নিজস্ব চিত্র
দেশের ভিতর ভ্রমণের পাসপোর্ট এখন কোভিড না-হওয়ার ছাড়পত্র। কারণ কোভিড ফিরছে। বোধহয় যতটা ভাবা গিয়েছিল, তার থেকেও একটু বেশি খারাপ ভাবেই। এখনও পর্যন্ত কোভিডের নতুন আক্রমণ যে ক’টি রাজ্যে বাড়ছে তার মধ্যে মহারাষ্ট্র, কেরল, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং কর্নাটকই আপাতত চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। কোভিডের কারণে নতুন মৃত্যুর ৮০ শতাংশই এই পাঁচটি রাজ্যে। পরীক্ষার পর ১০ শতাংশের ক্ষেত্রেই কোভিড ধরা পড়ছে। এই রাজ্যগুলি থেকে যাঁরা অন্য রাজ্যে যাচ্ছেন তাঁদের তাই কোভিড যে নেই তার ছাড়পত্র নিয়েই যেতে হচ্ছে।
ভোটের দামামায় এই চাপ থেকে পশ্চিমবঙ্গও যে ছাড় পাবে তার কিন্তু কোনও গ্যারান্টি নেই। যে ভাবে মাস্ক ছাড়া এই রাজ্যে সবাই ভোট উৎসবে মেতে উঠেছেন, তাতে উপরের তালিকায় এ রাজ্যও হয়ত খুব শীঘ্রই নাম লেখাতে চলেছে। বাঁচোয়া একটাই। মাসের শুরুতেই যদি বেসরকারি হাসপাতালেও পয়সা দিয়ে টিকা পাওয়া যায়, তাহলে হয়ত অতিমারির ছোবল আর তত বিষাক্ত থাকবে না। কিন্তু স্কুল খুলেছে। বাইরের রাজ্যের একাধিক স্কুল থেকেই ছাত্রদের আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে, যা খুব একটা স্বস্তির কারণ নয়। এ রাজ্যেও খুলেছে। এবং যে ভাবে একটা দু’টো করে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা গত কয়েক দিন ধরে বাড়ছে তাতে দুশ্চিন্তার কারণ আছে বইকি।
আর এই দুশ্চিন্তায় বাজারও ভুগছে। এই অস্থিরতার ছাপ কিন্তু ফুটে উঠেছে সরকারি ঋণপত্রের বাজারেও। ঋণের বাজারে সুদই হল ঝুঁকির মাপকাঠি। যে ঋণে বাজার মনে করবে ঝুঁকি বেশি সেই ঋণের জন্য জন্য যে ব্যক্তি বা সংস্থা ঋণ নিচ্ছে তাকে বেশি সুদ দিতে হবে। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার করা সাম্প্রতিকতম সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে সরকারি ঋণপত্র এবং সব থেকে ঝুঁকি কম বলে শংসিত সংস্থার ঋণপত্রেও সুদের হার চড়ছে। তার মানে খুব সোজা। দেশের বাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি বাড়ছে বলেই মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।
আর এটাই হল চিন্তার।গত বছরের মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির স্বাস্থ্যনীতি এবং বাজার পরিচালনার দক্ষতার উপর প্রশ্নচিহ্ন পড়ে গিয়েছে। না। একক নীতি বা বিশেষ কোনও রাজ্যের বা কেন্দ্রের বিশেষ কোনও নীতির উপযোগিতা নিয়ে বাজারের আস্থা পরিচালিত হয় না। সামগ্রিক বোধটাই এখানে আসল। এবং ঋণপত্রের বাজারে সুদের ঊর্ধ্বগতিকেই বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সংশয়ের সূচক হিসাবে ধরা হচ্ছে।
এই বাজারে আগে বিক্রি করে পরে কেনা যায়। ব্যাপারটা এই রকম, আপনি এক সপ্তাহ বাদে একটা ঋণপত্র আপনি বিশেষ দরে বিক্রি করার ইচ্ছা প্রকাশ করে রাখলেন। কী ভাবে তারপর ঋণপত্রটি আপনার হাতে আসবে সেটা অন্য প্রশ্ন। বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু এই লেনদেন বলছে যে বাজার মনে করছে দেশের অর্থনীতিতে নিকট ভবিষ্যতে বিনিয়োগের ঝুঁকি বাড়বে, আর তাই সুদও চড়ছে ধারের বাজারে।
একই সঙ্গে উল্টোদিকে ব্যাঙ্কে টাকা ফেলে রাখার প্রবণতাও যেমন ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন আর্থিক ধাপের মানুষের মধ্যে ঠিক তেমন ভাবে সাধারণ মানুষের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা তাল মিলিয়ে বাড়ছে না।তবুও চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে কিছুটা আশার আলো দেখা গিয়েছিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস ৫ ফেব্রুয়ারি ত্রৈমাসিক ঋণনীতি প্রকাশ করে আশার কথাই বলেছিলেন। কিন্তু তারই সঙ্গে একটা সংশয়ও প্রকাশ করেছিলেন বিশ্ব বাজারে পেট্রোপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে।
আজ যে ভাবে বাজারে পেট্রোল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ছে তাতে এই সংশয় কিন্তু সত্যি হয়ে উঠেছে। কোভিডের সময় বিতর্ক ঘন হয়ে উঠেছিল বাজারের চাহিদা কী ভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে। অনেকেই তখন নাগরিকের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। কর্মহীনতা বাড়ছিল। মানুষের হাতে টাকা না থাকায়, বাজারে খরচ করতে ভয় পাচ্ছিলেন সবাই। তাই নিত্য প্রয়োজনের বাইরে খরচের খাতায় অন্যকোনও পণ্যের নাম তোলায় দ্বিধা ছিল। ২০২০-২১-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে ব্যাঙ্কে টাকা রাখার প্রবণতা বেড়েছিল এবং ঋণ নিতে একই ভাবে মানুষ নারাজ ছিলেন। এর কারণ ছিল একটাই। ভয়। ধার নিলে কী করে শোধ করবেন সেই ভয়। কিন্তু ধার নিয়ে খরচ না করলেও তো বাজার ঘুরে দাঁড়াবে না।
গত ডিসেম্বর থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। কিন্তু আবার এই কোভিডের আক্রমণ সব অঙ্ক গুলিয়ে দিতে পারে। পেট্রোল, ডিজেল এবং রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ার অভিঘাত এবার পড়তে শুরু করেছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর। দুধের দাম বাড়বে, বাড়বে সব্জির দামও। মানুষ সিঁদুরে মেঘেই ভয় পেতে শুরু করেছে। আবার যদি বাজার বন্ধ হয়! সাধারণ মানুষ অত খোঁজ না রাখলেও ঋণপত্রের বাজার জানে যে সরকারি কোষাগারে নগদ কমছে। কেন্দ্রীয় কোষাগারে নগদের জোগান ৩ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা থেকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি তা কমে দাঁড়িয়েছিল ২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকায়। তাই কর কমার সম্ভাবনা কম। রাজ্য সরকারগুলির কোষাগারও তথৈবচ। আর সেটা বিনিয়োগকারীরা জানেন বলেই বাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকির অঙ্ককেও তাঁরা বাড়িয়েই দেখছেন। কারণ তো একটাই। তাঁদের সংশয় অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ যদি গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তা আবার সামলানোর দক্ষতা কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির আদৌ আছে কিনা, তা নিয়েই।এই ভয় এবং আর্থিক চাপ বাড়ছে সাধারণ মানুষের উপরও। এবং এতে আবার সেই গত বছরের মতোই চাহিদা তলানিতে চলে যেতে পারে যা চাগিয়ে তোলার ক্ষমতা সরকারি কোষাগারের খুব একটা নেই।
প্রথম ঢেউয়ে ‘টেস্ট, টেস্ট আরও টেস্ট’ ছিল বাঁচার উপায়। দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে এবং বাজারের আস্থা ফেরাতে কিন্তু এখন একমাত্র পথ টিকা এবং আরও টিকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy