পরিবারের আর্থিক অবস্থা এমন নয় যে, অনায়াসে বাড়ির শিশু পড়ুয়াদের খরচসাপেক্ষ বেসরকারি ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের জন্য পাঠানো যায়। পরিবারের অধিকাংশেরই কোনও সম্পর্কও নেই পড়াশোনার জগতের সঙ্গে। বাংলা হরফে লেখা বাক্য সাবলীল ভাবে পড়তেই পরিবারের সিংহ ভাগ সদস্যকে রীতিমতো হোঁচট খেতে হয়। তা হলে কীসের মোহে, কোন কারণে ক্ষমতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গিয়েও বাচ্চাদের খরচসাপেক্ষ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠানো?
বাড়িতে এই শিশুদের পড়াশোনা দেখানোর মতো কেউ নেই। অজ গ্রামে আলাদা করে টিউশন নেওয়ার ব্যবস্থা করার উপায়ও নেই। গ্রামেরই কিছু বেকার ছেলেমেয়ের কাছে এই সব শিশুদের কেউ কেউ টিউশন নিতে যায়, যাঁরা নিজেরাও বাংলা মাধ্যম পাঠ্যক্রমে পাশ করা। ফলে, রোজ জৌলুসপূর্ণ রঙিন স্কুলবাস থেকে নামলেও আসলে এই শিশুদের শিক্ষার দফারফাই ঘটে চলেছে! কিছু দিন বাদেই এরা হাইস্কুলের শিক্ষা নিতে আবার বাংলা মাধ্যমেই ফেরে। কারণ, বেসরকারি স্কুলের পড়াশোনার খরচ চালাতে শেষ পর্যন্ত গরিব পরিবারগুলো নাকানিচোবানিই খায়। বাড়িতে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের পড়াশোনায় সাহায্য করার মতো কেউ নেই বলে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে পড়তে বাচ্চাগুলো পড়াশোনার প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণটাও হারিয়ে ফেলে।
এই বাবা-মায়েরা মনে করেন, সরকারি ইস্কুলে ঠিকঠাক পড়াশোনা হয় না, কেননা সরকারি স্কুলে মিড-ডে মিল খাওয়ার ঝামেলা মেটাতে মেটাতেই সময় চলে যায়। তা ছাড়া নির্মল বিদ্যালয় কর্মসূচি, মনীষীদের জন্মদিন, মৃত্যুদিন পালন করা তো আছেই। তাই তাঁরা তাঁদের সন্তানকে ‘ভাল’ স্কুলে পাঠাতে চান, যেখানে সরকারি এইসব নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই।
যাদের জন্য মিড-ডে মিল প্রকল্প, তারাই বঞ্চিত হচ্ছে এই কারণেই। অথচ, এরা কেউই কিন্তু সম্পন্ন পরিবারের সদস্য নয়। আসলে, সমস্যাটা বেশ গভীরে। অভিভাবকেরা যে কারণ দেখিয়ে সন্তানকে মোটা বেতনের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করছেন, সেটা তাঁদের বিশ্বাস করা অন্যতম কারণ বটে, কিন্তু মূল কারণ নয়। আসলে, বোধ হয় তাঁরা খানিকটা বুঝে আর খানিকটা না বুঝে চটকদারিতে মজে উঠতে চাইছেন। হোক না ভাঙা ঘরদোর, কিন্তু তাঁরাও চান, তাঁদের ছেলেমেয়ে সম্পন্ন ঘরের ছেলেপুলের মতো ঝকঝকে পোশাক পরে, পিঠে স্কুলব্যাগ, গলায় ওয়াটার বটল ঝুলিয়ে স্কুলবাসে করে যাক। এই বিপুল খরচ তাঁদের স্বল্প আয়ে সামলান কী ভাবে তাঁরা, কে জানে! কিন্তু তাঁরা যখন তাঁদের ছেলেমেয়েদের গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পাঠান, তখন কিন্তু একটা ভাল খাতা কিংবা পেন-পেনসিলটুকুও দিতে পারেন না। ইংরেজি মাধ্যম বা বেসরকারি বাংলা মাধ্যমে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা গ্রামের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে এলে খাতা, কলম আনতে ভুলে যায়। যে ছাত্র আগের দিনই গলায় টাই ঝুলিয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে গিয়েছিল, সে-ই যখন গ্রামের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে আসছে, তখন তার পরনের জীর্ণ-মলিন জামায় সব বোতামও থাকে না।
তা হলে একে কী বলা যায়? সঙ্গতিহীনতা নাকি হীনম্মন্যতা? চটকদারির রংবাহারে যত অর্থব্যয় হয়, তার সিকি ভাগও যদি তাঁরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুকে পাঠিয়ে ব্যয় করতেন, তা হলে অর্থের অপচয়ও হত না, সন্তানের শিক্ষাটুকুও হত।
শিক্ষা আনে সচেতনতা। এঁরা সচেতন হয়ে ওঠার সুযোগ পাননি। তাই ভালমন্দ বিচার না করে শহুরে ঠাঁটবাটকেই ভাল শিক্ষা মনে করে তার অনুকরণ করতে চাইছেন। ফলে, সরকারের তরফে মিড-ডে মিল, স্কুল ইউনিফর্ম, জুতো, ব্যাগ, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি দিয়ে যতই আকর্ষণীয় প্যাকেজ তৈরি করে দেশের বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত পোক্ত করতে চাওয়া হোক না কেন, তার সাফল্যের আশা কমে আসছে। অার্থিক দিক থেকে দৈন্যের পাশাপাশি মানসিক দীনতাও গ্রামসমাজে শিকড় সেঁধিয়ে দিচ্ছে। তাকে ঠেকানোর জন্য নতুন করে ভাবতে হবে শিক্ষাবিদদের, সমাজতাত্ত্বিকদের। (শেষ)
(লেখক দক্ষিণ দিনাজপুরের মহাদেববাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy