Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

আধিপত্যবাদ

এই দেশে ডাক্তার হইতে রকেট-বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের অধ্যাপক হইতে খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার— অনেকেরই আঙুলে আংটি, বাহুতে তাগা-তাবিজ, কব্জিতে লাল-হলুদ সুতা ও বুকপকেটে আশীর্বাদী ফুল থাকে।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

যাঁহারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা করেন, তাঁহাদের কি ধর্মীয় বিশ্বাস বা কুসংস্কার থাকিতে নাই? অথবা, যে ব্যক্তি হাতে জ্যোতিষীর আংটি পরেন, শুভকার্যের পূর্বে মন্দিরে পূজা দিতে ভুলেন না, অথবা বিড়ালে পথ কাটিলে গাড়ি থামাইয়া দেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে তাঁহার ব্যুৎপত্তির উপর ভরসা করা চলে না? কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হইলে ভারতে সম্ভবত অর্ধেক রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা পড়িত, আরও অনেক ব্রিজ ভাঙিয়া পড়িত, চন্দ্রযান পৃথিবীর গণ্ডি টপকাইতে পারিত না। কারণ, এই দেশে ডাক্তার হইতে রকেট-বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের অধ্যাপক হইতে খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার— অনেকেরই আঙুলে আংটি, বাহুতে তাগা-তাবিজ, কব্জিতে লাল-হলুদ সুতা ও বুকপকেটে আশীর্বাদী ফুল থাকে। বিজ্ঞানের সহিত বিজ্ঞানাতীত বিশ্বাসের বিরোধ প্রচলিত অর্থে আধুনিকতার চোখে যতখানি প্রকট, উত্তর-আধুনিকতার তত্ত্ব বলিবে, বিশেষত ভারতের ন্যায় দেশে প্রকৃত প্রস্তাবে ততখানি বিরোধ নাই। একই মানুষের ব্যক্তিপরিসরে আধুনিকতম প্রযুক্তির জ্ঞান ও ধর্মীয় বিশ্বাস বা প্রাচীনতম কুসংস্কার একই সঙ্গে অবস্থান করিতে পারে। কিন্তু, তাহা মূল প্রশ্ন নহে। প্রশ্ন উঠে, এত যুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞানচর্চার পরও কেন মনে ‘কুসংস্কারের তমসা’ থাকিয়া যায়? পুঁথিগত যুক্তিকে মন কেন জীবনদর্শনে গ্রহণ করিতে পারে না? মাসকয়েক পূর্বে ইসরোর প্রধান কে শিবন যখন চন্দ্রযান প্রক্ষেপণের পূর্বে পূজা দিয়াছিলেন, অথবা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সদ্যনির্বাচিত সভানেত্রীর হাতে যখন ধর্মীয় গ্রন্থি চোখে পড়িয়াছিল— সমালোচনা কম হয় নাই। এবং, এই গোত্রের সমালোচনার মুখে পড়িলে পূর্বে অন্যরা যাহা করিতেন, শিবন বা ঐশীও তাহাই করিয়াছিলেন— হয় উত্তর দেন নাই, নচেৎ ইতিউতি অজুহাত খাড়া করিয়াছিলেন। অনুমান, তাঁহারাও অন্তর হইতে আধুনিকতার যুক্তিটি মানেন, এবং নিজেদের আচরণের সহিত যে আধুনিকতার বিরোধ আছে, তাহা অনুভব করেন। অর্থাৎ, যাঁহাদের বিজ্ঞানাতীতে বিশ্বাস আছে এবং যাঁহাদের নাই, উভয় পক্ষই বিজ্ঞানের— আধুনিকতার— হেজিমনি বা আধিপত্য স্বীকার করিয়া লইতেন।

রাজনাথ সিংহ এইখানেই ব্যতিক্রম। তিনি রাফাল যুদ্ধবিমানের গায়ে ‘ওম’ লিখিয়াছেন, তাহার চাকার তলায় লেবু রাখিয়াছেন, বিমানটির শস্ত্রপূজা করিয়াছেন। এবং, সমালোচনা শুরু হওয়া মাত্র জানাইয়া দিয়াছেন যে তিনি বেশ করিয়াছেন। কারণ, ইহাই ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। বাবু যত বলিয়াছেন, পারিষদ দলে স্বভাবতই তাহার উপর দুই পর্দা সুর চড়াইয়া বলিয়াছেন যে যাঁহারা এই পূজার বিরোধিতা করিতেছেন, তাঁহারা ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী। ইহাই রাজনাথ সিংহদের মাহাত্ম্য— তাঁহারা একটি বিশেষ ধর্মের বিশ্বাসকে জোর গলায় গোটা দেশের সংস্কৃতি বলিয়া দাবি করিতে পারেন, যেন ভারত তাহার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি বিসর্জন দিয়া ইতিমধ্যেই ধর্মীয় জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত হইয়াছে। এবং, আরও মাহাত্ম্য এইখানে যে তাঁহাদের এমন বিচিত্র দাবিটির মধ্যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষ কোনও অন্যায়, কোনও ভ্রান্তি দেখিতে পায় না। আধুনিকতার আধিপত্যের এই পাল্টা আধিপত্য স্থাপন করিতে পারা কম কৃতিত্বের বিষয় নহে। দলের অবমাননা মানেই হিন্দু ধর্মের অবমাননা, এবং তাহা সর্বার্থে দেশের অবমাননা— দেশবিদ্বেষ, দেশদ্রোহ— এই সরলরৈখিক সমীকরণটি এক দিনে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। রাজনাথ সিংহরা নিষ্ঠাভরে সেই সমীকরণ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রকল্পটির অনুশীলন করিয়া গিয়াছেন। এখন তাহার ফল মিলিতেছে।

ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের অধিকার ব্যক্তিবিশেষের। রাষ্ট্রের সেই অধিকার থাকিতে পারে কি? ইসরোর কে শিবন যখন মন্দিরে পূজা দিতে যান, তখন তিনি যান ব্যক্তি হিসাবে। ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসাবে নহে। রাজনাথ সিংহ ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসাবে রাফাল বিমান গ্রহণ করিতে গিয়াছিলেন। সেই মুহূর্তে তাঁহার একমাত্র পরিচিতি ছিল, তিনিই ভারতীয় রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের ধর্ম নাই। ফলে, রাজনাথ সিংহ ব্যক্তিগত ভাবে শস্ত্রপূজায় বিশ্বাসী কি না, সেই প্রশ্নটিই এক্ষণে অবান্তর— ভারত নামক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিন্দুধর্মের কোনও প্রথায় বিশ্বাসী হইতে পারে না। ফলে, রাজনাথ সিংহ যাহা করিয়াছেন, তাহা ভারতের চরিত্রানুগ নহে। কিন্তু, এখানেই আধিপত্যবাদের মাহাত্ম্য। দেশবাসীর মনে আর প্রশ্নগুলি জাগে না। প্রশ্নহীন আনুগত্য অপেক্ষা শাসকের আর কী কাম্য।

অন্য বিষয়গুলি:

Rajnath Singh Rafale France
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy