Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Delhi Model

‘দিল্লি মডেল’ কিন্তু ব্যতিক্রমী

বাস্তবে কিন্তু ভোটে জেতার জন্যে এই ‘দিল্লি মডেল’ অনুকরণ করা কেবল কঠিনই নয়, এক কথায় অসম্ভব।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০৭
Share: Save:

অ্যান্টি-ইনকামবেন্সিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অরবিন্দ কেজরীবাল সরকারের পুনরায় বিপুল জয়ের চাবিকাঠিকে ‘দিল্লি মডেল’ নামই দিয়ে ফেলেছে ভারত। গত কিছু দিনের মর্মান্তিক ঘটনাবলি দিল্লির ভোটকে খানিক বিস্মরণের পথে ঠেলে দিয়েছে ঠিকই, তবে ভুললে চলবে না যে এই বাস্তবও বুঝিয়ে দেয়, বিজেপি জমানায় দিল্লির মতো জায়গায় ৫৪% ভোট আর ৯০% আসন নিয়ে পুনর্নির্বাচিত হওয়া বড় সহজ কথা নয়। তবে কি কেজরীবালের পথেই ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে যে কোনও রাজ্য সরকার? বাস্তবে কিন্তু ভোটে জেতার জন্যে এই ‘দিল্লি মডেল’ অনুকরণ করা কেবল কঠিনই নয়, এক কথায় অসম্ভব।

প্রথমত, দিল্লির আপ-সরকারের পরিচালন পদ্ধতি ছিল যেন জনগণকে বিনি পয়সায় ভোজ খাওয়ানো, সঙ্গে জনকল্যাণের এক মজাদার মিশেল। আপ-সরকার বিনি পয়সায় দিয়েছে অনেকখানি বিদ্যুৎ আর জল, ফ্রি করে দিয়েছে মহিলাদের বাসে চলাফেরা। দিল্লি সরকারের এই প্রকল্পগুলি অনেকটা বহুচর্চিত ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ বা ইউবিআই গোছের। এর সুবিধা দেওয়া হয়েছে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে, সবাইকে। ভোটের বাজারে এর মস্ত সুবিধে। সচ্ছল জনতাও নিজেদের সুবিধা-প্রাপ্ত ভাববে। দিল্লিতে বিদ্যুৎ, জল, চিকিৎসা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রায় সকলেরই সংসার খরচের কমবেশি এক-চতুর্থাংশ সাশ্রয় করে দিয়েছে আপ-সরকার। ইভিএম-এ তার প্রভাব পড়েছে।

এক সময় জাতীয় পর্যায়ে মোদীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যগ্র হয়েছিলেন কেজরীবাল। এ বারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন মোদীর উল্লেখও। জাতীয় ইসু থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে, দিল্লির ভোটকে তিনি আঞ্চলিকতার চৌহদ্দিতেই আটকে রাখতে চেয়েছেন। ৩৭০ ধারা কিংবা রামমন্দির নিয়ে বিজেপির বিরোধিতা করেননি। সিএএ-কে জাতীয় বিষয় বলে তার থেকে দূরে থেকেছেন। এবং বিস্ময়কর ভাবে, পেরেছেনও। হনুমান চালিশা নিয়ে পালে হাওয়া টেনেছেন। কিন্তু দিল্লির ১৩% মুসলিম ভোটের জন্যে ঝাঁপানোর কোনও মরিয়া প্রচেষ্টা আপাত ভাবে তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি— যা হলে হিন্দু ভোট বিজেপির খাতায় একীভূত হতে পারত। দিল্লি পুলিশের উপর রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ না থাকাটাও তাঁর পক্ষে শাপে বর হয়েছে। জেএনইউ, জামিয়া, শাহিন বাগ, এমনকি সাম্প্রতিক দাঙ্গার মতো ইসুতেও নিজে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পেরেছেন। অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধে নেই। রাজ্যভেদে তাই বিধানসভার লড়াইগুলোর রং বদলাবে অনেকটাই।

বিধানসভার ভোটে দিল্লিতে লড়াই হয়েছে দ্বিমুখী। কয়েক মাস আগের লোকসভা ভোটে রাজ্যে কংগ্রেসের ২২% ভোটের সিংহভাগই যে আপের খাতায় গিয়েছে, সে তো একেবারে পরিষ্কার। অ-বিজেপি ভোটের প্রায় পুরোটাই জড়ো হয়েছে আপ-এর অ্যাকাউন্টে। সেটা কিন্তু সব রাজ্যে ঘটবে না। যেমন পশ্চিমবঙ্গেই তো কংগ্রেস কিংবা বামেদের ভোট তৃণমূলেও গিয়েছে, বিজেপিতেও। দিল্লির অঙ্ক তাই স্বতন্ত্র। ব্যতিক্রমী তার প্যাটার্ন। দিল্লির বেশ কিছু ভোটার যে লোকসভা এবং বিধানসভার ভোটে বিজেপি এবং আপকে পালাক্রমে ভোট দিয়েছেন ২০১৪ থেকে, তাও নিশ্চিত। অনেক রাজ্যেই সার্বিক ভাবে এমন হওয়া কঠিন।

আপ-এর এই দিল্লি জয়ে তাই অন্য রাজ্যগুলির, সে বিজেপি-শাসিত হোক বা অ-বিজেপি, সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। জনমোহিনী প্রকল্পের জন্যে নির্বাচকদের প্রত্যাশা বাড়বে। ঝকঝকে সরকারি স্কুল, মহল্লা ক্লিনিক, বিনি পয়সার বাস, বেশ খানিকটা জল, বিদ্যুৎ— এ সব করে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। দিল্লি বেশ ধনী রাজ্য। ২০১৭-১৮’র হিসেবে দিল্লির রাজস্ব ঘাটতি ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। দিল্লির মাথাপিছু আয় ভারতের গড়ের তিন গুণ। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের গরিবদের জন্যে নির্দিষ্ট প্রকল্পগুলি দিল্লিবাসীদের মধ্যে তেমন প্রভাব বিস্তার না করাটাই স্বাভাবিক। যেমন, উজ্জ্বলা প্রকল্পের সুবিধাভোগীর অনুপাত বাকি ভারতের তুলনায় এ রাজ্যে নগণ্য। পুলিশ যেমন রাজ্যের অধীনে নয়, পুলিশের পিছনে খরচও নেই দিল্লির। রাজ্যটার প্রায় পুরোটাই শহর-কেন্দ্রিক। গ্রামীণ দিল্লি বলতে বাস্তবে প্রায় কিছুই নেই। অন্যান্য রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রে খরচ থাকবে অনেকটা। তাদের টানাটানির সংসারে একেবারেই সহজ নয় ছোট্ট, ধনী এবং একান্তই শহুরে রাজ্য দিল্লির পথ অনুসরণ।

পশ্চিমবঙ্গের বাজেটে এর মধ্যেই এসেছে ‘হাসির আলো’ প্রকল্প। তিন মাসে ৭৫ ইউনিটের কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের নিখরচায় বিদ্যুৎ দেওয়ার প্রস্তাব। দিল্লির মতো সার্বিক নয়। শুধু দরিদ্রদের জন্য। দিল্লির সঙ্গে একটা তুলনা কিন্তু চলে আসবেই। বিশাল রাজ্যের বিপুল জনতার কাছে দেশের ধনী রাজধানী শহরের সমান সুযোগ পৌঁছে দেওয়া যে সম্ভব নয়, রাজনৈতিক ভাবে সেটা সকলকে বোঝানো শক্ত। তাই দিল্লির লাড্ডু খাওয়ার চেষ্টা করলে পস্তানোর সম্ভাবনা থাকবে। না খেলেও অবশ্য থাকবে।

রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট। মতামত ব্যক্তিগত

অন্য বিষয়গুলি:

Arvind Kejriwal AAP Delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE