প্রতীকী ছবি।
হঠাৎই দেশ জুড়িয়া বাঙালি-বিদ্বেষের চোরা স্রোত বহিতেছে। কখনও ইন্টারনেটে বাঙালি মহিলাদের ডাইনি সাব্যস্ত করিবার হিড়িক পড়িতেছে, কখনও কোনও বিশিষ্ট জন টুইট করিয়া বক্রোক্তি করিতেছেন। আবার কখনও উত্তরপ্রদেশে দুর্গাপূজা নিষিদ্ধ করিবার চেষ্টা হইতেছে। ঘটনাগুলি বিচ্ছিন্ন হইতেই পারে। কিন্তু, অভিজ্ঞতা বলিতেছে, ইহা একটি সংগঠিত উদ্যোগ, এমন সংশয়ের কারণ আছে। সেই সংশয়ের প্রধানতম কারণ, বাঙালিত্বের ধারণাটি মৌলিক ভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদের পরিপন্থী। পশ্চিমবঙ্গে গৈরিক প্রভাব বাড়িয়াছে, এই বাস্তবটি অনস্বীকার্য— কিন্তু, ‘বাঙালি’ বলিতে যে চিত্রকল্পটি এখনও সর্বভারতীয় মানসপটে ফুটিয়া উঠে, তাহা এই হনুমানভক্ত বঙ্গবাসীর নহে। তাহা একটি সত্তা, যাহার শিকড় প্রোথিত নবজাগরণের আলোকে। এই বাঙালি শিক্ষিত, এবং শিক্ষার গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্যক সচেতন। বাঙালি প্রশ্ন করিতে জানে— বিনা প্রশ্নে মানিয়া লওয়া, এবং বিনা প্রতিবাদে সহিয়া যাওয়া বাঙালির চরিত্রবিরুদ্ধ। এই বাঙালি জানে, মহামানবের সাগরতীরে বহু পরিচিতির মিলনেই ভারতীয় সত্তাটি নির্মিত হইয়াছে— তাহার কোনও একশৈলিক রূপ থাকিতে পারে না। ফলে, বিবিধতাকে স্বীকার করিয়া লইতে বাঙালির সমস্যা হয় না। আন্তর্জাতিকতার বোধ, প্রগতিশীলতা এবং অতি অবশ্যই সহিষ্ণুতা বাঙালির পরিচিতি নির্মাণ করিয়াছে। আরও এক বার উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইহা কোনও এক জন বাঙালির পরিচয় নহে— ব্যক্তি বাঙালি ক্ষুদ্র, অসহিষ্ণু, শিক্ষার প্রতি উদাসীন বা ধর্মীয় মৌলবাদী হইতেই পারে, হয়ও। কিন্তু, জাতিসত্তা হিসাবে বাঙালির এই পরিচিতিটি গত দেড় দশকে অপরিবর্তিত থাকিয়াছে।
এই পরিচিতির প্রতিটি অংশের সহিত উগ্র হিন্দুত্বের বিরোধ। এমনকি, গোটা বিশ্ব যাঁহাকে হিন্দু ধর্মের সর্বোত্তম প্রবক্তা হিসাবে চিনিয়াছে, সেই স্বামী বিবেকানন্দও কোনও মতেই উগ্র হিন্দুত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা, যাঁহাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন প্রতীক, তাঁহারাও নহে। কারণটি সরল: হিন্দু ধর্ম ও হিন্দুত্ব সম্পূর্ণ পৃথক দুইটি বস্তু। অন্য দিকে, রবীন্দ্রনাথ বা বিদ্যাসাগরকে লইয়া হিন্দুত্ববাদীদের অস্বস্তি না থাকিলেই অবাক হইতে হইত— বিদ্যাসাগরের মূর্তি অহেতুক ধূলিসাৎ হয় নাই। অর্থাৎ, বাঙালির সর্বকালীন আইকনরাও অবস্থান করেন মৌলবাদী হিন্দুস্তানের ধারণার বিপ্রতীপে। কাজেই বিভিন্ন ভাবে বাঙালি সত্তাকে খাটো করিয়া, তাহাকে অপমান করিয়া বঙ্গভূমে নিজেদের অস্তিত্বের বৈধতা নির্মাণের চেষ্টা চলিতেছে না, সে বিষয়ে নিঃসংশয় হইবার কারণ নাই। ইহাই কি মডেল নহে?
এই আক্রমণগুলিকে তবুও খোলা চোখে দেখা যায়। কিন্তু, বঙ্গজীবনের প্রতীকগুলিকে আত্মসাৎ করিয়া, তাঁহাদের বিপুলতাকে কাটিয়া-ছাঁটিয়া নিজেদের ব্যবহার্য মাপে নামাইয়া আনিবার প্রবণতাটি আরও অনেক বেশি বিপজ্জনক। তাহার একটি উদাহরণ পাওয়া যাইবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি ভাষণে, যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ হইতে অগ্রপশ্চাৎহীন কয়েকটি বাক্য উদ্ধার করিয়া তাঁহাকে কার্যত ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র মুখপাত্র বানাইয়া ফেলিয়াছিলেন। আশঙ্কা, এক বারেই প্রবণতাটি থামিবে না— ২০২১-এর নির্বাচন যত নিকটবর্তী হইবে, বাঙালির কিছু প্রতীককে নিজেদের মতো করিয়া ব্যবহার করিবার প্রবণতাটিও বাড়িবে। এক দিকে বাঙালি-বিদ্বেষ, আর অন্য দিকে কিছু বঙ্গসন্তানের ছদ্ম-আরাধনা, ইহার মধ্যে বিরোধ নাই, সাযুজ্য আছে। যে প্রতীকগুলিকে কিছুতেই ভাঙা যায় না, তাঁহাদের আত্মসাৎ করিয়া, নিজেদের ছকে ঢালিয়া প্রচার করিতে পারিলেও তাঁহাদের বাঙালি সত্তা হইতে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব। ইহাও যুদ্ধজয়েরই কৌশল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy