রেললাইন থেকে এক শ্রমিকের দেহ সরাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। ছবি: রয়টার্স।
কিছু দিন আগে, রবীন্দ্র জয়ন্তীর পুণ্য প্রভাতে সকলের ঘুম ভাঙে এক হৃদয়বিদারক খবর শুনে। মহারাষ্ট্রের অওরাঙ্গাবাদে (সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী) ১৭ জন পরিযায়ী শ্রমিককে পিষে মেরে ফেলে এক মালগাড়ি। এই শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে মহারাষ্ট্রে তাঁদের কর্মস্থল থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে মধ্যপ্রদেশে তাঁদের বাসস্থানে ফিরছিলেন। তাঁরা এতটাই ক্লান্ত ছিলেন যে, রেললাইনের উপরেই রাত কাটাতে শুয়েছিলেন এবং ট্রেনের আওয়াজও শুনতে পাননি।
এই ঘটনায় পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি কেন্দ্রের বহু সপ্তাহ ধরে চলে আসা অবজ্ঞা যেন পূর্ণতা লাভ করল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাইওয়ের উপর হন্টনরত পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের ছবি যে কোনও বিবেকবান মানুষের হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে। তাঁদের ফোস্কা পড়া পায়ের ছবি কিংবা ক্ষুধার্ত চোখের বেদনা আপনার অন্তরাত্মাকে ঝাঁঝরা করে দিতে সক্ষম। কিন্তু, কেন্দ্র তাঁদের উপেক্ষাই করে গিয়েছে।
সংসদের অধিবেশন মুলতুবি হওয়া আর লকডাউন বিধি বলবৎ হওয়ার মাঝে সাংসদরা বিমানে করে যে যার কেন্দ্রে ফিরে যাওয়ার জন্য ২ দিন সময় পেয়েছিলেন। কিন্তু বাকি দেশের জন্য, ২১ দিনের তালাবন্দি ঘোষণা করা হয়েছিল মাত্র চার ঘন্টার নোটিসে। দায় কার? জবাবদিহি করবে কে? এই আকস্মিক ফরমানের ফলে দেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। হুড়োহুড়ি পড়ে যায় বাড়ি ফেরার জন্য। রাতারাতি সব কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন শ্রমিকরা। কোনও আশার আলো দেখতে না পেয়ে, তাঁদের আর্তি ছিল একটাই— তাঁদের বাড়ি ফিরে যেতে দেওয়া হোক। কিন্তু, সপ্তাহের পর সপ্তাহ পার হয়ে যায়। কেউ শোনেনি সেই আর্জি। বাস্তব থেকে এতটাই দূরে সরে গিয়েছে কেন্দ্র যে, ৩১ মার্চ দেশের সলিসিটর জেনারেল সুপ্রিম কোর্টকে জানান, দেশের কোনও প্রান্তেই রাজপথে বা হাইওয়েতে পরিযায়ী শ্রমিকদের দেখা পাওয়া যায়নি। ঠিক একই সময়ে, দেশ জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার ছবি ভাইরাল হচ্ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল সেই সব ছবি।
আরও পড়ুন: রাতে লাইন ধরে হাঁটছিলেন ৫১ জন শ্রমিক, একটুর জন্য অওরঙ্গাবাদ হল না বীরভূম
আরও পড়ুন: বিবর্তিত হতে হতে করোনা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, বলছে গবেষণা
এই পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছিল তৃণমূলের নেতৃবৃন্দকে। লকডাউন শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের কথা বলে এসেছে তৃণমূল। এখানে বলে রাখা ভাল, আমরা পরিযায়ী শ্রমিকের বদলে ‘অতিথি শ্রমিক’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করাতে বিশ্বাসী। গত কয়েক সপ্তাহে জাতীয় এবং রাজ্যস্তরে আমাদের দল বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কিছু ডিজিটাল সাংবাদিক সম্মেলন করেছে যার মধ্যে অতিথি শ্রমিকদের বিষয়টিও ছিল। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম ১৮টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন তাঁদের রাজ্যে বাংলার শ্রমিকদের দেখভালের জন্য। তিনি অন্য রাজ্যগুলিকে আশ্বাস দেন, ভিন্ রাজ্যের অতিথি শ্রমিকদের বাংলায় যথাযথ খেয়াল রাখা হবে।
দীর্ঘ পথ হেঁটে বাড়ির পথে পরিযায়ী শ্রমিকরা। মহারাষ্ট্রে। ছবি: এপি।
বাংলার তৃণমূল সরকার 'স্নেহের পরশ' নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে অন্যান্য রাজ্যে আটকা পড়া প্রায় ১০ হাজার অতিথি শ্রমিককে জনপ্রতি এক হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করার লক্ষ্যে। অন্যান্য রাজ্য থেকে অতিথি শ্রমিকদের নিয়ে বাংলায় ইতিমধ্যেই পৌঁছেছে দু’টি ট্রেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আরও কয়েকটি ট্রেন পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে বাংলায় ফিরে আসবে। এখন পর্যন্ত মোট ৮০ হাজার জনকে রাজ্যে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদের বরণ করে নিতে সম্পূর্ণ রূপে প্রস্তুত রাজ্য এবং স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যেমনটা কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি জানিয়েছিলেন।
অন্যান্য দেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে বিশেষ চার্টার্ড বিমানের ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্র। সাধুবাদযোগ্য উদ্যোগ। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে সমাজের দরিদ্রতম এবং দুর্বলতম শ্রেণির মানুষের সাহায্যার্থে নির্দয় বিজেপি সরকারের কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। কেন্দ্রের এই নির্বোধ মনোভাব সম্পর্কে বিরোধী দলগুলি এবং সুশীল সমাজের প্রতিবাদের পর কেন্দ্রীয় সরকার অবশেষে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরত পাঠাতে উদ্যোগী হয়েছে। আয়োজন করা হচ্ছে বিশেষ ট্রেনের। আর এই ট্রেন পরিষেবা শুরু হল কবে? লকডাউন ঘোষণার পাঁচ সপ্তাহ পর। পয়লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে। গিমিক আর দেখনদারিতে এই সরকার নজির সৃষ্টি করে চলেছে।
আশার আলো যুগিয়েও, নিমেষে পরিযায়ী শ্রমিকদের খুশির জোয়ারে অমাবস্যার ছোঁওয়া লাগলো। রেল স্টেশনে পৌঁছে তাঁরা জানতে পারলেন, টিকিটের দাম তাদেরই দিতে হবে। স্লিপার শ্রেণির ভাড়ার উপর খাঁড়ার ঘা— প্যাসেঞ্জার প্রতি ৫০ টাকার অতিরিক্ত লেভি। মোটের উপর জনপ্রতি ভাড়া দাঁড়ালো ৭০০-৮০০ টাকা। সেই সঙ্গে স্টেশন পৌঁছনোর জন্য বাসভাড়া অতিরিক্ত। প্রত্যেক শ্রমিককে যাত্রার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট নিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে, তাঁদের মাথাপিছু ১২০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এদিকে গত কয়েক সপ্তাহ তাঁদের কোনও আয় নেই।
কেন্দ্রের অবশ্য দাবি, তারা রেল ভাড়ার ৮৫ শতাংশ খরচ বহন করছে। এর মানেটা কী? ভারতীয় রেল প্রত্যেক যাত্রীকে একটি নোশনাল সাবসিডি দিয়ে থাকে, যার মূল্য টিকিটের ভাড়ার ৪৫ শতাংশ। পণ্যবাহী ট্রেনের আয় থেকে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলির ভাড়ায় এই সাবসিডি দেওয়া হয়। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব এবং প্রতি কম্পার্টমেন্টে সীমিত যাত্রী সংখ্যার কারণে এই সাবসিডির মূল্য বেড়ে হয়েছে ৮৫ শতাংশ। অবশ্য, টিকিটের আসল ভাড়ায় এর কোনও প্রতিফলন হয়নি।
বরং কেন্দ্র টিকিটের দামের ভার এবং সেই ভাড়া সংগ্রহ করার দায়িত্ব রাজ্যগুলির উপর সঁপে দিয়েছে। গত ২ মে, রেলমন্ত্রক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, "রাজ্য সরকারের আঞ্চলিক আধিকারিক যাত্রীদের হাতে টিকিট তুলে দেবেন এবং সেই ভাড়া সংগ্রহ করে ভারতীয় রেলের কাছে জমা করবেন।"
ভারতীয় রেল একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ,তাদের যেমন আর্থিক বাধ্যবাধকতা আছে, ঠিক তেমনই সামাজিক দায়িত্বও আছে। ২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের সময় বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছিল ভারতীয় রেল। উদ্ধার করা মানুষদের বিনামূল্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে কি হল? ২৮শে মার্চ কোভিড অতিমারির সাথে মোকাবিলার লক্ষ্যে পিএম কেয়ারস ফান্ড তৈরি করা হল। আশ্চর্যজনকভাবে, এই ফান্ডটি কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। সেই আলোচনা না হয় অন্য আর এক দিনের জন্য তোলা থাক। পিএম কেয়ারস ফান্ডে সংগৃহীত অর্থের কী হল? সেই টাকা দিয়ে কেন পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেন যাত্রার ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া হল না?
প্রধানমন্ত্রী অনেকবার বলেছেন, করোনা হল জাতীয় বিপর্যয়, এখন রাজনীতির সময় নয়। তৃণমূল এবং মমতাদি সহমত পোষণ করেন। এই বিপর্যয়ের মোকাবিলায় আমরা রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমরা সবাই সমান অংশীদার এবং আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এগুলি মহৎ চিন্তাভাবনা, তবে স্পষ্টতই বিজেপি আমাদের হতাশ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ভাল কিছু ঘটলেই কৃতিত্ব নেওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছে এবং কোনও বিপর্যয় বা ব্যর্থতার জন্য রাজ্যগুলিকে দায়ী করে এসেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ইস্যুও তেমনই একটি উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রীকে একান্ত অনুরোধ, আপনি আরও নেতৃত্ব দেখাতে পারেন? নাকি আপনি শুধু প্রাইম টাইম মন্ত্রীই থেকে যাবেন?
বি: দ্র: যখন এই প্রতিবেদনটি আমি পাঠাচ্ছি, তখন জানতে পারলাম, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৫ দিন পর আবার উদিত হয়েছেন। আর এই জাতীয় বিপর্যয়ের মধ্যে তিনি প্রথম কী কাজ করলেন? তাঁর প্রিয় শত্রু (বাংলা)-কে লেখা একটি মিথ্যায় ভরা চিঠি তিনি সংবাদ মাধ্যমে চুপিসারে ফাঁস করেছেন। আমার পরের প্রতিবেদনটি সেই বিষয়েই হবে।
লেখক: তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy