পোস্ট বক্স। হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি পাঠানোর এই মাধ্যমও। ছবি: লেখক
সেই দিন আর নেই, যখন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল ডাকব্যবস্থা। গ্রামবাংলা থেকে শহরের আনাচে কানাচে খাকি উর্দি পরা পোস্টম্যান সাইকেল চড়ে পিঠে ব্যাগ ভর্তি চিঠিপত্র ঝুলিয়ে নির্দিষ্ট বাড়ির ঠিকানায় গিয়ে হাঁক পাড়ত- ‘‘চিঠি আছে গো।’’ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকা গৃহকর্তা তখন পত্রদাতার লেখনীর সুন্দর প্রতিফলন ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এই চিঠির মাধ্যমে জানত পারত পত্রলেখকের আবেগের অনুরণন, আনন্দের হাতছানি ও দুঃখের বিষাদগাথা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতার অংশ এবিষয়ে প্রসাঙ্গিক। তিনি লিখেছেন- ‘‘কত চিঠি লেখে লোকে, কত সুখে, প্রেমে, আবেগে স্মৃতিতে, কত দুঃখ ও শোকে।’’
কিন্তু আজকের দিনে অর্ন্তজালের ব্যাপক প্রসার ও ইমেল, মেসেঞ্জার, হোয়্যাটঅ্যাপ প্রভৃতি সোশ্যাল সাইটের সহজলভ্যতা ও জনপ্রিয়তা ‘চিঠি’ নামক যোগাযোগ ব্যবস্থা মাধ্যমের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। বর্তমান প্রজন্মের কাছে চিঠি লেখার মাধ্যমে যোগাযোগ বিষয়টি আস্তে আস্তে গুরুত্ব হারাচ্ছে। কেন না তাদের কাছ চিঠি লেখার জন্য ধৈর্য্য ও সময়ের অভাব হয়ে গিয়েছে। অনেকই আবার মনে করেন কী দরকার বর্তমান প্রযুক্তি ছেড়ে অতীতের দিকে ঝুঁকে সময় ব্যয় করা, তাছাড়াও পত্রদাতাদের মন বুঝে আজকের পোস্ট অফিসগুলি চিঠি পত্রের বিলির কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। এখন ডাকঘরগুলিতে যা চিঠি আসে তার সিংহভাগটাই দফতরিক, মানে চিঠি যা সেগুলি স্কুল কলেজ বা অফিসের কোনও দরকারি চিঠি। তাই গ্রাম থেকে শহরের আজ যতগুলি ডাকঘর আছে সেখানে চিঠি পত্রের আদান-প্রদান কাজটা ক্রমশ গৌণ হয়ে আসছে। ডাকঘরগুলি বেশিরভাগ সময় ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের অর্থ সঞ্চয়ের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে। তাই বর্তমানে গ্রামীণ ডাকঘরগুলিকে ব্যাঙ্কের ক্ষুদ্র সংস্করন বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না।
কিন্তু আমরা যদি অতীত ফিরে চাই, তাহলে দেখতে পাব আজকের মেসেঞ্জার, ইমেল ইত্যাদির অবর্তমানে এই চিঠিই ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। অতীতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের পর্যালোচনা জন্য আজও গবেষকরা পুরাতন চিঠির ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীতে কে কখন কাকে প্রথম চিঠি লিখেছে সে বিষয়ে তথ্য আজও অজানা। তবে বহু বছর আগে মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ান অঞ্চলে মানুষ ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করত। যেমন আকাশের তারা দিয়ে বোঝানো হত রাত, কিংবা তীর ও ধনুকের ছবি দিয়ে বোঝানো হত যুদ্ধের বর্ণনাকে। ছবির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশের এই মাধ্যমের নাম ছিল পিক্টোগ্রাম (pictrogram)। এই পিক্টোগ্রামকে বলা হয় চিঠির বিবর্তিত রুপ।
উপমহাদেশীয় প্রাচীন ইতিহাস অনুসারে জানা যায় পূর্বে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় সংবাদ আদান প্রদানের জন্য পাঠানো হত কাসিদ বা ডাকবাহক। তবে দূরবর্তী অঞ্চলে খবর পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হত পায়রা বা কবুতর। এরজন্য পায়রাকে রীতিমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। পায়রার পায়ে বেঁধে দেওয়া ছোট সংবাদের চিরকুট, যা পৌঁছে যেত নির্দিষ্ট গন্তব্যে। সম্রাট চেঙ্গিজ খাঁ তাঁর অধিকৃত রাজ্যগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতেন এই কবুতরের মাধ্যমে। তারপর যত দিন এগিয়েছে ডাক ব্যবস্থায় এসেছে নতুন সংযোজন। দিল্লির প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের শাসনকালে ডাক ব্যবস্থায় যুক্ত হয় ঘোড়ার ব্যবহার। পর্যটক ইবন বতুতার বিবরণী থেকে জানা যায় সেই সময়ে দুইভাবে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। এক পায়ে হেঁটে সাধারন ডাক বিলিবণ্টন ও অন্যটি হল জরুরি অবস্থায় যেমন কোনও বহিরাগতদের আক্রমণের সংবাদ অথবা যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের সংবাদ প্রেরণ করা হত ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে। শেরশাহর শাসনকালে ভারতীয় ডাক ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ঘটে। তিনি ডাক ব্যবস্থার সুবিধার্থে নির্মাণ করেছিলেন সোনারগাঁও থেকে সিন্ধু প্রদেশ পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা।
শুধুমাত্র ইতিহাসের দিকে তাকালে চিঠির গুরুত্বকে বোঝা অসম্ভব। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিঠি ছিল উল্লেখযোগ্য সম্পদ। বাংলা সাহিত্যে চিঠিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একের পর এক পত্রসাহিত্য। কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ পুরোটাই চিঠির আকারে গল্প। আবার তাঁর লেখা অন্য একটি ছোট গল্প ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে আমরা দেখতে পাই অজ পাড়া গাঁয়ের পোস্ট অফিসের সঙ্গে জড়িয়ে নানা ঘটনাচিত্র। আবার কোনও সাহিত্যিকের রচনায় উপজীব্য হয়ে উঠেছে ডাক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে প্রান্তিক মানুষগুলির জীবন-জীবিকা। এক্ষেত্রে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘ডাকহরকরা’ ছোটগল্পে আমরা খুঁজে পাই এক নিষ্ঠাবান ও দায়িত্ববান ডাকহরকরা ও তার দুশ্চরিত্র ছেলের গল্প। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতায় উঠে এসেছে এক কল্পিত রানারের রাত-দিনের সংগ্রামের চিত্র।
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে গ্রামবাংলার বুক থেকে চিরবিদায় নিয়েছে ডাকহরকরা জীবিকা। এই প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির সঙ্গে চিঠির এক বিকল্প ব্যবস্থা টেলিগ্রাফ আজ ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। গ্রাহাম বেলের টেলিফোন আসার আগে টেফিগ্রাফ বেশ রমরমিয়ে চলত। তখনকার দিনে লোকমুখে প্রায় শোনা যেত ‘টরে- টক্কা টরে’। এই টেলিগ্রাম ব্যবস্থা পুরোটাই নির্ভর করত মোস কোর্ডের ওপর। টেলিগ্রাফিস্ট যিনি হতেন। তাকে রীতিমতো মোর্স কোড নিয়ে পড়াশুনা করত হত। তখনকার বহু তরুণদের কাছে এই পেশা ছিল লোভনীয়। বহুজন এই পেশায় আসার আগ্রহ দেখাত। অল্প কথায়, দ্রুত খবর পাঠানোর জন্য ‘টেলিগ্রাম’ পরিষেবা ছিল অদ্বিতীয়। কলকাতায় ১৯১৩ সালে এখনকার ডালহৌসিতে প্রথম তৈরি হয় ‘ক্যালকাটা টেলিগ্রাফ’ অফিস। দুঃখের বিষয় এই যে দূরভাষ আসার ফলে ও বিশ্বায়নের যুগে টেলিগ্রাম পরিষেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছে গত ১৫ জুলাই, ২০১৩ সালে। কিন্তু ডিজিটালের যুগে টেলিফোনও আজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সঙ্কটে। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন এসেছে। মানুষ আজ চিঠির চেয়ে দ্রুতগতির ইমেল, মেসেঞ্জার চিঠি লিখতে বেশি অভ্যস্ত। যা কিছু চিঠিপত্রের আদান প্রদান হয় তা শুধুমাত্র ‘আকাশবাণী’র কিছু জনপ্রিয় বেতার অনুষ্ঠানের সৌজন্যে। আর আছে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানোর জন্য চিঠি লেখার নিবিড় অনুশীলন।
‘শ্রীচরণেষু’, ‘পূজনীয়’, ‘শ্রদ্ধেয়’ ‘ইতি’র মতো শব্দগুলি ব্যবহার চিরতরে হারিয়ে যাবে। কাউকে আর বলতে শোনা যাবে না ‘বাড়ি ফিরে চিঠি পাঠিও।’ গ্রামের দিকে গেলে দেখতে পাই ডাকঘরগুলি আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হচ্ছে পোস্ট পেমেন্ট ব্যাঙ্কে। চিঠির গুরুত্ব চিরতরে হারিয়ে যাবে। চিঠি থাকবে শুধু ইতিহাসের পাতায়।
লেখক বিশ্বভারতীর সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, মতামত নিজস্ব
এই বিভাগে লেখা পাঠান নীচের ইমেল-এ mail.birbhum@abp.in।
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন। অন্য কোনও পত্রিকা, পোর্টালে পাঠানো লেখা অনুগ্রহ করে পাঠাবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy