ডোন্ট ওরি, গেট রিচ— ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া শাহরুখ খানের ইয়েস বস ছবির শুরুতেই দেখা গিয়েছিল এই স্লোগান। তার কয়েক বছর আগে মনমোহন সিংহের হাত ধরে দেশে এসেছে আর্থিক সংস্কার। ওই স্লোগান ছিল যেন সেই সংস্কারের সুবাদে জন্ম নেওয়া নব্য মধ্যবিত্তেরই মনের কথা।
ওই আর্থিক সংস্কারের সৌজন্যেই আবার কার্যত দেউলিয়া হতে চলা অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংহ। কয়েক সপ্তাহ আগে প্রয়াত হওয়া প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের প্রয়াণের পর বহু আলোচনা হয়েছে তাঁর আর্থিক উদারীকরণ এবং দেশের অর্থনীতিতে তাঁর প্রভাব নিয়ে। এখনও হচ্ছে।
তবে মনমোহনের এই উদারীকরণ যে কেবল অর্থনীতিই নয়, দেশের চিন্তা-চেতনা-রুচিকেও অনেকটা উদার করেছিল, তা বোঝা যায় দেশের বিনোদন কেন্দ্র, বলিউডে সমান্তরাল ভাবে বেড়ে ওঠা নায়ক শাহরুখ খানের উত্থানের দিকে নজর করলে। বিশেষত, গত কয়েক বছরে ভারতবর্ষে রাষ্ট্র যে ভাবে বলিউডের মাধ্যমে গণরুচিকে নির্মাণ বা প্রভাবিত করতে চেয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে এই নজর করাটা প্রয়োজনও বটে।
অর্থনীতিকে যদি ‘বেস’ অর্থাৎ ভিত্তি ধরি, আর বলিউড, তথা বিনোদন সেই ভিত্তির উপরে গড়ে ওঠা ‘সুপারস্ট্রাকচার’ হয়, তা হলে ‘নায়ক’ শাহরুখ খান মনমোহনের অর্থনীতি থেকে উদ্ভুত বললে অত্যুক্তি হবে না মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওয়ের অর্থমন্ত্রী হিসেবে যখন মনমোহন দেশে আর্থিক উদারীকরণ নিয়ে আসছেন, তার পরই বলিউডে অভিষেক হচ্ছে শাহরুখের। মনমোহনের উদারীকরণের ফল যখন দেশে ফলতে শুরু করেছে, সেই আবহেই নির্মিত হচ্ছেন ‘নায়ক’ শাহরুখ খান।
জনতাই তো নির্মাণ করে নায়ককে। শাহরুখকে নির্মাণ করল কোন জনতা? যে নব্য মধ্যবিত্ত মনমোহনের অর্থনীতির সরাসরি সুবিধাভোগী। যে নব্য মধ্যবিত্ত নব্বইয়ের দশকে স্বপ্ন দেখছে বাড়ি, গাড়ি, বিদেশযাত্রার। তার আগের দশকটা ছিল মূলত শ্রমজীবী শ্রেণির নায়কের। যার প্রতিভূ ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। কিন্তু শাহরুখের উত্থান সেখানে ভদ্রলোক মধ্যবিত্তের নায়ক হিসেবে। ‘রাজু’র আকাঙ্ক্ষা তখন ‘ভদ্রলোক’ হওয়ার।
যে ছবিগুলির সিঁড়ি বেয়ে শাহরুখের তারকা হওয়া, তার প্রতিটিতেই রয়েছে এই নব্য ভদ্রলোকের ছাপ, যে নব্য ভদ্রলোক মনমোহনের অর্থনীতিরই ফসল। কারণ সেই অর্থনীতিই তো দেশকে শিখিয়েছিল স্বপ্ন দেখতে। ইয়েস বস-এর শুরুতে যেমন তাই ধনী হওয়ার স্পৃহার কথা রয়েছে, তেমনই গানের কথায় রয়েছে আকাশ থেকে চাঁদ তারা পেড়ে আনার স্বপ্ন, বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ‘খোয়াব’-এর কথা। উদারীকরণের কথা ঘোষণা করে ১৯৯১ সালের ২৪ জুলাই বাজেট বক্তৃতায় এই স্বপ্নের কথাই তো বলেন মনমোহন। বলেন, “সারা বিশ্ব উচ্চকিত ও স্পষ্ট ভাবে শুনুক, ভারত এখন পুরোপুরি জাগ্রত। আমরা থাকব। আমরা করব জয়।”
মনমোহনের এই বার্তার মধ্যে জাতীয়তাবাদ ছিল, যা ফুটে উঠেছিল শাহরুখের ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্থানিতেও। কিন্তু এখন জাতীয়তাবাদ বলে যা বোঝানোর চেষ্টা হয়, তার থেকে সেই জাতীয়তাবাদ ছিল ভিন্ন। অর্থনীতির উদারীকরণ তখন প্রভাব ফেলেছিল চিন্তা, চেতনা, যাপনেও। তাই দেশের বিভাজক উপাদানগুলিকে অনেকটা ঢেকে দিতে পেরেছিল সেই উদারবাদ। শাহরুখ খান ধর্মে মুসলিম হলেও জনতা তাঁর ধর্মীয় পরিচিতিকে কখনও আমল দেয়নি। তিনি আসমুদ্রহিমাচলের কাছে কখনও হয়ে উঠেছেন ‘রাজ’, কখনও ‘রাহুল’। শাহরুখ একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কখনও জনতার আচরণে তাঁর মনে হয়নি যে তাঁর শিল্পীসত্তার থেকে ধর্মীয় সত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই উদারবাদের পিছনে উদার অর্থনীতিরও বড় ভূমিকা ছিল।
ভারতে রাজনৈতিক ক্ষমতার বাস্তুতন্ত্রের বাইরেও জনগণ-মনোজগতে একটা অন্য ক্ষমতা ছিল বলিউডের। বলিউডের উদার জীবনযাত্রা, শৈল্পিক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতার মাধ্যমে সেই ক্ষমতার প্রকাশ ঘটত। কোটি কোটি দেশবাসী তাতে প্রভাবিতও হতেন। মনমোহনের আর্থিক সংস্কার বলিউডের সেই ক্ষমতাকে যেমন জোরদার করেছিল, তেমন উদারবাদ, সহনশীলতাও বাড়িয়েছিল। রাষ্ট্রের পছন্দসই বিষয় না হলেই বয়কটের ফতোয়া, শিল্পীর ব্যক্তিগত পরিচয় টেনে আক্রমণ— এমন কাণ্ডকারখানার সঙ্গে পরিচিত ছিল না দেশ।
সেই উদারীকরণের পরে তিন দশক কেটেছে। অর্থনীতি বদলেছে, বদলেছে সমাজ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন দেশে ধনীরা ক্রমশ আরও ধনী হচ্ছেন। গরিবেরাও আরও গরিব হচ্ছেন। এমন চলতে থাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয়তন ক্রমশ সঙ্কুচিত হবে। সঙ্কুচিত হবে উদারবাদও। কারণ যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এই নব্য মধ্যবিত্তের জন্ম দিয়েছিল, উদারবাদও তারই ফসল।
হালের বলিউডেও তার ছাপ দেখতে পাচ্ছি। সংখ্যাগুরুর ধর্মের নায়কদের নিয়ে একের পর এক ছবি। ইতিহাসের নামে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বলিউডের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক মতবাদ ছড়ানোর চেষ্টা।
আর যে উদারবাদ এক মুসলিমকে তাঁর ধর্মপরিচিতি সরিয়ে দেশের সেরা নায়ক করেছিল? সেই উদারবাদও মনমোহনের মতোই আজ ইতিহাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy