কে কোথায় ঘুমোয় তা নয়, সুভাষদা দেখেন কে কোথায় জেগে থাকে। তেমনি ইদানীং আমার মনে হয় কার কেমন শুরু তা নয়, কার কেমন শেষ এটাই আসল কথা। বুঝি এ-সব বয়সের লক্ষণ। তা শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে বেলা তো কম হল না।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শেষ বেলার ওই লাইন দুটোতে আমি আজও কেঁপে কেঁপে উঠি। সেই যে, চোখের অত জল জমিয়ে রেখেছিলে কেন, আমাকে ভাসাবে বলে। এ কবিতা যে বয়সের সে বয়সে লোকে তো জপতপ করে। অন্তত, বসে পরকালের কথা ভাবে, নয়তো পরনিন্দা পরচর্চায় বিশুদ্ধ আনন্দ উপভোগ করে। আর এ-সব ছেড়ে যাঁরা আরও উচ্চ মার্গের জীবনসাধনা করেন তাঁদের জীবনে অনেক উন্নতি হলেও কবিতা কেমন হিংসুটেপনা করে হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। অন্তত অনেক সময়ে তো বটেই। আর কবিতার খাত শুকিয়ে গেলে সে যে কী অকরুণ জিনিস হয়।
সুভাষদার কবিতায় চড়া পড়েনি, বলা ভাল তিনি চড়া পড়তে দেননি। চড়া তো নিজের থেকে এগিয়ে আসে। কার গানের গলা কখন ছেড়ে যাবে সে যেমন কেউ জানে না, এও বোধহয় খানিকটা তেমনই। কিছুটা হয়তো হাতে থাকে, কিছুটা হয়তো থাকে না। একটানা ষাট-পঁয়ষট্টি বছর কবিতার চাপ শরীরে ধারণ করা, সে বড় শক্ত কাজ। যে পারে সে পারে। খরা ও বালিয়াড়ির এত আয়োজন সাজানো থাকে আমাদের চার পাশে যে ভয় হয় কখন ঝড়বৃষ্টি থেমে গিয়ে সব শুকিয়ে যাবে। কবিদের তাই ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। প্রকৃতির খামখেয়াল যেন।
তবে কবির হাতে কিছুই কি নেই? তাও বোধহয় একেবারে ঠিক নয়। জানি না চাবিকাঠি কোথায়।
রাস্তা দিয়ে যেই যায়, খোলা জানলা,
উঁকি মেরে দেখে
কে একজন সারাক্ষণ গদি-আঁটা কাঠের চেয়ারে
টেবিলে দু-ঠ্যাং তুলে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে (দৃশ্যত, ‘যারে কাগজের নৌকো’)
এই হত্যে দিয়ে পড়ে থাকাই তা হলে সব। তাই বা কী করে বলি। হত্যে হয়তো দিতে হবে, তবে তাতেই যে প্রসাদ মিলবে তা কে বলবে। জীবনটাকে যার যার মতো করে নিংড়ে নিতে হবে। কত ভাবে সেই নিংড়ে নেওয়ার খেলাটা খেলা যায়। উপরের আত্মপ্রতিকৃতিতে সে খেলার একটা রকম। আর একটা রকম, হেঁটে বেড়ানোয়। দূর দূর দুর্গম জায়গায় হাঁটতে হবে তারও কোনও মানে নেই। ওই শরৎ ব্যানার্জি রোডের চার পাশ দিয়ে হাঁটলেও চলে। হাঁটতে হয় শুধু চোখকান খোলা রেখে, সবজি বাজারের দিকেও তাকাতে তাকাতে। এখন শীতের সবজি বাজারে উঠেছে, ধুর এখন কে যায়। লেপটে থাকতে শিখতে হয়। আমাদের চার পাশ হাত বাড়ায়, আমরা ধরা দিতে জানলে তবে তো।
কোন কোন ঘাটে জল খেয়েছেন। সেই এক বার ব্যঞ্জনহেড়িয়ার পুকুরের জল খেয়ে পেটের অসুখে নাকাল। সেই থেকে অমরু শতক, গাথা সপ্তশতী আর একেবারে হাফিজ। স্কুলে থাকতে সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নামে লেখা সেই হাফিজের অনুবাদ কবিতা যে দিন আমাদের হাতে এল, সে আমাদের কী বিস্ময়। স্কুল থেকে কোনও ভাবে তবে হাফিজ হানা দিয়েছিলেন। কোথা থেকে যে কী হয়।
আমার দৌড় শুরু ‘অগ্নিকোণ’ থেকে। তার আগে ‘পদাতিক’, আমি তখন হাঁটি হাঁটি পা পা। তা ছাড়া আমি তখন কলকাতায় ভূমিষ্ঠ হইনি। আমি জানি ওই নিউজপ্রিন্টে ছাপা অগ্নিকোণ। বই তখন আমাদের হাতে পড়ে বা পড়ে না। নিজেদের সংগ্রহের তখনও প্রশ্ন ওঠে না। অগ্নিকোণ আমার হাতে এসেছিল। অনুমান করি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সূত্রে। উনি ছিলেন আমার দাদার বন্ধু ও সহকর্মী। আমি কলেজের ছাত্রবয়সে ওঁকে পাই, সে অনেক পরের কথা।
‘অগ্নিকোণ’-এ ছিল মিছিলের মুখ। সে মুখের গনগনে আঁচে আমি কুপোকাত। তখন থেকেই। যদিও ওই বয়সে আমার কোনও মুখও ছিল না, মিছিলও ছিল না, তা-ও। মিছিল আমার আর হল না। কিন্তু মিছিলের মুখ আমাকে সমানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াল। কারও হাতে কোনও নিষিদ্ধ ইস্তাহার কখনও গুঁজে দিইনি আমি। রাজনীতির ঢেঁকিতে একটা পাড়ও আমার দেওয়া হল না কখনও। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় গেঁথে গেলাম আমি চির কালের জন্য।
ওঁর কবিতার রাজনীতি নিয়ে কখনও কোনও অসুবিধা হয়নি, তা-ও বলব না। কবিতার রাজনীতি আর কবির রাজনীতি গুলিয়ে ফেলার দরকার নেই। যদিও তা আমরা হামেশা গুলিয়ে ফেলি। আমাদের এখানকার চৈনিক পর্বের সময়ে ওঁর কবিতায় ‘ম্যাও’ পড়ে আমার মন খারাপ হয়নি বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। কিন্তু মন খারাপ হলেও অসুবিধা হয়নি। ভারত-চিন যুদ্ধের সময়ে আমি তখন জাতীয়তাবোধের জ্বরে আক্রান্ত হইনি। তা ছাড়াও রাসেলের প্রায়-নিষিদ্ধ বইটা বাজার থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার আগে কোনওক্রমে পড়ে ফেলেছিলাম। ফলে ‘ম্যাও রাজনীতি’র শরিক হতে পারিনি তখন। আর সুভাষদার কবিতাও থেমে থাকেনি ওখানে। আরও কত কিছু দেখা দিয়েছে তাতে।
চেনাজানা হওয়ার অনেক আগে আমি এক দিন ওঁকে রাস্তায় দেখেছিলাম। তাই স্বাভাবিক। রাস্তাই তো ওঁর আসল রাস্তা। মেট্রো সিনেমার সামনে এক দিন ওঁকে দূর থেকে দেখি। সঙ্গে যে ছিল সে চিনত। সে অনেক আগুয়ান। বলেছিল, ‘ওই দ্যাখ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়’। সে দিনের যে-চেহারা আমার চোখে আজও লেগে আছে। সে অনেক রোগা চেহারা। কিন্তু মাথায় ওই একই রকম ‘কাকের বাসা’। তখনও কালো। আমি ওই চুলেই মাত।
আরও কিছুটা পরে, রাস্তায় আর এক দিন দেখেছিলাম সুভাষদাকে। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের পাশের গলি। যে দিকটায় কেক-বিস্কুটের সুন্দর গন্ধ ভাসত। ওখানে এক দিন সুভাষদাকে রাস্তা পার হতে দেখেছিলাম। চুলে তখন ধুলো-ছড়ানো পাক ধরেছে। সত্যি মনে হত, কেউ যেন ধুলোবালি ছড়িয়ে দিয়েছে মাথায়।
ওই চুল আর ওই মিষ্টি হাসি। ভুবন জয় করতে আর কী লাগে। আরও তো ছিল। ছিল কবিতা পড়া। গদ্য পড়াও। নিজে কথা বলতেন খুব মিষ্টি করে। একটু টেনে। ভারি অন্য রকম লাগত শুনতে। উনি বলতেন, বাংলা বলা বা বাংলা ভাষাই হয়তো পেয়েছেন মায়ের মুখ থেকে। ওঁর মা নাকি খুব সুন্দর কথা বলতেন। বাবার বন্ধুরা এসে মাকে নাকি রাগিয়ে দিতেন। মায়ের রেগে যাওয়া কথাগুলো শোনার জন্য। আমরাও কি সুভাষদার মুখে শান্তিপুরের ভাষাই শুনেছি? হয়তো।
কবিতা সুভাষদা খুবই ভাল পড়তেন। ওঁর স্বভাবসিদ্ধ একটু টানা উচ্চারণে। কাজেই গোটাটা মুখের কথাই মনে হত। ওঁর মুখে কবিতা শোনার সুযোগ অনেক বার পেয়েছি আমরা। এক বার তো ‘যাচ্ছি’ কবিতা নিজে পড়েছিলেন যাদবপুরের একটা কবিতা পড়ার আসরে। ওঁর মুখে ওই কবিতা শোনা একটা অভিজ্ঞতা। কবিতার শেষের দিকে যাওয়া যখন একেবারে এসে পড়েছে তখন একটু দ্রুত, লাইনগুলো ছোট হয়ে আসে। সে একটা ব্যাপার হয়।
এক বার সুভাষদা আমাদের কয়েক জনকে ডেকেছিলেন নতুন কিছু কবিতা শোনাবেন বলে। বাড়িতে। ভিতরের ঘরে বসে শুনেছিলাম সে-বার। টেবিলের উপরে গীতাদির সবজি কাটা রয়েছে এক দিকে। তারই মধ্যে একটু জায়গা করে নিয়ে ওঁর কাগজপত্র। একটার পর একটা কবিতা পড়ে যাচ্ছেন। আমরা তিন-চার জন শ্রোতা। সে-দিন ছিল সবই একটু যাওয়ার কথায় ভরা কবিতা।
এ রকম সন্ধ্যাবেলা তো বার বার আসে না জীবনে। পড়া শেষ হলে অমিয় দেব বলেছিলেন মনে আছে, যাওয়ার এত কী তাড়া। এখনও এতটা কবিতা বাকি রয়েছে। সুভাষদা মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ভাল লেগেছে?
সে-দিন কেউ শাঁখ বাজায়নি, কেউ হুলু দেয়নি। আজ পড়ন্ত বেলায় সে-কথা মনে পড়েছে নাকি। জানি না। কেউ জানে না। বললেন এক দিন, তোমরা আসবে একটু ওই দিন, গীতার জন্মদিন। গিয়েছিলাম আমরা দু’একজনে। লেক মার্কেট থেকে রজনীগন্ধার ডাঁটা আর মালা কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। কী খুশি যে হয়েছিলেন দু’জনেই।
একেবারে শেষে বলে গিয়েছেন সেই ভালবাসারই কথা:
মাকড়সারা জাল বুনছে
পোড়া এ দেহে মরেও কিন্তু মরে যায় না
ভালোবাসা
অফুরন্ত স্নেহ।
সেই অফুরন্ত স্নেহ রেখে গিয়েছেন সুভাষদা সবার জন্য। যে যেমন নিতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy