জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে যাহা ছিল অনুরোধ, তাহাই পরিণত হইয়াছে আদেশে। কেন্দ্রীয় সরকারের আরোগ্য সেতু অ্যাপটির ব্যবহার অতঃপর আর নাগরিকের ইচ্ছাসাপেক্ষ নহে। করোনার কন্টেনমেন্ট জ়োন বা নিয়ন্ত্রণী এলাকার মানুষের তো বটেই, সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কর্মীদেরও এই অ্যাপ ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কেন? বলা হইতেছে, এই অ্যাপ দ্বারা ব্লুটুথ ও কৃত্রিম মেধার মতো প্রযুক্তি সহায়তায় যে কেহ বুঝিতে পারিবেন, তাঁহার আশেপাশে কোথাও কোনও কোভিড-আক্রান্ত ব্যক্তি আছেন কি না। জানিলে সুবিধা, তিনি নিজে সতর্ক হইবেন, প্রশাসনও তৎপর হইয়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে সত্বর হাসপাতালে পাঠাইবে, রোগ চিহ্নিতকরণ ও নিরাময় ত্বরান্বিত হইবে। কিন্তু ইহাই কি সব? করোনা-আবহে যেখানে চিকিৎসাকর্মীদের পর্যন্ত আবাসনে ও পাড়ায় একঘরে হইবার দশা, অ্যাপে প্রতিবেশী সাধারণ মানুষটিকে কোভিড-আক্রান্ত দেখাইলে সেখানে কী পরিমাণ ত্রাস ও সামাজিক বহিষ্কারের প্রবণতা ছড়াইয়া পড়িবে, সহজেই অনুমেয়। এই অ্যাপ কি প্রকারান্তরে নাগরিকের নিরাপত্তা লঙ্ঘন করিতেছে না? ইতিমধ্যে সাইবার-নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এক এথিক্যাল হ্যাকার কেন্দ্রীয় সরকারকে জানাইয়াছেন, এই অ্যাপে বিস্তর গন্ডগোল। তাঁহার মতে, এখনও পর্যন্ত যে নয় কোটি ভারতীয় এই অ্যাপ চালু করিতে গিয়া ঝুড়ি ঝুড়ি তথ্য দিয়াছেন, সেই তথ্যও আদৌ সুরক্ষিত নহে। সরকার তো বটেই, প্রযুক্তি-পারঙ্গম যে কেহ উহার অপব্যবহার করিতে পারে। এবং, অপব্যবহার যে হইবে, সেই আশঙ্কা প্রবল।
দেখিয়া-শুনিয়া মনে হইতেছে, আরোগ্য সেতু যেন এক দ্বিতীয় আধার-কাণ্ড। আধারের ক্ষেত্রেও সরকার তৎপরতার ছলে এমনই কড়াকড়ি শুরু করিয়াছিল। নিরাপত্তা সুরক্ষা গোপনীয়তা সংক্রান্ত কোনও ওজর-আপত্তিই টিকে নাই, নাগরিকমাত্রেই সরকারের নিকট সম্মতির টিকিটি বাঁধা রাখিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। অ্যাপ দ্বারা কোভিডের ন্যায় ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্তকে চিহ্নিত করা যাইবে ভাল কথা, কিন্তু তাহাতে কেন নাগরিককে যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হইবে? কেন সরকার ইহার ব্যবহার অতিমারিসম দ্রুততায় বাধ্যতামূলক করিবে? ভারত স্মার্টফোনের বৃহত্তম বাজার, কিন্তু এই ভারতেও কোটি কোটি মানুষের স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা কিনিবার সঙ্গতি নাই। তাহা হইলে কি ইহাই বুঝিতে হইবে, পেটে ভাত না থাকুক, অ্যাপ হেতু দরিদ্র মানুষকে স্মার্টফোন কিনিতেই হইবে? এক দিকে ডিজিটাল বিভাজন তৈরি, অন্য দিকে দরিদ্রকে ঘাড় ধরিয়া কথা শুনিতে বাধ্য করা, সরকারের এই দুই কাজই দুর্ভাগ্যজনক। শুনা যাইতেছে, বাজারে আসা নূতন স্মার্টফোনগুলিতে এই অ্যাপ পূর্ব হইতেই থাকিবে, তাহাকে মুছিয়া ফেলা যাইবে না। অ্যাপ নিমিত্তমাত্র, সরকার আসলে গোপনীয়তার মতো নাগরিকের স্বীকৃত অধিকারটি লঙ্ঘন ও হরণ করিয়া নাগরিককে সর্বদা সর্বত্র চোখে চোখে রাখিতে চাহিতেছে, মনে করিলে খুব ভুল হইবে কি?
নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নূতন নহে। কখনও আধার লইয়া হেনস্থা, কখনও সমাজমাধ্যমে ওত পাতা— অভিযোগ কম উঠে নাই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভুগিতে হইয়াছে সাধারণ নাগরিককে। এখন আরোগ্য সেতু লইয়া কাণ্ডকারখানা দেখিয়া মনে হইতেছে, এই সরকারের আসলে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য লইয়া মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ আছে, মনস্তত্ত্বের পরিভাষায় যাহাকে ‘অবসেশন’ বলা হয়। নাগরিক কোথায় যাইল, কী করিল, কী বলিল— এই সমস্ত না দেখিলে বা জানিলে তাহার ঘুম হয় না। মানুষের ক্ষেত্রে হইলে মনোবিজ্ঞানী বলিতেন, ইহা অসুস্থতা, অবিলম্বে ইহার চিকিৎসা প্রয়োজন। কোভিড-১৯’ও এক দিন সারিবে, কিন্তু এই সরকারের অসুখ দুশ্চিকিৎস্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy