Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

দাসত্ব শৃঙ্খলে কে বাঁচতে চায়

তিব্বতিরা চিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন, কিন্তু বিদেশে পাঠানুমোদন পান না। সম্প্রতি তিব্বত বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপান, কোরিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে এসেছেন তিনশো জন।

লাসার পাটোলা মনাস্ট্রি

লাসার পাটোলা মনাস্ট্রি

শুভশ্রী নন্দী
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৪
Share: Save:

শুধু তিব্বতের ভিসা পাওয়া দুষ্কর। যদি চিন ঘুরে পরিক্রমার ল্যাজের দিকটায় স্বায়ত্তশাসিত ‘তিব্বত’ রাখতে চান, তা হলে সম্ভব। তবে, বর্তমান দলাই লামার ‘বই’ বা ‘ছবি’ যেন সঙ্গে না থাকে। চৈনিক রক্তচক্ষুর প্রতাপে নোবেলজয়ীকে বয়কট করেছে তাঁরই জন্মভূমি। লাসার পাটোলা মনাস্ট্রি-তে ঢুকতেই, বিষয়টি স্পষ্টতর। বাকি তেরো জন দলাই লামার ঠিকুজি-ঠিকানা, স্বর্ণলেপিত তাম্রমূর্তি সাড়ম্বরে বিরাজিত। চতুর্দশ দলাই লামার ছিটেফোঁটা উল্লেখও নেই। অথচ তিনি ভারতের ধরমশালায় যাওয়ার আগে এখানেই ছিলেন। এ ভাবেই বোধ হয় ‘ন্যায্য’-কে গিলে ফেলে, ‘কাস্টমাইজ়ড ইতিহাস’ তৈরি করে সত্যের অপলাপ ঘটায় ‘স্বৈরতন্ত্র’।

অকথ্য অত্যাচারেও ধর্মের উপর রাষ্ট্রতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেননি দলাই লামা। অরুণাচল প্রদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। চিনা সরকারের বিরুদ্ধে কখনও তাঁকে অশিষ্ট মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। কিন্তু, জন্মভূমির দরজা তাঁর জন্য চিরতরে ‘রুদ্ধকপাট’, হয়তো গণঅভ্যুত্থানের ভয়ে। তাঁর খবর-বক্তৃতা তিব্বতে সম্প্রচারে অনেক বাধানিষেধ। এ বছরই তাঁর ভারতবাসের ৩৯ বছর। পাটোলা মনাস্ট্রির মাত্র ২০টি ঘর উন্মুক্ত। তার অনেকটায় চিনা ফৌজ। পাটোলাময় দেবদেবীর মতো মাও জে দং প্রমুখ চিনা রাষ্ট্রনায়কদের ছবি। মনাস্ট্রি, যানবাহন, তিব্বতি রেস্তরাঁ— সর্বত্র সংলাপ ও আচরণ ক্যামেরাবদ্ধ। আমরা তাই চিনা সরকারকে সাঙ্কেতিক ভাষায় বলছিলাম, ‘লাল বাহাদুর’। চৈনিক রেস্তরাঁয় কিন্তু ক্যামেরা দেখলাম না। অর্থাৎ, স্বায়ত্তশাসন নামেই। তিব্বতে তিব্বতিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আমরা ভারতীয় জেনে তাঁরা মাথা ঝোঁকাচ্ছিলেন। কিন্তু, ‘দলাই লামাকে ভালবাসি’ বলাতে, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপেও উঠছিলেন। সর্বসাকুল্যে চল্লিশ লক্ষ তিব্বতি এই পরাধীনতাতেই অভ্যস্ত। তাঁদের কপালে যে বন্দুক ঠেকানো।

তবু অনড় বিশ্বাসে প্রকাশ্য জনপথে ‘প্রার্থনা চক্র’ ঘুরিয়ে অহিংস এই জাতি বিড়বিড় উচ্চারণ করছে ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম’। একখণ্ড সময় পেলেই চলছে ‘জপমালা’। নির্বাক প্রতিবাদে তাঁরা ‘সংস্কৃতি’কে বুকে আঁকড়ে আছেন। তরুণ প্রজন্মই বেশি সংস্কৃতিমুখী। তিব্বত উন্নয়নে, সংস্কৃতির পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উন্মুখ। যেখানেই সংস্কৃতির অস্তিত্বের সঙ্কট সেখানেই যে সংস্কৃতি বেশি আদৃত।

তাঁদের ধর্মের আফিমে ডুবিয়ে রাখাতেই লাল বাহাদুরের সোয়াস্তি। তাই তাঁদের প্রকৃতির দখল নিয়ে, কর শুষে, চিনা অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ভূমিপুত্রদের সংখ্যালঘু করার ষড়যন্ত্র করে, বিশ্বের সঙ্গে যোগ ছিন্ন করে, ক্যামেরা বসিয়ে; এত প্রতিকূলতা ও উচ্চতায় কী ভাবে এই জাতি এমন সহিষ্ণু ও সংগ্রামী— তার নজির নিতে রক্ত পরীক্ষা চলছে তিব্বতিদের! যাতে গবেষণার ফসলটি চিনা সেনাদের উপর প্রয়োগ করা যায়! এ ভাবেই ‘অমর্যাদা’ চলছে উদয়াস্ত, নির্লজ্জ।

চলেছে সংগ্রামও। সপ্তম শতাব্দীতেই তেত্রিশতম রাজা সংস্টান গাম্পো বিজ্ঞাপন, পোস্টারে মান্দারিন ও ইংরেজি নয়, তিব্বতি ভাষার অগ্রাধিকার ছিনিয়ে নেন। তাই সর্ব স্তরে সাইনবোর্ডে প্রথমে তিব্বতি জাজ্বল্যমান। মনাস্ট্রিগুলি পুঁথির খনি। মিউজ়িয়ামে পুঁথির পাতায় উজ্জ্বল তৎকালীন বাংলা ভাষা। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। হিউয়েন ৎসাং অনেক পুঁথিসম্পদ এনেছিলেন চিনে। আবার অতীশ দীপঙ্কর পুঁথির পাঠোদ্ধারেই নালন্দা থেকে এসেছিলেন এখানে। তিব্বতিরা ‘অতীশা’-র (স্থানীয় ভাষায়) মূর্তির সামনে করজোড়ে বলছিলেন, দক্ষিণের জ্ঞানের দুয়ার খুলেছিলেন তিনিই। বাঙালি হিসেবে পুলকে ছাতি ক’ইঞ্চি বেড়ে যাচ্ছিল। এই শাক্য মনাস্ট্রিতে পুঁথি প্রায় ১৬,৭৩৭টি! বইগুলোর এক ফুট দূরত্বে বুকসমান কাঠের বেড়া, তার পর মাথা পর্যন্ত কাচের দেওয়াল। লামাদের সে বেড়া ডিঙানো বারণ। তাঁরাই সোনা, রুপো ও ভেষজ কালিতে লেখা এই পুঁথিতে জল ছিটিয়ে আর্দ্রতা রক্ষা করে লালন করছেন! তবু নেই পাঠোদ্ধারের অধিকার। চিনাদের অনুমোদন পেলে, এক ফুট দূরত্বে রেখে পড়া যাবে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় এ রকম অনেক মঠ ধ্বংস অথবা অস্ত্রাগার হয়ে যায়। আবারও একটা যুগের ইতিহাস নিশ্চিহ্ন হয়। শাক্য মনাস্ট্রিতে দেখলাম ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’। বৌদ্ধিক জ্ঞানের দশটি স্তরের সর্বোচ্চে এই সূত্র। আট বছরের শিশুর আঙুলের মাপের হরফ। বইটি কুড়ি মিটার দীর্ঘ। আট জন লাগে তুলতে আর চার জন লাগে পাতা ওল্টাতে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজগ্রন্থাগারে ‘চর্যাপদ’ আবিষ্কার করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন। কে জানে, বাংলার এমন অমূল্য কিছু ইতিহাস এখানে বন্দি কি না! এ দিকে সংস্কৃতচর্চা এখনই বিলীনপ্রায়। আরও কুড়ি বছর বাদে পুঁথি উদ্ধার হলে, তার অর্থোদ্ধারের শৈলী বিহনে ‘হিং টিং ছট’ ছাড়া কিছু প্রতিভাত হবে না। তাই গবেষণার পথ খুলতে ভারতের উদ্যোগ জরুরি। চিনা সরকারের সম্মতি গ্রহণে চাপ সৃষ্টিও প্রয়োজন।

তিব্বতিরা চিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন, কিন্তু বিদেশে পাঠানুমোদন পান না। সম্প্রতি তিব্বত বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপান, কোরিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে এসেছেন তিনশো জন। অথচ মাত্র কুড়ি জন তিব্বতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্মাধ্যক্ষ গবেষণার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছেন! ‘এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট প্রোগ্রাম’-এ তিব্বতি দুষ্প্রাপ্য। আটলান্টার এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়োলজি বিভাগে যে তিব্বতিদের দেখি, তাঁরা সব ধরমশালার কলেজের।

চোমোলুংমা (এভারেস্টের স্থানীয় নাম)-র বেস ক্যাম্প, পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৌদ্ধ মঠ— স্বায়ত্তশাসিত তিব্বতে কত আন্তর্জাতিক পীঠস্থান! অথচ সেখানেও পতপত করে উড়ছে উদ্ধত চৈনিক পতাকা। তিব্বতীয় চিহ্নমাত্র নেই। শুধু প্রার্থনা পতাকাগুলো উড়ছে বাতাসে। অবিচারের বিরুদ্ধে নীরব প্রার্থনা নিয়ে? উত্তর জানা নেই। কারণ, দেশ-স্থান-কাল নির্বিশেষে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।

অন্য বিষয়গুলি:

Tibet Dalai Lama China Monastery Lhasa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy