কলেজে ভর্তির নামে অরাজকতা। পশ্চিমবঙ্গ কোন পথে?
একটা দারুণ বই হাতে এসে ঠেকলো রোববারের লাইব্রেরিতে। পাড়ায় দেশবন্ধুচিত্তরঞ্জনমেমোরিয়াল লাইব্রেরি। বইটার নাম দ্য ইন্ডিয়া উই লেফট! চার্লস ত্রেভেলিয়ান ১৮২৬-৬৫ এবং হামফ্রে ট্রেভেলিয়ান ১৯২৯-৪৭।
লিখেছেন কে?হামফ্রে ট্রেভেলিয়ান! ব্রিটিশ যুগে এই ত্রেভেলিয়ন পরিবার ভারতে আসেন দেশ শাসনের কাজে। লেখক হলেন সিনিয়র ত্রেভেলিয়নের নাতি! সিনিয়র ত্রেভেলিয়ন বিয়ে করেন কাকে? বিয়ে করেন হান্নাহ ম্যাকলে-কে। এই হান্নাহ কে জানেন? সেই ম্যাকলে সাহেবের বোন, যিনিআমাদের ভারতে প্রথম ইংরেজি শেখালেন। ম্যাকলে সাহেবের দুই বোনছিলেন। আর এক বোন ছিলেন লন্ডনে।তিনিচিঠি লিখে সে বিয়ের কথা বোনকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বড়বোন মার্গারেট ক্রোপেরের কাছে সে চিঠি যখন পৌঁছল তারকিছুদিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।নাতি ট্রেভেলিয়ন এই বইটিতে সেই সময়ের ভারতবর্ষ, কলকাতা-দিল্লি-চেন্নাই—তাঁর নানা পোস্টিংয়ের অভিজ্ঞতা লিখেছেন। সেই সময়কার ব্রিটিশ সমাজের ছবি, তাদের বিয়ে, তাদের দৈনন্দিন জীবনের কথা লিখেছেন। আবার কী ভাবে ব্রিটিশরা ভারতের শিক্ষা ও প্রশাসনে সংস্কার এনেছে তা-ও লিখেছেন।
বইটা পড়তে গিয়ে বুঝতে পারছি, ম্যাকলে তাঁর বোনের স্বামীকেযে খুব সানন্দে মেনেনিয়েছিলেন তা নয়, কিন্তু ম্যাকলের শিক্ষা নিয়ে ভারতের কাজকর্ম সম্পর্কে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল ।নাতির বইটিতে এইসব আছে।
কলকাতা অধ্যায় থেকে বিশদে জানা যাচ্ছে, ম্যাকলে কী ভাবে ইংরেজি শিক্ষা চালু করতে লড়াই করেছিলেন!তিনি লিখেছিলেন, সরকার যে এত টাকা পাঠাচ্ছে তাকি শুধু আরবি আর সংস্কৃত শেখার জন্য? পলেমি-র জ্যোতির্বিজ্ঞান, গেলেন-এর চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে হবে নাকি ভারতীয়রা শুধু পুরাণ, বেদ পড়বে নাকি অ্যাডাম স্মিথ? শুধু মহাভারত নাকি মিল্টন-ও?
১৮৩৫ সালে ম্যাকলের লিখিত নোট। তার ভিত্তিতেই দেশে শুরু হল ইংরেজি শিক্ষা। দারুণ লাগছে যখন দেখছি ট্রেভেলিয়ানের নানা কারণে ব্যক্তিগত ভাবে ম্যাকলের সঙ্গে বিরোধ আছে কিন্তু ভারতীয়দের ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রেতিনি ছিলেন ম্যাকলে-রই পক্ষে।
১৮৩৮ সালে তিনি এব্যাপারে একটা প্রবন্ধ লেখেন। তাতে তিনি বলেন, ইংরেজি শিখে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এই ভেবে তাদের শিক্ষা না দেওয়ার রাজনৈতিক কৌশল আমি সমর্থন করিনা। যে জাতি দাস প্রথা বিলোপ করেছে তাদের কি এ ভাবে ভাবা উচিত? যে কোনও সৎ ব্রিটিশ ভাববেন, ইংরেজি শিক্ষা দিতেই হবে!
তাই আমরা যেমন ব্রিটিশদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক করি. এই বই থেকে জানা যাচ্ছে, ব্রিটিশদের মধ্যেও কি বিরাট বিতর্ক হয়েছে এ বিষয়টি নিয়ে!
এই বইটিতে মজার শেষ নেই। লেখক ভারতে এলেন ’৪৭-এর পর। প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাকে ভারতে আসতে প্ররোচিত করল কে? জর্জ ম্যাকলেই ট্রেভেলিয়ন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক। সেই দাদু ট্রেভেলিয়নের নাতি। লেখকেরও দাদু ট্রেভেলিয়ন, মানে ঠাকুরদা নয়, তিনি আসলে ছিলেন তাঁর গ্রান্ড আঙ্কেল । ঠাকুরদার ভাই। বাবার নিজের কাকা।
লেখক বলছেন, আমি সেদিনই তাঁর কথা শুনে কেমব্রিজে আমার ঘরে চলে আসি। ঠিক করে ফেলি, ভারতে আমলার চাকরি নিয়ে চলে যাব। ওখানে, মানে ভারতে আমার যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনও ভূমিকা ছিল তা নয়, কিন্তু পুরনো ব্রিটিশ ভারত আর স্বাধীন ভারত, দু’টোর মধ্যে যে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া তার সাক্ষী ছিলেন তিনি। লেখক বলছেন, নেহরু যেমন দুটো নেহরু ছিলেন।দুই নেহরু দু’রকম ছিলেন। একজন বলছেন শেক্সপিয়রের লন্ডন। তাকে তিনি ভালবাসেন। সেই ব্রিটিশ জাতির প্রেমিক তিনি। আর এক নেহরু বলছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী, শোষক, অত্যাচারী। ঠিক যে ভাবে শশী তারুর তাঁর সাম্প্রতিক বইতে দেখিয়েছেন, ব্রিটিশ শাসক ভারতীয় চাষি এবং গরিবদেরউপর কী ভাবে অত্যাচার করেছে। সে আর একটা দিক।
সেই ব্রিটিশ বাংলা থেকে আজকের বাংলা? কোথা থেকে কোথায়?
কিন্তু এব্যাপারে তো কোনও সন্দেহ নেই যে ম্যাকলে এবং আরও অনেকেই আমাদের দেশের শিক্ষার প্রসারের জন্য অনেক কাজ করেছেন। লেখক বলছেন, কলকাতায় বেন্টিঙ্ক সাহেবও খুব সংস্কারমুখী ছিলেন। ম্যাকলে কলকাতায় তাঁর শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বেন্টিঙ্কের একটি মূর্তি স্থাপন করে।
কলকাতা এবং আমরা বাঙালি গর্বিত। এই শহরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা আর সমাজ সংস্কারে কী কী কাণ্ড হয়েছে ভেবে দেখুন! প্রেসিডেন্সি কলেজ, ইডেন হিন্দু হস্টেল, প্রথম মেয়েদের কলেজ বেথুন, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, স্কটিশচার্চ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়—আরও কত কত প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশরা এই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের কিছু কম উপকার করেননি।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় কী ভাবে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কী ভাবে সমাজ সংস্কার হয়েছে তার অসাধারণ বিশ্লেষণ পড়লাম অন্য একটি বইতে। নাম‘ক্যালকাটাইন দ্য নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি’।নিয়োগীবুকস-এর বই।বিদিশা চক্রবর্তী এবং শর্মিষ্ঠা দে সম্পাদিত বইটিতে সার্বিক ভাবে কলকাতার নগরায়নের কথা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্সি, ইডেন হিন্দু হস্টেল, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, বেথুন— এক একটা প্রতিষ্ঠান ধরে এক একটি অধ্যায়ে তার ইতিহাস গবেষণা হয়েছে।
সেই ব্রিটিশ বাংলা থেকে আজকের বাংলা? কোথা থেকে কোথায়?
ভাবুন,’৪৭ সালের পর দীর্ঘ কংগ্রেস শাসন দেখলাম পশ্চিমবঙ্গে। তারপর দীর্ঘ বাম শাসন ’৭৭ সাল থেকে । তারপর আজ চলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসন। আজ ঘুম থেকে উঠতেই দেখছি কলেজে কলেজে ভর্তি নিয়ে চলছে এক চূড়ান্ত নৈরাজ্য!
আমরা কোথায় ছিলাম? কোথায় এলাম?
শিক্ষা কমিশন গঠনে অবশ্য সিপিএমের কোনও জুড়ি ছিলনা। ১৯৭৪ সালে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক হিমাংশু বিমল মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত হয় রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের জন্য একটি কমিশন। দীর্ঘ পাঁচ বছর লেগেছিল এই কমিশনের রিপোর্ট দিতে। ১৯৮১ সালে গঠিত হয়েছিল ভবতোষ দত্ত কমিশন। ১৯৮৪-তে কমিশন রিপোর্ট জমা দেয়। গৌরীনাথ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে ’৮২-তেএক কমিটি গঠিত হয় রাজ্যের সংস্কৃত শিক্ষার উন্নয়নের জন্য। ’৯১ সালের মাঝামাঝি তৈরি হয় অশোক মিত্র কমিশন। ’৯৮ সালে নিযুক্ত হয় পবিত্র সরকার কমিটি। ২০০১-এ গঠিত হয়েছিল অধ্যাপক রঞ্জুগোপাল মুখোপাধ্যায় কমিটি! দেখুন,’৭৬-’৭৭ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল ২২৪ কোটি টাকা! ২০০৫-’০৬সালে এই পরিমাণ বেড়ে হয় ৫৭৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি। তার মানে বামফ্রন্ট বরাদ্দ বাড়িয়েছে অনেকটাই। কমিশনও কম গঠন করেনি। কিন্তু শিক্ষার হাল খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে।
অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্ট এসময়ে যে সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে তাতে কী বলা হয়েছিল মনে করুন। মূল কারণ দলবাজি! যোগ্য মেধাকে গুরুত্ব না দিয়ে দলের বিশেষজ্ঞকে কাজে লাগানো হয়! তাতে বাংলা আরও অধঃপাতে যায়!
এখন কী দেখছি? সিপিএমের সেই মাফিয়া লুম্পেনরাই আজ তৃণমূলে আশ্রয় নিয়েছে। এমনটাই হয়। দলতন্ত্রকে নির্মূল করা সহজ কাজ নয়!
কোথায় ম্যাকলে আর কোথায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়?
সুদীর্ঘ অবনমনের ইতিহাস!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy