছে। সামুদ্রিক কচ্ছপ, জেলিফিশ জাতীয় প্রাণিদের খেয়ে বেঁচে থাকে। পলিথিনের ব্যাগ সমুদ্রে এমন ভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে যে ভুল করে জেলিফিশ ভেবে কচ্ছপেরা তা খেয়ে ফেলছে এবং তাদের খাদ্যনালী অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে ওরা।

একই ভাবে ভয়াবহ অবস্থার শিকার হচ্ছে বিশাল আকৃতির তিমিরা। শুধু তিমিই নয়, সামুদ্রিক মাছের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক সঞ্চিত হয়ে তা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে প্রবেশ করছে মানুষের শরীরেও। হিমালয় এবং অন্যান্য পর্বতমালাতেও একই ভাবে হাজার হাজার টন পলিথিনের বোতল, শুকনো খাবারের র‌্যাপার, কাপ, গ্লাস-এর স্তূপ জমা হচ্ছে, যা মূলত পর্যটক ও পর্বতারোহীদের দ্বারা বাহিত। এর ফলে পাহাড়-পর্বতের পরিবেশও দূষণের হাত থেকে বাঁচছে না। পয়ঃপ্রণালীগুলি পলিথিন জমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

কী এই পলিথিন বা প্লাস্টিকের উৎস? কোল গ্যাসে ৪-৫ শতাংশের মতো ইথিলিন গ্যাস থাকে। এ ছাড়া পেট্রোলিয়াম থেকেও যে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপন্ন হয় সেখানেও থাকে ইথিলিন। এই ইথিলিনকে পলিমারাইজ় করে পলিথিন নামক সাদা কঠিন পদার্থ তৈরি করা হয়। এর থেকেই তৈরি হয় গৃহস্থালীতে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য নানা জিনিসপত্র। যেমন টেবিল-চেয়ার, খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেট, বিদ্যুতের তারের কভার, ড্রাম, জলের বোতল, জলের পাইপ-সহ নানা দ্রব্য। এ ছাড়া, পাতলা ক্যারিব্যাগ তো আছেই। এগুলির বেশিরভাগই অভঙ্গুর। যেহেতু, প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ, তাই সৃষ্টির পর পুনরায় চক্রায়ণ না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশেই অবস্থান করে। সেখান থেকেই নিয়মিত ঢুকে পড়ে প্রাণীর খাদ্যচক্রে।

এ ছাড়া ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। যা ভূগর্ভস্থ জল ও ভূপৃষ্ঠের জলের সঙ্গে মিশে ভয়ঙ্কর জল দূষণ ঘটায় এবং আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। ভাবতে অবাক লাগে এই প্লাস্টিক মাটিতে মিশতে প্রায় চারশ বছর সময় লাগে। শুধু তাই নয়, মাটিতে অবস্থিত কোনও কোনও ব্যাকটেরিয়া যদি পলিথিনের বিয়োজন ঘটায়, তা মিথেন নামক যে গ্যাস উৎপন্ন করে তা এক প্রকার গ্রিনহাউস গ্যাস। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রতিবছর ১৪ মিলিয়ন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। আমেরিকায় প্রতিবছর ৩.৮ মিলিয়ন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। ইউরোপে প্রতিবছর উৎপন্ন হয় ২.৫ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য। যদিও ব্যবহৃত প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করছে বিভিন্ন দেশ। তাও বেশ কষ্টসাধ্য। পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে যে সমস্ত পদার্থ উৎপন্ন হয় তা সর্বক্ষেত্রে তা ব্যবহার যোগ্য নয়।

এই সমস্ত প্লাস্টিক দ্রব্য পাহাড়, জঙ্গল, মাটি, বায়ুকেই শুধু দূষিত করছে তা নয়, গ্রাম বাংলার প্রত্যেকটি খানাখন্দ আজ পলিথিন বর্জ্যে ভরে উঠছে। বাংলার ক্ষীর নদী, গোলদিঘি, তালপুকুর, রড়পুকুর, তাঁতপুকুরগুলিতে আজ সেই স্নিগ্ধ নীল ফটিক জল আজ জৌলুস হারাচ্ছে প্লাস্টিক দূষণের কারণে। ঘাটের ধারে ধারে প্লাস্টিক বর্জ্য ভরে উঠছে। আজ গ্রামের পুকুরে নামতে হলে ঢেউ দিয়ে প্লাস্টিক আবর্জনা সরিয়ে নামতে হয়। হঠাৎ হঠাৎ পুকুরের মাছ ভেসে ওঠে। পুকুরে দূষণের ফলে যে বায়োগ্যাস তৈরি হয়, তাতে মাছ মারা যায়। এছাড়া, মাছের বৃদ্ধিও কমে যাচ্ছে। ফলে মাছের উৎপাদনও হচ্ছে কম।

ভারত সরকার চলতি বছরের ২ অক্টোবর থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগ, কাপ, প্লেট, নানারকম স্যাশে প্রভৃতি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু সেই দিনক্ষণও সম্প্রতি পিছিয়ে দেওয়া হল। বিশ্বকে প্লাস্টিক মুক্ত করার জন্য নানা দেশ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। কিন্তু কোনও পরিকল্পনাই সফল হবে না, যতক্ষণ মানুষ না সচেতন হন। এই দূষণ কমাতে প্লস্টিকের তৈরি জিনিস এর পরিবর্তে কাগজের জিনিস, মাটির ভাঁড়, পাটের থলে বেশি বেশি ব্যবহার করা দরকার। বিয়োজিত প্লাস্টিক উৎপাদনে জোড় দিতে হবে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য থালা, গ্লাস, কাপ, প্লেট ব্যবহার করা দরকার। গৃহস্থালীতেও প্রতিদিনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে। পলিথিন থেকে ইকো ব্রিক তৈরি করতে হবে। তাতে দূষণ অনেকটাই কমতে পারে। মোটকথা সচেতন হলে আমরা নিজেরা যেমন বাঁচব। বাঁচবে ভবিষ্যতও।

লেখক ইন্দাসের সাহিত্যকর্মী

অন্য বিষয়গুলি:

Eco Brick Plastic Pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy