সীমাহীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভূস্বর্গ কাশ্মীর। অথচ নামটির সঙ্গে দুঃখজনক ভাবেই জড়িয়ে আছে সমস্যা শব্দটিও। আমরা যখনই কোনও জওয়ানের কাছে শুনি যে, তিনি জম্মু-কাশ্মীরে কর্মরত তখনই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কারণ সেখানে জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি। ওই অঞ্চলের উপরে পাকিস্তান ও চিনেরও দখলদারির মনোবৃত্তি রয়েছে ঘটনাচক্রে। বর্তমানে জম্মু-কাশ্মীরের জন্য ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ মর্যাদাস্বরূপ ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ প্রসঙ্গে সংসদ থেকে শুরু করে সমস্ত দেশ উত্তাল।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই ৩৭০ অনুচ্ছেদ? বিষয়টি সহজ করে বললে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় ভারতকে দেশভাগের সম্মুখীন হতে হয়। সেই সময় জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অঙ্গ ছিল না। সেটি ছিল মহারাজা হরি সিংয়ের স্বাধীন রাজ্য। যেখানে তাঁরই রাজতন্ত্র চলত। ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যাক্ট’ নামে ব্রিটিশ সরকার ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি করেছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীর ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত বা পাকিস্তান যে কোনও রাষ্ট্রেই যোগ দিতে পারবে। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে। অন্য দিকে, পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালুচিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে। ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাখতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলি হরি সিংয়ের রাজ্য আক্রমণ করে। তখন হরি সিং জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে ভারতের থেকে সামরিক সহায়তা পান তিনি।
যদিও পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। যা চলেছিল প্রায় দু’বছর। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৪৮ সালে ভারত কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। জাতিসঙ্ঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়। কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে। যদিও পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়।
অন্য দিকে, ১৯৬২ সালের চিন- ভারত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে চিন কাশ্মীরের আকসাই-চিন অংশটির নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এবং এর পরের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চিনের হাতে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ ভারত, পাকিস্তান ও চিনের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। দ্বিতীয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধটি হয় ১৯৬৫ সালে আর ১৯৭১ সালে তৃতীয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তির মধ্যে দিয়ে বর্তমানের ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণ রেখা চূড়ান্ত রূপ পায়।
কাশ্মীরে অমুসলিম ডোগরা রাজাদের শাসনকালের মেয়াদ শেষে সেখানকার আধিপত্য দখল করেন শেখ আবদুল্লা। ১৯৪৯ সালে নয়াদিল্লির সঙ্গে আবদুল্লার আলোচনার মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা (সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ) দেওয়া হয়। জওহরলাল নেহরু ছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ৩৭০ পরিচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু কাশ্মীরের বাসিন্দারা নাগরিকত্ব, সম্পত্তির মালিকানা, মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে যা দেশের অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দারা পায় না। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু কাশ্মীর ভারতের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী রাজ্য ছিল। ৩৭০ অনুচ্ছেদের মতে, জম্মু কাশ্মীরে প্রতিরক্ষা পররাষ্ট্র বা যোগাযোগের মতো কয়েকটি বিষয় ছাড়া সব ক্ষেত্রে ভারত সরকার কোনও আইন প্রয়োগ করতে গেলে আগে জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের সরকারের সম্মতি প্রয়োজন ছিল। ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের ইতিহাস এই ৩৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
২০১৮ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীর রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার, যাতে বিজেপিও অংশীদার ছিল। কিন্তু জুন মাসে বিজেপি জোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে রাজ্যটি দিল্লির প্রত্যক্ষ শাসনের অধীনে চলে আসে তখনই।
সম্প্রতি ভারত সরকার জওহরলাল নেহরুর আমলে ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরকে দেওয়া বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ অনুচ্ছেদটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় ও তা কার্যকর করে। ৩৭০ এর সঙ্গেই অবধারিত ভাবেই বিলুপ্ত হয় ৩৫এ ধারাটি। ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই ধারা। যাতে জম্মু কাশ্মীরের বাসিন্দারা বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত। সেখানকার বিধানসভা ঠিক করতে পারে রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কারা এবং তাঁদের বিশেষ অধিকার কী হবে? শুধুমাত্র স্থায়ী বাসিন্দারাই সম্পত্তির মালিকানা, সরকারি চাকরি বা স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার পান। এমনকি রাজ্যের কোনও মহিলা অন্য রাজ্যের কাউকে বিয়ে করলে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। তাঁর উত্তরাধিকারীদেরও সম্পত্তির উপরে অধিকার থাকে না। গত ৫ অগস্ট ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে রাজ্যসভায় একটি ঘোষণা করেন যে, সংবিধানে কাশ্মীরকে দেওয়া বিশেষ মর্যাদাস্বরূপ ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। ফলে ৩৫এ ধারাটিরও বিলুপ্তি ঘটে। ওই দিন রাজ্যসভার অধিবেশনে অমিত শাহ সেই নির্দেশনামা পড়ে শোনান। পরের দিনই উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় ৩৭০/৩৫এ বাতিল হয়ে যায়।
ফলে জম্মু কাশ্মীর বর্তমানে পৃথক পতাকার আওতায় না থেকে একই ভারত পতাকার ছত্রছায়ায় এল। জম্মু-কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা যেমন হারালো সংবিধান থেকে তেমনি এটি আর পৃথক রাজ্যও রইল না। ভেঙে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ এই দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ হয়ে যাওয়ারও প্রস্তাব রয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা থাকবে কিন্তু লাদাখে বিধানসভা থাকবে না।
এই পরিস্থিতিতে দেশ জুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কথা হচ্ছিল ক’জন কাশ্মীরি শালবিক্রেতার সঙ্গে। অদ্ভুত ভাবে তাঁদের মধ্যেও দেখলাম দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলছেন, জাতীয় সংহতির দিক থেকে দেখলে বিষয়টা ভাল হয়েছে। আবার অনেকেই বেজায় অখুশি। তাঁদের মতে, এটা একটা অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত। এর ফলে তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কারণ সব ব্যাপারেই এখন থেকে তাঁদের কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে ।
প্রাক্তন আইএএস শাহ ফয়শালের তৈরি নতুন রাজনৈতিক দল জম্মু-কাশ্মীর পিপলস মুভমেন্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাবে। যদিও মোদী সরকারের যুক্তি, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদেই রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে, তিনি যে কোনও সময় এই অনুচ্ছেদ রদ করে দিতে পারেন। কারণ এই অনুচ্ছেদ অস্থায়ী। তাই ৩৭০ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলেই সাংবিধানিক নির্দেশিকা জারি করেছেন রাষ্ট্রপতি। তাতে সংবিধানের ৩৬৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়েছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সংবিধান পরিষদকে ‘বিধানসভা’ পড়তে হবে। একই সঙ্গে রাজ্যসভাতেও প্রস্তাব আনা হয়েছে যে, সংসদ রাষ্ট্রপতির কাছে ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার সুপারিশ করেছে। কাজেই এটি সাংবিধানিক পদ্ধতি বলেই মনে করছে কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের বহু মানুষ কিন্তু এই সংবাদে উল্লসিত। কোনও বিভাজনের সংস্কৃতি ভারতের আত্মা নয়। একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত কোনও অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা পাওয়াটাই বরং ভেদবুদ্ধি জিইয়ে রাখে বলে মনে করছেন বেশিরভাগ মানুষ।
শিক্ষিকা, জিয়াগঞ্জ শ্রীপৎ সিং কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy