উৎসবের আধিক্যই দুর্গাপুজোকে আর দশটা পুজোর থেকে পৃথক করে। কিন্তু সেই উৎসব কখনও পুজোর রীতিনীতিকে তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারের রূপ নিতে পারে না। তাই বিসর্জনের আগে করাত দিয়ে প্রতিমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছেদন করা যেমন বিসদৃশ, বিসর্জনের পরে প্রতিমার প্যারেডও খানিকটা তাই।
কথাটা বলার কারণ, প্রত্যেকটা পাড়ার পুজোর মন্ত্র আলাদা না হলেও, আলাদা রসায়ন রয়েছে। শিবকৃষ্ণ দাঁ কিংবা দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাড়িতে দেবীর অঙ্গে হিরের জড়োয়া পরানো হত, গঙ্গায় বিসর্জনের আগে, তা খুলেও রাখা হত। আবার এমন পুজোর কথাও জানি যেখানে মা দুর্গাকে পরাবার ভাল শাড়ি কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে, জনৈক উদ্যোক্তার মেয়ে তাঁর এক মাস পর বিয়ের জন্য কেনা বেনারসি এগিয়ে দিয়েছিল, আর তা গায়ে দিয়েই বিসর্জনে গিয়েছিলেন মা। এ কেবল, ‘যেখানে যেমন, সেখানে তেমন’-এর উদাহরণ নয়, নয় শুধু, ‘যখন যেমন, তখন তেমন’-এর গল্প। আর একটি কথাও বলেছিলেন, সারদা মা, ‘যাকে যেমন, তাকে তেমন’। বারোয়ারি দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রে ওই শেষ কথাটা সবচেয়ে লাগসই বলে মনে হয়। উত্তর কলকাতার কোনও শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া প্রাচীন পুজোর সঙ্গে একই মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না, দক্ষিণ শহরতলির উদ্বাস্তুদের শুরু করা তুলনায় কমবয়সি কোনও পুজোকে।
কিন্তু সংবাদপত্রে যখন পড়ি, “পুজোর আগের দিন থেকে বাজার-হাট, পুজোর জায়গায় চালগুঁড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া— সবই নিজের হাতে করত মেয়ে। বাবা বুক ভরে শ্বাস নিতেন”, তখন মনে হয় এই বাবা তো যে-কোনও বাবা হতে পারেন। ইঞ্জিনিয়ার, রিকশাচালক কিংবা সেলাই-করে মেয়েকে বড় করে তোলা বাবা। মা বলেন, “...বাড়ির পুজোয় কত রকমের খুঁটিনাটি থাকে। ভুলত না কিছু। স্নান সেরে নিজেই সাজাত। কী সুন্দর করে আলপনা দিত।” সেই মেয়েটি, যে দারিদ্রের সঙ্গে অত লড়াই করে বড় হয়েও, পুজোর চার দিন কোনও ছুটি নিতে চায়নি কখনও? যে অনেক লোককে অষ্টমী-নবমীতে নিজের বাড়িতে ‘পুজোর ভোগ’ খেতে ডাকত, কারণ প্রসাদ কখনও কম পড়ে না? নিজের অজানতেই আজ সে সারা বাংলার মেয়ে হয়ে গেছে। হয়তো বা প্রতিমাও। যে প্রতিমাকে মণ্ডপে নয়, দর্পণে দর্শন করতে হয়।
সে বাড়িতে পুজো করতেন যে পুরোহিত তিনি এ বার অন্য কোথাও পুজো করেছেন? যে ঢাকি ঢাক বাজাতেন তিনি কি অন্যত্র বাজিয়েছেন? পেট বড় বালাই, দরিদ্র মানুষকে বিকল্প খুঁজে নিতেই হয়। কিন্তু পেট শুধু বালাইও নয়। মা যশোদা, বালক কৃষ্ণের পেট, নিজের কেশবন্ধনী দিয়ে বাঁধতে ব্যর্থ হয়েছিলেন কারণ পৃথিবীতে আসার আগে প্রাণ, পেটের ভিতরেই থাকে। আর প্রাণকে কখনও বাঁধা যায় না। শরীর ছেড়ে গেলেও, প্রাণ ফিরে আসে বলেই, প্রতিবাদ প্রকৃতির রূপ নেয়। রক্ত থেকে জন্মায়, রক্তপলাশ।
লাশের বিপ্রতীপে পলাশ, চলমান কোনও গণ-আন্দোলনকে এ ভাবেও কি দেখা যায় না? প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্নও আসতে পারে। আসছেও। কেন বর্ধমানের আদিবাসী মেয়েটি বা কৃষ্ণনগরের মেয়েটির ক্ষেত্রে হচ্ছে না এ রকম আন্দোলন? কেন কামদুনি কাণ্ডের অপরাধীদের খালাস পাওয়া নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে না তত? কেন সিকি শতাব্দী আগে, হাসপাতাল চত্বরেই খুন হয়ে যাওয়া নবীন ডাক্তারের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে যারা চালিয়ে দিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ প্রতিবাদী নায়ক হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ আসছে? কেন তাপসী মালিকের হত্যাকে ব্যঙ্গ করে নাটকের সিডি বাজারে এসেছিল? কেন বিচার পাননি অনিতা দেওয়ান, বর্ণালী দত্ত, সৌমিত্র বিশ্বাস, সুশীল পালরা? কেন এ বার ধর্না মঞ্চের চার ধারে দামি খাবারের প্যাকেট দেখা গেল?
শেষ সেই খাবারে এসেই গল্প পাক খাবে, কারণ অন্নচিন্তা চমৎকারা। আর সেই ভাতের চালের পয়সা বাঁচিয়ে একটা কাজই করে মানুষ, চিকিৎসা করায়। ঘটিবাটি বিক্রি করেও চিকিৎসা করায়। মৃত্যুর পর সৎকারের অধিকার আর বেঁচে থাকতে চিকিৎসার অধিকার, প্রতিটি নাগরিককে দিতে প্রত্যেকটি প্রশাসন অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু আদৌ কি সেই অধিকার আছে আমাদের? এই প্রতিবেদকের মাতৃবিয়োগ ঘটেছে, খানিকটা কুচিকিৎসাতেই, মাস ছয়েক আগে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল, মরণাপন্ন মাকে এক বড় হাসপাতালে ভর্তি করাতে। করাতে পারেনি কারণ তাকে বলা হয়েছিল যে সে রকম কারও রেফারেন্স না থাকলে ওই হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা প্রায় অসম্ভব। সে রেফারেন্স জোগাড় করতে পারেনি, মারা গেছে তার মা। উল্টো উদাহরণও অবশ্যই আছে, এখনই চার জন বলতে পারেন যে, তাঁরা গিয়েই জায়গা পেয়ে গেছেন পছন্দসই সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু যাঁদের রাত্রি প্রভাত হয়নি, কী ভাবে সূর্যোদয়ের বর্ণনা দেবেন তাঁরা?
পাশাপাশি এই কথাটাও সত্য যে, পনেরো বছর আগে হলে এই প্রতিবেদকের মতো অনেকেই সরকারি হাসপাতালে মা-বাবা কিংবা পরিবারের কাউকে ভর্তি করানোর কথা ভাবতে দ্বিধান্বিত বোধ করত। শম্ভুনাথ পণ্ডিত কিংবা বাঙুর সুপার-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এখন অনেক বেশি সুন্দর, পরিষ্কার। ইতিউতি কুকুর-বেড়াল ঘুরে বেড়ায় না। তাই তো আরও বেশি করে সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা চায়। পেতে দেয় না, কারা? কোন সিস্টেম? সেই সিস্টেমই কি অঙ্গ পাচার চক্রে মদত দেয়? বর্জ্য পদার্থ নিয়ে ব্যবসা করে? ‘এক্সপায়ারি ডেট’ পেরিয়ে যাওয়া ওষুধ চালিয়ে দিয়ে ডাক্তারদের ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দারে পরিণত করে? আর বাঁচতে যারা পারত তারা মরে যায় টপ-টপ করে?
নানা প্রশ্ন ভিড় করে আসতে পারে, যেমন সরকারি হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান হয়েও কেউ পাঁচটি নার্সিং হোমের সঙ্গে যুক্ত কী ভাবে। কিন্তু কোনও প্রশ্নই আন্দোলনের আগুনকে নেবাতে পারে না কারণ, ‘আমরা বাঁচতে চাই’-এর চেয়ে বড় মন্ত্রের উৎপত্তি হয়নি এখনও। নিজের কেউ হাসপাতালে ভর্তি থাকলে, কী ওষুধ তার ভিতরে যাচ্ছে, কোন ইনজেকশন শরীরে যাচ্ছে রোগীর, ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হবে না কে? প্রতিবাদীদের মধ্যে কে মেধাবী, কে ততটা নয়, কে পয়সা দিয়ে প্রাইভেট কলেজে আর কে বিনা পয়সায় সরকারিতে, সেই প্রশ্ন গৌণ।
বিসর্জনের পরেও শোভাযাত্রায় মা দুর্গার অংশগ্রহণ— শুনলাম অনেক বেশি বিদেশি মানুষ দেখেছেন এ বার। আগামী দিনে যদি ইউরোপ, লাতিন আমেরিকায়, দুর্গাপুজো শুরু হয় তবে প্রতিমাশিল্পী থেকে পুরোহিত সবার কপালই খুলতে পারে। শিল্প যখন নিরঞ্জনে, নিরঞ্জন থেকে শিল্প হলে আপত্তি কী?
তবে একখান কথা আছে, সম্রাট নেপোলিয়নের। কথাটা এই যে, স্বার্থ এবং ভয় মানুষকে একত্র করবেই। বাঁচার এবং আত্মজনকে বাঁচিয়ে রাখার চাইতে বড় স্বার্থ হয় না। নিজের এবং আত্মজনের মৃত্যুভয়ের চেয়ে বড় ভয়ও নেই। তাই যমদুয়ারে লোহার কাঁটা বিছোনোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে যাঁরা অনশন করছেন তাঁদের সঙ্গে মানুষ একাত্মতা বোধ করবেই।
ছোবলের ভিতরেও জীবন যে জন্মাষ্টমী, ওই একাত্মতাই তার প্রমাণ দিচ্ছে, এই বিজয়ায়। কোন ব্যারিকেড, কোন কারাগার আটকাবে তাকে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy