বিরোধী নেতা রাহুল গাঁধী কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের পদত্যাগ দাবি করিয়াছেন। কেন্দ্রীয় সরকার দাবিটি গুরুত্ব দিয়া ভাবিয়া দেখিতে পারে। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একাধিক সারহীন মন্তব্য করিয়া সীতারামন সরকারকে ক্রমাগত বিপন্ন করিতেছেন। যেমন, তিনি যে-ই বলিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্থান এরোনটিকস লিমিটেড (হ্যাল)-এর রাফাল যুদ্ধবিমান নির্মাণের কোনও ক্ষমতাই ছিল না, পর দিনই হ্যাল-এর সদ্যপ্রাক্তন প্রধান টি সুবর্ণ রাজু জানাইয়া দিলেন, প্রশ্নাতীত ভাবে হ্যাল-এর সেই ক্ষমতা ছিল। তর্কের খাতিরে যদি-বা ধরিয়া লওয়া হয় যে সুবর্ণ রাজু কোম্পানির প্রতি স্নেহবশত একটু বেশিই দাবি করিতেছেন, তবু কিছু গুরুতর প্রশ্ন থাকিয়া যায়। তথ্য হিসাবে জানা আছে, প্রথমত, রাফাল নির্মাণকারী সংস্থা দাসল্ট-এর সহিত হ্যাল অনেক কাল ধরিয়া কাজ করিয়াছে, এবং দ্বিতীয়ত, ইউপিএ(২) সরকারের আমলে দাসল্টের সহিত রাফাল বিমান বিষয়ে হ্যাল-এর সহযোগিতার কথা বেশ কিছু দূর অগ্রসর হইয়াছিল। অর্থাৎ ২০১২ সালে রাফাল চুক্তিটি পূর্বতন সরকার যে ভাবে সাধন করিবার কথা ভাবিয়াছিল, তাহাতে হ্যাল-এর সাক্ষাৎ ভূমিকা ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসিয়া বিজেপি সরকার যদি চুক্তি হইতে হ্যালকে সম্পূর্ণ বাদ দেয়, তবে প্রক্রিয়াটির মধ্যে কিছু স্বচ্ছতা আশা করা স্বাভাবিক নয় কি? একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিকে কোন সুবাদে পূর্বালোচিত চুক্তি হইতে বাদ দেওয়া হইল, তাহা সংসদে জ্ঞাপিত হইবার কথা নয় কি? প্রশ্নটি তীক্ষ্ণতর হইয়া ওঠে এই জন্যই যে, অন্য কোনও দিকে না তাকাইয়া অনিল অম্বানীর সংস্থাকে রাফাল-এর বরাতটি দিবার সিদ্ধান্ত হইয়াছে, যে সংস্থার এ বিষয়ে পূর্ব-অভিজ্ঞতার কথা কেহই অবহিত নহেন। সুতরাং প্রতিরক্ষামন্ত্রী যদি তাঁহার মন্তব্যের সমর্থনে যথেষ্ট যুক্তি ও প্রমাণ না দিতে পারেন, তাহা হইলে এই একটি ঘটনাই বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে রাফাল-দুর্নীতির অভিযোগকে দৃঢ় ভূমিতে প্রোথিত করিতে পারে।
কেবল নির্মলাই নহেন। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও এ বিষয়ে বিজেপি সরকারের মুখরক্ষা করিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ। যত কঠিন ভাষাতেই তিনি রাহুল গাঁধীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করুন না কেন, তাঁহার ক্রুদ্ধ মন্তব্যে বা আপাত-বিশদ সাক্ষাৎকারে এখনও অবধি মৌলিক প্রশ্নগুলিরই উত্তর মিলে নাই, বরঞ্চ প্রশ্নগুলি যে ভাবে হউক কাটাইয়া যাইবার ত্বরাটি ধরা পড়িয়াছে। জেটলি বলিয়াছেন, উল্টাপাল্টা অভিযোগ দিয়া প্রতিরক্ষা-ক্রয়ের মতো গুরুতর বিষয় লইয়া ছেলেখেলা হইতেছে। কিন্তু অভিযোগগুলি যে ‘উল্টাপাল্টা’, তাহা তিনি যুক্তি দিয়া বুঝাইবার চেষ্টাই করেন নাই মোটে। যেমন, প্রাথমিক চুক্তিতে ১২৬টি বিমান কিনিবার কথা থাকিলেও হঠাৎ কেন ৩৬টি বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হইল, সরকারের তরফে তাহা জানানো দেশের প্রতিরক্ষার কারণেই জরুরি ছিল, কেননা আগের প্রশাসনে দেশের নিরাপত্তার জন্য জরুরি নূতন যুদ্ধবিমানের ন্যূনতম সংখ্যাটিই ছিল অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, কেনই বা দাসল্টের মতো বিচক্ষণ কোম্পানি ভারতের এমন একটি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতায় রাজি হইল, যাহার এই ক্ষেত্রটিতে কোনও ‘ট্র্যাক-রেকর্ড’ নাই। তৃতীয়ত, বিমান-প্রতি দাম কেন হঠাৎ এতখানি বাড়িয়া গেল, যেখানে ২০১৫ সালের এপ্রিলেও কিন্তু পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী অগ্রসর হওয়ার কথাই বলা হইয়াছিল। এমন আরও কিছু বিষয়ে স্বচ্ছ উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী, কিংবা বস্ত্রমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, কেহই প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘স্বচ্ছ’ প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবেন না। রাহুল গাঁধীর উদ্দেশে কটুকথার বাণ তাঁহারা ছুড়িতেই পারেন। কিন্তু সেই বাণে রাফাল-মেঘ ছিন্ন হইবে না। বরং সচেতন নাগরিকমাত্রেই বিস্ময়ে ভ্রু কুঞ্চিত করিবেন: প্রতিরক্ষার মতো গুরুতর বিষয়ে এত অতলস্পর্শী অস্বচ্ছতা কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy