—প্রতীকী চিত্র।
অতিমারির ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলি ঘটছে, তার কিছু দিক নিয়ে প্রথম পর্বে লিখেছি (‘বদলে যাচ্ছে শিক্ষার দুনিয়া’, ১৫-১২)। আরও দু’একটি বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। প্রথমত, আমরা লক্ষ করেছি, বিগত কয়েক বছরে, কন্যাশ্রী ও আরও নানা স্কলারশিপ সহজলভ্য হওয়ায়, সাধারণ কলেজের শ্রেণিকক্ষের জনবিন্যাস দ্রুত বদলে যাচ্ছে। অনার্স কোর্সে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি করে সংখ্যালঘু পরিবারের ছাত্রীরা এসে উপস্থিত হচ্ছে এবং ভাল ফল করে উত্তীর্ণ হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও এরা পাস কোর্সে থাকত, অনার্সে ভর্তি হত না। তার কারণ যতটা আর্থিক, ততটাই পারিবারিক অনুশাসন— উচ্চতর শিক্ষায় যাওয়ার অনীহা, বৃহত্তর কর্মজগতে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি। লকডাউন যখন বাড়িতে বসে অনলাইন শিক্ষা বা ওয়ার্ক ফ্রম হোমের দিগন্ত খুলে দিয়েছে, তখন স্টুডেন্ট কমিউনিটির এই অংশটির সে দিকে ঝোঁকার সম্ভাবনা ষোলো আনা।
সুতরাং সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে মাঝারি মাপের ও মধ্যমানের কলেজগুলির ছাত্রসংখ্যা কমাবে, এমনকি প্রতিষ্ঠানগুলির বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইউজিসি-র পরিকাঠামো উন্নয়নের গ্রান্ট আজ প্রায় দশ বছর বন্ধ। রুসা গ্রান্ট কিছু আশার সঞ্চার করেছিল, তার পরে আর নতুন কোনও কেন্দ্রীয় স্কিম আসেনি। আগের যুগে রাজারা পণ্ডিত, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের পোষণ করতেন, কারণ মেধার স্ফুরণে যত্ন লাগে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যদি পাথেয় জোগাড়ের জন্য বাজারে অর্থসম্পদ উৎপাদনে মনোযোগী হতে হয়, তা দেশের দশের জন্য কল্যাণকর হয় না। আবার নিউ নর্মাল বাস্তবে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য যদি অগণিত প্রতিষ্ঠানের তৈরি পরিকাঠামো ধ্বংস হয়, তাতেও দেশের অপরিমিত ক্ষতি। এখনই চাই এক সার্বিক অ্যাকশন প্ল্যান ও তার সতর্ক রূপায়ণ জরুরি।
দ্বিতীয়ত, লক্ষ করলাম, লকডাউন সামাজিক বৈষম্যের রূপটি আগাপাছতলা বদল করে দিল। এত কাল উন্নয়ন ও বৈষম্য বিষয়ে আমরা কিছু পুরনো ধারণা পোষণ করে এসেছি, যেমন, গ্রাম-শহর বৈষম্য, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বৈষম্য। এখন এই সব সরে গিয়ে সামনে এসেছে ডিজিটাল ডিভাইড। এর দুটো কারণ: এক, আন্তর্জাল সংযোগের মাসিক ভাড়া দেওয়ার বা স্মার্টফোন জাতীয় যন্ত্র কেনার সামর্থ্য না থাকা, এবং দুই, এলাকায় ভাল আন্তর্জাল পরিকাঠামোর অভাব। এমন পরিস্থিতির পূর্বাভাস ছিলই, ধীর পায়ে সমাজ ওই দিকে অগ্রসর হচ্ছিলই। কিন্তু লকডাউন পরের প্রজন্মের অভিজ্ঞতাকে এই প্রজন্মে তরান্বিত করে এনেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বলি, আন্তর্জাল পরিকাঠামো যদি সরকার নিজে করে, তা হলে এক কথা। অতিমারির ফলে মানুষের সামর্থ্য এখন ক্ষতিগ্রস্ত, অথচ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য ভাল আন্তর্জাল সংযোগ ভীষণ দরকার। ঠিক এই মুহূর্তে বেসরকারি কোম্পানিগুলি বিনিয়োগ বা অন্যান্য অজুহাতে সংযোগের মাসুল বাড়িয়েই চলেছে। জানি, বাজারের নীতিতে চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে। কিন্তু যেখানে ছাত্রদের শিক্ষার মতো সংবেদনশীল বিষয় জড়িয়ে আছে, সেখানে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের পদক্ষেপ মানুষ আশা করেন। আমার মনে হয়, ব্যাঙ্কে যেমন স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ আছে, আন্তর্জাল পরিষেবাতেও ভর্তুকিযুক্ত স্টুডেন্ট সংযোগের বন্দোবস্ত প্রয়োজন।
সম্প্রতি রাজ্য সরকার উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সাড়ে ন’লক্ষ শিক্ষার্থীকে ট্যাবলেট প্রদান করবে বলেছে। অনেকেই বলতে পারেন, এই কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রীর সকলেই সমান অসহায় নয়। অনেকেরই স্মার্টফোন আছে। কিন্তু সমাজের অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী মানুষ কোনও প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হলে প্রকল্পটি ঠিক দিশায় চলছে কি না, সে বিষয়ে সামাজিক পাহারার সুযোগ বাড়ে। প্রকল্পের সার্বিক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে, গরিব মানুষ নিজেকে অনুগ্রহভাজন ভেবে ক্ষুণ্ণ হন না। এই ফর্মুলাতেই ‘সবুজ সাথী’ সাইকেল প্রকল্প এত সফল হয়েছে। এখন যদি সরকার ট্যাবলেট বিতরণের এই ‘শিক্ষাসাথী’ প্রকল্পটিকে করোনা-পরবর্তী কালেও চালু রাখে, তবে শিক্ষার্থীদের সার্বিক মঙ্গল। অদক্ষ শ্রমিকের কাজের পরিসর কমছে। কিন্তু দক্ষ হতে গেলে যে শিক্ষা দরকার, তা দামি থেকে আরও দামি হয়ে ওঠার প্রবণতা খুবই প্রকট। অফলাইন-অনলাইন মিশ্রণ যখন অনিবার্য, তখন সরকার ভার নিলে তার চেয়ে ভাল আর কিছুই হতে পারে না।
তৃতীয়ত, অতিমারির জন্য ইচ্ছামতো যাতায়াতের, মেলামেশার স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। শিক্ষক ছাত্র উভয় পক্ষই কেউ পরিবারের নিকটজনকে হারিয়েছেন, কেউ হারানোর আশঙ্কা করছেন। কেউ কোভিড-পরবর্তী জটিলতার সঙ্গে শরীরে মনে যুঝছেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের পরিবেশটা কর্পোরেট অফিসের মতো ফর্মাল নয়, আবেগনির্ভর, ইনফর্মাল। লকডাউনের আঘাত এই পরিবেশের গভীরে প্রবেশ করেছে। আমার বেশ কিছু স্টুডেন্ট জানিয়েছে তারা পড়া ছেড়ে দেবে। সব কারণ আর্থিক নয়। অনেকের আত্মবিশ্বাস তলানিতে, বেশ কিছু স্টুডেন্ট হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একেবারে চুপচাপ। ক্লাসেও কথা বলে না। শিক্ষকেরা নিজেদের মতো চেষ্টা করছেন বোঝাতে। শরীর মন তাঁদেরও তো ভাল নেই।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রের লড়াই চলছে সামনে। শিক্ষাক্ষেত্রের লড়াই চলছে আড়ালে। আসুন, যে যার নিজের মতো করে প্রস্তুত হই।
ভূগোল বিভাগ, প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy